Views Bangladesh Logo

অমর একুশে সংখ্যা ২০২৫

রাষ্ট্রীয় সব কাজ মাতৃভাষায় প্রকাশ করতে হবে

Jatin  Sarker

যতীন সরকার

মি তো মনে করি, শত্রু কখনো কখনো শত্রুতা সাধন করতে গিয়ে মিত্রের কাজ করে বসে। শত্রু যখন শত্রুতা সাধনে বিরত থাকে কিংবা কিছু উদারতা প্রদর্শন করে, তখন বরং নানা রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, শত্রুর প্রতি মনোভাব অনেক নরম হয়ে আসে। শত্রুর এরকম অবস্থান শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, ক্ষতিকরও। শত্রু বুদ্ধিমান হলেই এমন ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে সুখের কথা এই, বুদ্ধিমান শত্রুরও মাঝে মাঝে বুদ্ধিবিভ্রম ঘটে থাকে। সে রকম বুদ্ধিবিভ্রমের শিকার শত্রুই মিত্রের চেয়েও বড় মিত্র হয়ে যায়। সেভাবেই বাঙালি ও বাঙালিত্বের মহাদুশমন এবং পাকিস্তান-স্রষ্টা একান্ত ধূর্ত ও অতি বুদ্ধিমান দুই ‘কায়েদ’ কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান বাঙালি জাতির পরম মিত্রতা সাধন করেছিলেন।

বাঙালি জাতিকে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্তিবিলাস থেকে মুক্ত হওয়ার পথটি খুলে দিয়েছিলেন ওই অপতত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা জিন্নাহ সাহেবই। সে কাজটি তিনি করেছিলেন পাকিস্তান সৃষ্টির পর মাত্র ছয় মাস যেতে না যেতেই। ১৯৪৮ সালের মার্চেই তিনি ‘একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’- এমন কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিয়ে বাঙালি জাতির মহা উপকার সাধন করেছিলেন! এ রকম কথা সে সময়ে যদি তিনি না বলতেন, তবে বাঙালির নিজেকে বাঙালি বলে চিনে নিতে আরও অনেক বেশি সময় লেগে যেত; বাঙালির মন হয়তো আরও বহুকাল দ্বিজাতিতত্ত্বের খুঁটিতেই বাঁধা পড়ে থাকত। ‘মুসলমান আমরা’ পাকিস্তান মুসলমানের রাষ্ট্র, পাঞ্জাবি সিন্ধি বেলুচি পাঠান বাঙালি এসব কোনো কিছুই নই আমরা, ‘আমরা পাকিস্তানি’ বাঙালি জাতি এরকম ভাবনার মৌতাতে আরও অনেক কাল হয়তো বুঁদ হয়ে থাকত। অথচ যার মুখ-নিঃসৃত দুর্বচন বাঙালিকে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদী করে তুলেছিল এবং পাকিস্তান-মাদকের নেশা ছুটিয়ে দিয়েছিল, তিনি যে সেদিন আমাদের পরম উপকার করেছিলেন, সে কথা ভুলে থাকা কি সংগত!

বাঙালি জাতির এরকম উপকার করেছিলেন লিয়াকত আলী খানও। সেটি করেছিলেন জিন্নাহর বক্তব্য প্রকাশের কিছু আগেই- ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে। ‘পাকিস্তানের গণপরিষদে সদস্যদের বক্তৃতা করতে হবে হয় উর্দুতে, নয় ইংরেজিতে’- এমন একটি বিধানের সংশোধনী এনে পরিষদের বাঙালি সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে বাংলাকেও সরকারি কাজে ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এতেই রেগেমেগে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে লিয়াকত আলী মূর্খের মতোই বলে ফেলেছিলেন- ‘পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র। তাই পাকিস্তানের ভাষা মুসলিম রাষ্ট্রের ভাষাই হওয়া উচিত। প্রথমে সংশোধন প্রস্তাবের উদ্দেশ্য নির্দোষ বলে আমি মনে করেছিলাম। প্রস্তাবে বাংলাকে পরিষদের ভাষার অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হয় পাকিস্তানের মানুষদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করা, একটা সাধারণ ভাষার দ্বারা ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।’

সেদিন ‘কায়েদে মিল্লাত’-এর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছিলেন বাংলার অধিবাসী (অথচ বাঙালির দুশমন) খাজা নাজিমুদ্দিনসহ গণপরিষদের অনেক সদস্যই। অল্প কয়েক দিন পরই ঢাকায় এসে ‘কায়েদে আজম’ যা বললেন, তা ছিল আরও অনেক বেশি ইতরতাদুষ্ট। সে সময়কার ‘আজাদ’ পত্রিকার বয়ান অনুযায়ী জিন্নাহর বক্তব্য ছিল এ রকম- ‘অতীতে যাহারা মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে অথবা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে অথবা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়াছে, তাহারাই আজ আপনাদের ‘ন্যায়সঙ্গত’ অধিকারের ত্রাণকর্তা হইয়া উঠিয়াছে এবং ভাষার প্রশ্ন লইয়া গভর্নমেন্টকে অমান্য করার জন্য উসকানি দিতেছে। অথচ এই পাকিস্তানই হইতেছে আপনাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মূল ভিত্তি। ... এসব পঞ্চম বাহিনী সম্পর্কে আপনাদের সাবধান করিয়া দিতেছি।’

যে ভঙ্গিতে ও যে ভাষায় পাকিস্তানের ওই দুই ‘কায়েদ’ কথা বলছিলেন, সে রকম কায়দা ও ভাষাভঙ্গি সেদিনকার পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল। অথচ ওই দুই ‘কায়েদ’ সেই অগ্রহণীয় কায়দা ও ভাষাভঙ্গি দিয়েই বাঙালি জাতিকে ভজাতে চাইলেন। এতে ফলল উল্টো ফল। যদি বলি, বাঙালিচিত্তে সেদিন থেকেই দ্বিজাতিতত্ত্ববিরোধী ভাবনা স্পষ্ট দল মেলতে শুরু করল, তা হলে নিশ্চয়ই ভুল বলা হবে না। বাঙালি জাতি মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আপন মাতৃভূমিকে অপরাষ্ট্র পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও সূচনা ঘটাল সেদিন থেকেই।

তবে মানতেই হবে, সমগ্র জাতি তখনো অভিন্ন চেতনায় জাগ্রত হয়ে ওঠেনি। বিশেষ করে জিন্নাহ ও লিয়াকত যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন তো বটেই। জিন্নাহ ও লিয়াকতের বাংলা ভাষাবিরোধী বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবেই যদিও সচেতন ও শিক্ষিত বাঙালির চিত্ত জাগরণ ঘটিয়ে ফেলেছিল, জাগ্রতচিত্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবী ওই দুই নেতার বক্তব্য প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও মোহমুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন যদিও, তবু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সাধারণের ভাবনা কিন্তু ততদূর অগ্রসর হতে পারেনি, তখনো জিন্নাহ-লিয়াকতের নেতৃত্ব প্রত্যাখ্যান করার মতো মোহমুক্তি ঘটেনি সব বাঙালির।

১৯৪৮ সালে মারা গেলেন জিন্নাহ আর ১৯৫০ সালে নিহত হলেন লিয়াকত আলী। লিয়াকত আলীর মৃত্যুর বছর দেড়েক পরই এলো বায়ান্নর সেই রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারি। সেই ফেব্রুয়ারির চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতেই একাত্তরের দুনিয়া কাঁপানো সংগ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাঙালি পাকিস্তানের খাঁচা ভেঙে ফেলল, প্রতিষ্ঠা করল স্বাধীন ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।

এবার নিজের কথা বলি, ১৯৪৮ সালে আমি নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তাম। নেত্রকোনায় তখন কোনো কলেজ ছিল না। মাত্র চারটি হাই স্কুল ছিল। হঠাৎ একদিন-সম্ভবত মার্চ মাস হবে সময়টা, ‘মে উই কাম ইন স্যার?’ বলে নাইন-টেনের ছাত্ররা স্যারের অনুমতি ছাড়াই আমাদের ক্লাসরুমে ঢোকে এবং তারা বলতে লাগল, ‘আমাদের মাতৃভাষা বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের কথিত জাতির পিতা জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে বলেছেন-উর্দুই হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সবাই এর বিরোধিতা করেছেন, আমরা কিছুতেই সেটা মেনে নেব না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, সেই মাতৃভাষাই রাষ্ট্রভাষা হতে হবে। তারপর পুলিশের কিছু জুলুম হয়েছে, আমরা এর প্রতিবাদে রাস্তায় বেরিয়ে আসব।’ আমরা তখন তাদের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্য মানি না, পুলিশের জুলুম বন্ধ কর’-এরকম আরও স্লোগান দিয়ে আমরা সারা শহর ঘুরলাম।

পরদিন ভোরে নেত্রকোনা শহরের মুক্তাঙ্গনের মাঠে এক সভায় যোগ দিয়েছিলাম। আমি তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র, আমার তখন তেমন কোনো ভূমিকা নেই। নেত্রকোনায় তখন কলেজ নেই, ক্লাস নাইন-টেনের ছাত্ররা বিভিন্ন বক্তৃতা দিয়ে বোঝাতে লাগল, জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের জাতির পিতা হলেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আজকে আমাদের ভাষার ওপর তিনি আঘাত করেছেন।

আমরা কিছুতেই এটা মেনে নেব না। স্বয়ং জিন্নাহ সাহেব বললেও আমরা সেটা মেনে নিতে পারি না-এসব কথা সেদিন ওই সভায় হয়েছিল। সে সময় জিন্নাহ সাহেবের কথার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারে না পাকিস্তানে-এমনটা ১৯৪৮ সালের আগে কেউই ভাবতে পারেনি। যা-ই হোক, সেই দিন যে আমি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পেরেছিলাম-এই ভাবনাটিই ছিল প্রধান আমার কাছে। তারপর আমাকে নেত্রকোনা শহর ছাড়তে হয়, বলা চলে যেতে বাধ্য হই বিভিন্ন কারণে।

আর এখন শেষ বয়সে এসে বলতে চাই, ধর্ম মানুষ পরিবর্তন করতে পারে; কিন্তু ভাষার মধ্য দিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করার পর একটা মানুষের পরিচয় হয়ে ওঠে তার ভাষা। আমাদের গর্ভধারিণী মায়ের সমান আমরা মাতৃভূমিকে দেখি। যে ভূমিতে আমি জন্ম নিয়েছি সে হলো আমার মা। আর যে ভাষায় আমি মানুষ হয়েছি, আমার চিন্তা-চেতনা প্রকাশ করি সেটি আমার মাতৃভাষা।

গর্ভধারিণী মায়ের সম্পর্কে আমাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হয় যেমন তেমনি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হয় মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি; কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মাতৃভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ যে নেই তার অনেক কারণ রয়েছে। একটা বিষয় লক্ষ্য করুন-আমাদের দেশের উচ্চশ্রেণির মানুষ যারা, তারা দেশের ঐতিহ্যকে এড়িয়ে বিদেশের ঐতিহ্যকে লালন করে। তারা বিদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে দেশের সংস্কৃতিকে ভুলে যায়।

আজও ষড়যন্ত্রকারী প্রতিক্রিয়াশীল বিভিন্ন গোষ্ঠী যেন সক্রিয় হয়ে রয়েছে এদেশে। তারা আজও বাংলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। আর এক শ্রেণির অসচেতন মানুষেরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পাঠিয়ে তৃপ্তি পায়। তারা ভাবে না যে, ভাষার জন্য সারা বাংলা একদা কেঁপেছিল, প্রাণ দিয়েছিল আমাদের ভাইয়েরা, গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মতো খেটে মানুষেরাও পিছিয়ে ছিল না সেই আন্দোলনে, একাত্ম হয়েছিল আমাদের মিছিলে-তাদের বিবেকের কাছে এ প্রশ্ন-ইংরেজি ভাষায় শিক্ষায় কতটুকু উন্নত হবে আপনার সন্তানের জীবন? যে নিজের ভাষা জানে না সে কী করবে? যার নিজের সংস্কৃতি জানা থাকবে না সে কতটা আপনাকে ভালোবাসবে? যে মানুষ তার ভাষার কীর্তিমানদের জানে না, সে নিজেকে গড়বে কী করে? আমি মোটেই অন্য ভাষার বিরুদ্ধে না। তবে নিজের ভাষাকে তো সম্মান করতে হবে, জানতে হবে সংস্কৃতির পুরোটাই।

তরুণদের বলি, আমাদের সবকিছুই মাতৃভাষায় প্রকাশ করতে হবে। এই প্রকাশ করার ব্যাপারটি আপনা-আপনি হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। এর জন্য আমি বলব, এমন একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে-যারা মাতৃভাষা ব্যবহার করে না তাদের বিরুদ্ধে সেই আন্দোলন। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে-শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বিনোদন, বাজার থেকে পথ-সবখানে এই চর্চায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এরকম একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাষার চর্চায় আমাদের ফিরতে হবে।

যতীন সরকার: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ