ইরানের তেল স্থাপনায় হামলা হলে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে
২৬ অক্টোবর, ২০২৪; প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার উড়ে গিয়ে ইসরায়েলের শতাধিক বিমান তিন দফায় ইরানের রাজধানী তেহরান ও পশ্চিমাঞ্চলীয় দুটি প্রদেশের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। এই হামলা পহেলা অক্টোবরে ইরানি হামলার প্রতিশোধ। হামলার প্রথম দফায় সিরিয়া, ইরাক ও ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। পরবর্তী দুটি দফায় বিনা প্রতিরোধে ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় আক্রমণ চালানো হয়। এই হামলায় ইসরায়েল শুধু ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং দ্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারখানাকে টার্গেট করেছে, আমেরিকার নিষেধ থাকায় ইরানের পারমাণবিক ও অর্থনৈতিক স্থাপনায় আক্রমণ করেনি। ইসরায়েল তাদের এই হামলার নাম দিয়েছে ‘অনুতাপের দিন’।
পহেলা অক্টোবর ইরান ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে প্রায় দুইশ ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল; ইসরায়েলের বক্তব্য মোতাবেক দু-একটি ছাড়া প্রায় সব ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ইরান বলছে তাদের নিক্ষিপ্ত ৯০ শতাংশ ক্ষেপনাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে। ইরানের কথা কিছুটা সত্য; সত্য না হলে ইসরায়েল তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নতুন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘থাড’ যোগ করত না। শত্রুপক্ষের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট বা যুদ্ধবিমান ধ্বংসের জন্য ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’ অভেদ্য হিসেবে বিবেচ্য ছিল। আয়রন ডোম ছাড়াও ইসরায়েল বহু আগে থেকেই আমেরিকার পেট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে আসছে; কিন্তু তা পর্যাপ্ত বিবেচিত না হওয়ায় ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্রের সংযোজন করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল। এর মধ্যে আবার ২৬ অক্টোবরের হামলায় ইরানের বিদ্যমান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন সিস্টেম বিকল করে দেয়া হয়েছে মর্মে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে ইরান বলছে তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসন প্রতিরোধ করতে পেরেছে; কিন্তু ইরানের বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়; কারণ ইসরায়েলের একটি বিমানও ইরান ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়নি। ইরান তাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছে বলেই সম্ভবত তাদের সামরিক বাজেট তিন গুণ বাড়নোর পদক্ষেপ নিয়েছে; কিন্তু এই বিশাল সামরিক বাজেট দিয়েও ইসরায়েলকে প্রতিরোধ করা যাবে বলে মনে হয় না। কারণ ইসরায়েল নিজেরা যে অস্ত্র তৈরি করে তা অনেক সময় আমেরিকার অস্ত্রের চেয়েও বিধ্বংসী। ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে ইসরায়েল রাশিয়ার টি-৭২ ট্যাংক তাদের নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যেভাবে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল তা দেখে রাশিয়া এবং আমেরিকা বিস্মিত। ইরান আবার আক্রমণ চালালে ইসরায়েল এমন সর্বনাশা অস্ত্র ব্যবহার করবে, যা তারা আগে কখনো ব্যবহার করেনি- কথাটি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর।
ইসরায়েলের নিজস্ব শক্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে আমেরিকা ও ইউরোপের শক্তি। ফ্রান্স মাঝে মাঝে অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়; কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর পাল্টা হুমকির পর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চুপ হয়ে যান। আমেরিকা এবং ইউরোপ শুধু অস্ত্র সরবরাহ করে না, ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য তাদের যুদ্ধজাহাজ সার্বক্ষণিক সাগরে টহল দিয়ে বেড়ায়। এই সকল যুদ্ধজাহাজ ইরানের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপনাস্ত্র ধ্বংস করে, ইয়েমেনের হুতিদের শায়েস্তা করে। আমেরিকা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে, ইসরায়েলের উপর কাউকে বিজয়ী হতে দেয়া হবে না। এ জন্যই ১৯৭৩ সনের যুদ্ধে পরাজিত মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি; কিন্তু আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়’। আমেরিকার ক্ষমতার পরিবর্তন হয়; কিন্তু ইসরায়েল-নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না।
ইসরায়েলের পক্ষে কে কতটুকু নিবেদিত তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিসের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুসলমানদের ভোট পাওয়ার প্রত্যাশায় ডেমোক্রেট দলের কমলা হ্যারিস মাঝে মাঝে যুদ্ধ বিরতির কথা বলে থাকেন, কিন্তু অসার; মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বিগত এক বছর ধরে একই কথা বলে আসছেন। অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক- ইসরায়েলকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে তার কথাবার্তায় কোনো রাখঢাক নেই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দম্ভোক্তি হচ্ছে তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে হামাস ইসরায়েলকে আক্রমণের সাহসই করত না। এ জন্যই ইসরায়েল ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় কামনা করছে। জো বাইডেন মুখে মুখে যুদ্ধ বিরতির কথা বললেও তিনি চান মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইরানের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ধ্বংস হয়ে যাক।
অবশ্য শুধু আমেরিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তির বিনাশ চায় এবং চায় বলেই জর্ডান ইরানের নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে ইসরায়েলকে রক্ষা করে, মিশর হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিষিদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৮ সনে সম্পাদিত ক্যাম্পডেভিড চুক্তিই মিশরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। ইসরায়েলের আরেক প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া অভ্যন্তরীণ সিভিল ওয়ারে বিধ্বস্ত। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের চাণক্যনীতিতে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য মুসলিম দেশগুলো নিশ্চুপ ও নির্লিপ্ত। তাদের নির্লিপ্ততা দেখে মনে হয়, গাজা, পশ্চিমতীর বা লেবাননে কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না, কোন শিশু মারা যাচ্ছে না, যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার কোনো ঘাটতি নেই।
কয়েক বছর ধরে ইসরায়েল এবং ইরানের ছায়াযুদ্ধ চলছে। ইরানের যে সকল ব্যক্তি ইসরায়েলের জন্য হুমকি প্রতিপন্ন হয় তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের অনেক বিজ্ঞানীকে মোসাদ হত্যা করেছে, হত্যা করেছে ইরানের অভ্যন্তরে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে। শুধু গুপ্ত হত্যা নয়, প্রকাশ্যে বিমান হামলা চালিয়েও ইরানের লোকদের হত্যা করছে ইসরায়েল। চলতি বছরের পহেলা এপ্রিলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলায় ইরানের সাত কর্মকর্তা নিহত হয়। ইরান তিনশত ক্ষেপণাস্ত্র ও দ্রোন ছুড়ে পাল্টা আক্রমণ করে ১৩ এপ্রিল। ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য আগত ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়ে ইরানের মাটিতেই ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন। দুইশত ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান এই হামলার প্রতিশোধ নিয়েছে গত অক্টাবরের ১ তারিখে। ইসরায়েল কিছুদিন অপেক্ষা ২৬ তারিখেই পাল্টা আক্রমণ করল।
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান ফিলিস্তিনিদের অধিকারকে শুধু সমর্থন করছে না, ইসরায়েলকে ধ্বংস করার জন্যও তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবশ্য ইসরায়েলের সর্বশেষ হামলার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির বক্তব্য কিছুটা নমনীয় মনে হচ্ছে। তিনি আগের মতো তাৎক্ষণিক পাল্টা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা না বলেননি। তবে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের হামলার পাল্টা পদক্ষেপ না নেয়ার জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইরানকে মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকার নির্দেশনা অনুযায়ী ইসরায়েলের এবারের হামলা ছিল সীমিত; তারা ইরানের তেল ও পরমাণু স্থাপনায় হামলা করেনি। মজুত তেল, তেল খনি ও তেল সরবরাহের পাইপলাইনে আক্রমণ হলে বিশ্ব আরেকটি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ত। ইরানের উচিত হবে তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনির পরামর্শ অনুযায়ী ইসরায়েলের হামলাকে ‘অবহেলা বা অতিরঞ্জিত’ না করে পাল্টা হামলার ব্যাপারে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেয়া।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে