বিশেষ সংখ্যা : প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে ৭ মার্চের ভাষণ
১৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ডে ১১০৮ শব্দের একটি অনন্য ঘোষণা
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন দেশের অগ্রগণ্য ইতিহাসবিদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক অধিকার, বৈশ্বিক রাজনীতি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তিনি আমাদের অসংখ্য গবেষণামূলক গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ তিনি টিএসসিতে উপস্থিত থেকে সরাসরি শুনেছেন। সেদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ।
রাহাত মিনহাজ: ১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ ও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাই।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকেই আমাদের মাঝে একটা গুঞ্জরণ ছিল যখন বঙ্গবন্ধু বলে দিলেন যে ৭ মার্চ তিনি পরবর্তী নির্দেশ দেবেন। আমরা ধারণা করেছিলাম, সেই নির্দেশটি হবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা। ২ মার্চ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়লো তখন সেই ধারণাটা আরও বদ্ধমূল হলো। তখন জানতাম যে বঙ্গবন্ধুর অজান্তে এ পতাকা উড়েনি। এই ধরণের একটা বিবেচনাবোধ আমাদের মধ্যে ছিল।
রাহাত মিনহাজ: কেমন ছিল ৭ মার্চের দিনটি?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: ৭ মার্চ সকাল থেকেই যথেষ্ট উত্তেজনা বিরাজ করছিল জনগণের মধ্যে। উত্তেজনাটা ছিল যদি স্বাধীনতা ঘোষিত হয়ে যায়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষিত করবেন ঠিকই; কিন্তু ঘোষিত হয়ে গেলে পরের পরিস্থিতি কী হবে? এ ধরনের একটা দুঃশ্চিন্তা আমাদের মধ্যে ছিল; কিন্তু আমরা দেখলাম যে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এমনভাবে কিছু দিক-নির্দেশনা দিলেন, যাকে আমি মেঠোবাংলায় বলতে পারি, ‘তিনি সাপটি ঠিকই মেরেছিলেন, কিন্তু লাঠি ভাঙ্গেননি।’ পাকিস্তানিদের প্রস্তুতি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা করামাত্রই জেট থেকে বোমাবর্ষণ, গুলিবর্ষণ করা হবে। ঢাকা হাইকোর্টের ছাদের ওপরে বাজুকা কামান প্রস্তুত ছিল। অর্থাৎ একটা রক্ত গঙ্গা বয়ে যাবে; কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়িয়ে গিয়ে, যা বলার পরিপূর্ণভাবে সাংকেতিক ভাষায় বিচক্ষণতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন। পাকিস্তানিরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল যে স্বাধীনতার কথা ঘোষিত হয়নি; কিন্তু বঙ্গবন্ধু তো বলেছেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীতার সংগ্রাম।’
রাহাত মিনহাজ: ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে আসা জনতার মনোভাব কেমন ছিল?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: আমরা যারা উপস্থিত থেকে এই অমর ভাষণ শুনেছি, তারা একটা আবেশের মধ্যে ছিলাম। বেশ একটা দীর্ঘ বক্তৃতা শোনার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলাম। খুব সংক্ষেপে বক্তৃতাটা শেষ হলো। পরে যখন বক্তৃতাটার পর্যালোচনা করছিলাম, তখন বুঝেছি যা শোনার দরকার ছিল, তা শুনে গেছি। কিছু বলতে বাকি রাখেননি বঙ্গবন্ধু। এটা ঠিক, পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীদের রাজনৈতিক সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ভাষণের শুরুতেই তিনি চারটি শর্ত দিয়েছিলেন। যেমন, এক. সামরিক শাসন প্রত্যাহার, দুই. সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে, তিন. যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের জন্য বিচার বিভাগে তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে, চার. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।
রাহাত মিনহাজ: দাবি না মানলে নানা প্রস্তুতির কথাও তো ভাষণটিতে ছিল?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু খুব ভালো করেই জানতেন যে পাকিস্তানিরা এই শর্তগুলোর একটিও মানবে না। আর তাই এক্ষেত্রে বাঙালির করণীয় কী, তা তিনি নির্দেশ দিয়ে দিলেন বক্তৃতার দ্বিতীয় অংশে। যখন তিনি বললেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। কাজেই না বলা কোনো কথা রাখেননি তিনি; কিন্তু কাগজে কলমে প্রমাণ করা কঠিন হবে যে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন। সংক্ষিপ্ততম; কিন্তু অত্যন্ত বিচক্ষণ একটি ভাষণ ছিল এটি।
রাহাত মিনহাজ: বর্তমানে বিভিন্ন রেকর্ডে আমরা ভাষণটির পুরো অংশ পাই না। তবে জানা যায় এটি ছিল ১৮-১৯ মিনিটের একটি ভাষণ। অনেকে বলে থাকেন ভাষণটি ২৩ মিনিট ছিল। ভাষণটির ব্যাপ্তি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: ওই দিন বঙ্গবন্ধু একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। অন্য কোনো বক্তা ছিলেন না। আমার ঘড়িতে হিসেব আছে তিনি ১৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ড বক্তৃতা করেছিলেন। আমি হিসেবে করেছিলাম। আমি ইতিহাসের ছাত্র। আমি এই ভাষণটির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলাম। আমি জানতাম এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ। এটা জেনেই সেখানে গেছি। কারণ সারা পৃথিবী তাকিয়ে ছিল তার দিকে। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে আমার বুঝতে ভুল হওয়ার কথা নয়, গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি ইতিহাস হবে একদিন এবং তাই হয়েছে। ভাষণটি ছিল ১১০৮ শব্দের। অনেকে যোগ করে কিছু বাড়ায়, আবার অনেকে বিয়োগ করে কিছু কমায়; কিন্তু না, এটা ছিল ১১০৮ শব্দে।
রাহাত মিনহাজ: ভাষণটি পাকিস্তান রেডিওতে সম্প্রচার করতে দেয়া হলো না। তবে পরের দিন রেডিওতে সম্প্রচার করতে দিতে বাধ্য হলেন ইয়াহিয়া খান। ইত্তেফাক সংবাদ করল, অনেক পত্র-পত্রিকাতেও সংবাদ আসল। আপানার কাছে জানতে চাই, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির সংবাদ গণমাধ্যমে কিভাবে এসেছিল, আপনার কি মনে আছে ওই সময়টা?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: গণমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ভূমিকা পালন করেছে ইত্তেফাকের। আমার যতদূর মনে পড়ছে, ইত্তেফাকে একটা কূটনৈতিক একটা শিরোনাম করা হয়েছিল। ‘মুক্তির ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু’ এই ধরনের; কিন্তু স্বাধীনতার কথাটা বলা হয় নাই। আর পাকিস্তান অবজারভারে ‘শেখ মুজিব স্পিকস ফর লিবারেশন অব দ্য পিপল’, এই ধরনের কথা লেখা ছিল। এই মুক্তির কথাই, স্বাধীনতার কথা এড়িয়ে গেছে।
রাহাত মিনহাজ: রেডিওর ওই সংগ্রামের ব্যাপারটা একটু বলুন?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: শেখ মুজিবুর রহমানের ওই ভাষণ সম্প্রচার করতে না দেয়ায় রেডিওর সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ধর্মঘট করেছিলেন। ভাষণটি তারা ময়দানে থেকে রেকর্ড করেছিলেন। ওই দিন ভাষণটি রিলে করে সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থাও ছিল। শেষ মুহূর্তে সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হলো। আশরাফুজ্জামান খান রেকর্ড করেছিলেন। রেডিওর কর্মকর্তারা ধর্মঘট করলেন। তারপরের দিন সকালে রেডিওতে ভাষণটি সম্প্রচারিত হলো। এ কে খন্দকার রেডিওতে শুনেছেন। রেডিওতে শুনে তিনি কোথায় পেলেন বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছেন। তবে বঙ্গবন্ধু ৩ জানুয়ারি ১৯৭১ সাংসদদের যে শপথ গ্রহণ করালেন পল্টনে, সেখানে ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন সংগত কারণে।
রাহাত মিনহাজ: একজন তরুণ শিক্ষক, একজন স্বাধীনতাকামী তরুণ বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আপনাকে কীভাবে আলোড়িত করেছিলো?
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, টিএসসির দেয়ালের ওপর বসেছিলাম। আমি আর আমার আরেক বন্ধু পকেটে বাদাম কিনে নিয়ে বসে আছি যে বক্তৃতা শুনব। ভেতরে যাওয়ার সাহস পাইনি যে একটা কিছু ঘটে যেতে পারে। প্রথমে মনে হলো, বঙ্গবন্ধু তো স্বাধীনতার কথা বললেন না; কিন্তু মুহসীন হলে ফিরে আমরা যখন দুজনে আলোচনা করছি, তখন দেখলাম যা শুনতে চেয়েছি, সবই তো শোনা হয়ে গেলো। বুঝে গেছি এর পরে আর পাকিস্তান নেই। ২ মার্চ পতাকা তুলেছে, সেটা দেখেছি। এখন মুক্তির কথা বলা হলো, আর কি বাকি থাকে? প্রথমত, বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তিনি যদি সরাসরি ঘোষণা করতেন, তাহলে সেটা হতো বিচ্ছিন্নতাবাদ। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রার ঘটনা তার মনে ছিল। তিনি পারবেন না এটা করতে। দ্বিতীয়ত, তিনি যদি তখন স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, বিশ্ব-জনমত বাঙালির বিরুদ্ধে চলে যেত। বাঙালি বিদ্রোহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী এইভাবে চিত্রিত হতো। আর সেটা হয়ে যেত আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায় একপক্ষীয় স্বাধীনতা ঘোষণা। তার কাছে তথ্য ছিল, স্বাধীনতার ঘোষণা হলেই পাকিস্তানিরা হামলে পড়বে। সবকিছু তাকে জানান দেয়া হয়ে গেছে। এত চাপের মধ্যেও পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো একটি ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন। কখনোই সম্ভব হতো না সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া, তাতে হিতে বিপরীত হতো। কাজেই আমি মনে করি নেতৃত্বের চরম পরীক্ষায় তিনি সেদিন টিকে গেছেন ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে