Views Bangladesh Logo

একবার নিজেকে প্রশ্ন করুন, প্লিজ

Rased Mehedi

রাশেদ মেহেদী

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাঙচুরের ঘটনা অনেক পুরোনো। সেই নব্বইয়ের দশক থেকেই আমরা দেখছি, কোনো আন্দোলন, দাবি-দাওয়া, হরতাল-অবরোধ, ধর্মঘট সবকিছুতেই যানবাহন, স্থাপনা ভাঙচুর ঘটেছে বার বার। গত তিন দশকে বিভিন্ন সময়ে যাত্রবাহী চলন্ত বাস-ট্রেনে আগুনও দেখেছি আমরা। অনেক মানুষ হতাহত হয়েছেন। ভাঙচুরমুক্ত একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা গড়তে পারিনি।

এখনো সেই ভাঙচুর, আগুনের সংস্কৃতিই আমরা আবারও দেখছি। মনে রাখতে হবে ধ্বংসাত্মক চিন্তা-ভাবনা ধ্বংসযজ্ঞেরই ধারাবাহিকতার জন্ম দেয়। অথচ আমাদের মুখে কিন্তু সবসময়ই সুবচন থাকে। আমরা আমাদের বক্তৃতা, বিবৃতিতে সবসময়ই গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পরমতসহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচারের কথা বলি; কিন্তু বাস্তবে আমাদের আচরণে, কর্মকাণ্ডে প্রতিশোধপরায়ণতা, অসহিষ্ণুতা, ধ্বংযজ্ঞই বার বার প্রকাশ পাচ্ছে। এর শেষ কোথায়?

প্রকৃতপক্ষে, যতভাবেই বলি না কেন, আমরা স্বাধীনতার গত ৫৩ বছরে সত্যিকারের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে ন্যায়বিচারের কথা বলি, নিজের ঘরে আগুন লাগলে ধ্বংসজ্ঞের বিরুদ্ধে বলি। আবার নিজের স্বার্থের পক্ষে গেলে ন্যায়েবিচারকে উহ্য রাখি, অন্যের জানমাল আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করি। আমরা কখনো নিজেকে প্রশ্ন করে দেখিনা, আমি যা করছি তা ঠিক করছি কি না?

আমাদের দেশে যারা যখনই ক্ষমতায় গেছে তাদের মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করার ভয়ংকর প্রবণতা দেখা গেছে। বিষয়টি এমন যেন, ক্ষমতার অপব্যবহার না করলে যেন নিজেকে ক্ষমতাবান মনে হয় না। অথচ সত্য হচ্ছে এটাই, তিনি সত্যিকারের ক্ষমতাবান তিনিই যার প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও প্রতিশোধ নেন না। তিনিই প্রকৃত নেতা, যিনি অন্যের ভুলকে ক্ষমা করেন এবং নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চান। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আমাদের দেশের রাজনীতিতে এই চর্চাটিই নেই। সমাজে কিছুটা চর্চা থাকলেও প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণে সমাজেও এর প্রবল নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অসহিষ্ণুতা আর ধ্বংসের বীজই শুধু বপন করে যাই। এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি বার বার আমাদের সমস্ত গৌরবময় অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। আমাদের পেছনে ঠেলে দিয়েছে। আমরা যতবার এগিয়েছি, বড় কোনো অর্জন করেছি, ধ্বংসাত্মক রাজনীতির জন্য আবারও তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে গেছি। আমরা কি ক্রমাগত পিছিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক চর্চার ভেতরেই আবদ্ধ থাকব?

অথচ স্বপ্ন ছিল পরিবর্তনের। রাজনৈতিকচর্চা, সমাজনীতি, কূটনীতি, সবকিছুতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। আমাদের সন্তান আধুনিক বিশ্বের উপযোগী হয়ে শিক্ষিত হবে। প্রজ্ঞায়, মেধায় বিশ্বের যে কোনো দেশের তরুণদের সঙ্গে সমান প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে। আমরা শুধু বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক পাঠাব না, দক্ষ ব্যবস্থাপক পাঠাব। আমাদের জাতীয় নেতা, কর্মকর্তারা অনেকবার বিদেশ যান। ইউরোপ-আমেরিকায় যান। অন্যদেশে কীভাবে সবকিছু সুন্দর শৃঙ্খলার সঙ্গে আছে, সেটা নিজের চোখে দেখেন।

দোহা কিংবা দুবাই এয়ারপোর্ট দিয়ে যখন পার হন, তখন দেখেন সেখানে বাংলাদেশি নাগরিকরা পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেন, অথচ আমাদের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা এমনকি নেপালের নাগরিকরা সেখানে নিরাপত্তা, গ্রাহকসেবা, লাউঞ্জসেবা সবকিছুতে ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। এ অবস্থা কি আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব, নীতি নির্ধারককে লজ্জিত করে না? যদি করত, তাহলে তারা কথায়, আচরণে বার বার ধ্বংসাত্মক রাজনীতিকে উৎসাহিত করার বদলে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কি করে দক্ষতায় শ্রমিক থেকে ব্যবস্থাপক করা যায়, সেই চিন্তা করতেন। সেই চিন্তা আমরা জাতীয় নেতৃত্বের কারও মধ্যেই দেখি না।

‘আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না’- এই উপদেশ আমরা একে অপরকে দিই; কিন্তু নিজেরাই মানি না। বার বার এটাই দেখেছি, আগের ক্ষমতাসীনদের করুণ পরিণতি থেকে নতুন ক্ষমতাসীনরা শিক্ষা নেয় না। যে কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার, দম্ভোক্তি, আত্মঅহমিকা আর ধ্বংসযজ্ঞের রাজনৈতিত চর্চা বার বার ফিরে আসে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক চর্চার মূল লক্ষ্যবস্তুই যেন সবাই মিলে কেমন করে খারাপ থাকা যায়, তার ব্যবস্থা করা। সবাই মিলে কেমনে ভালো থাকব, সেই চিন্তা আমরা কখনো করি না। অবশ্য প্রশ্ন উঠতে পারে, সবাই মিলে ভালো থাকা সম্ভব কি না?

শহীদ পরিবারের সঙ্গে হত্যাকারীরা একসঙ্গে ভালো থাকতে পারে কি না? অবশ্যই না। হত্যাকারীদের বিচার হবে, বিচারের রায়ে তাদের যেন সাজা নিশ্চিত হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে; কিন্তু যদি হত্যাকারীদের বিচার আদালতে না হয়ে, তাদের এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের সম্পদ ধ্বংস করা হয়, তাহলে সেই প্রতিহিংসার রাজনীতিকেই নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সামান্য সত্যটুকু বোঝার মতো প্রজ্ঞা কি আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের নেই?

বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ। সাধারণ মানুষ খুবই সহজ সরল, শান্তিপ্রিয়। কেউ কারও ক্ষতি করার চিন্তা সাধারণ মানুষ কখনো করে না। এমনকি শত্রুও অভুক্ত থাকলে তাকে খাবার দেওয়ার রীতি আমাদের সমাজে। ছোটবেলা থেকে সেটাই দেখেছি; কিন্তু সেই সম্প্রীতির বন্ধন, সেই সহজ-সরল জীবনকে বার বার জটিল করে তুলছেন আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ভুল তথ্য, মিথ্যা তথ্য, অপপ্রচার কিংবা জুজুর ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে, অনেকটা সম্মোহিত করে ক্ষমতার রাজনীতির হীন স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের প্রতিহিংসার রাজনীতির বলি হতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষকে।
সংস্কার, ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য ইতিবাচক মানসিকতা দরকার। তার জন্য অপপ্রচার, বিভ্রান্তি আর জুজুর ভয়ের রাজনৈতিকচর্চা বন্ধ করতে হবে।

যারাই জাতীয় নেতৃত্বে থাকেন, তাদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে নিজের কথায়, আচরণে এবং কর্মকাণ্ডে। জাতীয় নেতৃত্বকে করজোরে অনুরোধ, একবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, আপনি যা বলছেন, তা কি সত্য বলছেন? আপনার বক্তব্য কি প্রতিহিংসার রাজনীতিকে উসকে দিচ্ছে না? নিজের সঙ্গে নিজের প্রশ্নের লড়াইয়ে যদি নিজেকে সৎ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলেই আপনি দেশের জন্যও ভালো কিছু গড়তে পারবেন, ধ্বংসযজ্ঞের চিন্তা তখন আপনার মাথা থেকে মুছে যাবে। নিজেকে প্রশ্ন করার মতো সেই শক্তি যত তাড়াতাড়ি জাতীয় নেতৃত্বে অর্জন করতে পারবেন, দেশ ও জাতির মঙ্গল তত তাড়াতাড়ি নিশ্চিত হবে।

রাশেদ মেহেদী: সম্পাদক, ভিউজ বাংলাদেশ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ