বাকশাল: বাস্তবতা ও সম্ভাবনার মৃত্যু
দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়ন করতে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতীয় ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, সংক্ষেপে বাকশাল। দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশাল কথ্যভাষায় এক ও অভিন্ন সত্তায় হাজির হয়েছে বাঙালি-মানসে। লেখা বাহুল্য, যতটা গ্রহণের মানসে তার চেয়ে বর্জনের মানসেই এই একাকার। যতটা শুভার্থে তারচেয়ে বেশি মন্দার্থে। বাঙালি মানসের এই উপরিকাঠামোর খেলা আদিকালের। হারুন-অর-রশিদের ভাষ্যেই জানা যায়, ‘বাকশাল ছিল দ্বিতীয় বিপ্লবের একটি কম্পোনেন্ট বা অংশমাত্র। অন্য কথা, এটি ছিল লক্ষ্য অর্জনের একটি মাধ্যমবিশেষ।’
লেখক একজন খ্যাতিমান শিক্ষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কী ও কেন’ এরকম নামে এই প্রথম একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি লেখা একটি মূল্যায়ন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হলেও এতটা বিস্তৃতভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে কেউ দেখেছে বলে জানা নেই। সেজন্য লেখক-অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদকে ধন্যবাদ। যদিও পাঠক হিসেবে কিছু তথ্য ও বিশ্লেষণের ঘাটতি উপলব্ধি করেছি, এরপরও লেখকের চমৎকার-সরল উপস্থাপন নিন্দাকারীদের মুখে ছাই দেবে, এতে সন্দেহ নেই।
বইটির প্রথম ফ্ল্যাপেই আছে বাকশালের মাধ্যমে ‘জাতীয় ঐক্য অর্জনের মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র-সরকার-সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ, স্বয়ংসম্পূর্ণ, মর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলা অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠাই ছিল দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির মুখ্য উদ্দেশ্য।’
লেখক হারুন-অর-রশিদ ও তার লেখা বই ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কী ও কেন’ এর প্রচ্ছদ
হারুন-অর-রশিদ বইটির মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘বিপ্লব বলতে একটি ব্যবস্থার আমূল বা মৌলিক পরিবর্তন বোঝায়। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ বিপ্লব ১৯৭১ বা প্রথম বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত। এর তিন বছর পর দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সার্বিক পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনেন। বঙ্গবন্ধু একে সিস্টেম চেইঞ্জ বা দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করেন। গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পূর্বেই জাতির পিতা সপরিবারে শহীদ হন। বাকশাল ব্যবস্থার বিরোধী ও সমালোচকদের মুখোশ উন্মোচন করে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি স্বাধীনতাবিরোধী ও কায়েমি স্বার্থের মূলে কুঠারাঘাত হানে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীকে তারা Constitutional Coup এবং গৃহীত পদক্ষেপকে ক্ষমতা চিরস্থায়ীকরণে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বা বাকশাল বলে আখ্যায়িত করে। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে বাকশালী ব্যবস্থা হিসেবে এমনই বিকৃতভাবে অপপ্রচার করা হয়, যাতে মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে সম্পূর্ণ আড়াল করে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং একই সঙ্গে ক্ষমতা দখলকারীদের ক্ষমতাদখলকে জায়েজ আর দেশ ও জাতির চরম স্বার্থবিরোধী, মানবতাবিরোধী ১৫ আগস্টের জঘন্যতম অপরাধ ও নৃশংসতাকে মুখোশ পরিয়ে ঢেকে রাখা যায়।’ লেখক শক্তভাবে জানিয়েছেন, সত্য সত্যই। সত্য অবিনাশী। সত্য চিরভাস্বর ও সমহিমায় উদ্ভাসিত। দ্বিতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য যে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা ছিল না, তা আজ স্পষ্ট।
দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনাগুলো সাতটি অধ্যায়ে বিভক্ত। লেখকের ধারাক্রম রক্ষা করে কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া যাক।
প্রথম বিপ্লব বা ‘বাংলাদেশ বিপ্লব ১৯৭১’ নিয়ে প্রারম্ভিক অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। ঐতিহাসিক তথ্যের আলোকে লেখক প্রাচীন কাল থেকে পরম্পরা টেনে স্বাধীনতার পটভূমি উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারকে এক চরম বৈরী অবস্থায় দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। প্রাকৃতিক বিরূপতার পাশাপাশি দেশীয় কতিপয় রাজনৈতিক অপশক্তির বাংলাদেশ বিরোধী কার্যক্রম, বঙ্গবন্ধু যেটাকে ফ্রি স্টাইল বলেছিলেন এবং বিদেশি বিভিন্ন অপশক্তিগুলোও নানাভাবে স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে চেষ্টারত ছিল। যেটাকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মাটি যেন একটা হটবেড অব ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স হয়ে গেছে।’ এরকম রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করেন।
প্রতিটি অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিপ্লবের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক ইতিপূর্বে আলোচিত ‘পরিপ্রেক্ষিত’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সমালোচকদের বক্তব্য অনুযায়ী ‘পরিস্থিতির’ ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বাকশাল ব্যবস্থাসহ তার দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি গ্রহণ, এরূপ মনে করা কিছুতেই সঠিক নয়। ওই পরিস্থিতি ছিল বঙ্গবন্ধুর নতুন উদ্যোগ গ্রহণের তাৎক্ষণিক বা ইমিডিয়েট কারণ। এর অন্তর্নিহিত কারণ আরও গভীরে প্রোথিত ছিল। তা বুঝতে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিসত্তা বা চরিত্র, জীবন-আদর্শ, রাজনৈতিক জীবন, রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও বিশ্বাস, নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা থাকা চাই। বলা বাহুল্য, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, আমার দেখা নয়াচীন, সবগুলো ভাষণ, আওয়ামী লীগের সকল ঘোষণাপত্র, বাহাত্তরের সংবিধান; এই বিষয়গুলো পাঠ করলে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি-মানসের সুলুক সন্ধান করা যায়।
লেখক হারুন-অর-রশিদ বঙ্গবন্ধুর জীবন-ক্রম ও রাজনৈতিক জীবনাভিধান দেখিয়ে স্পষ্ট করেছেন, বঙ্গবন্ধু ইম্পেশেন্ট ছিলেন না, এডভেনচারিস্টও ছিলেন না; এমনকি কমিউনিস্টও ছিলেন না। বিশ্বাস করতেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে শোষকের যন্ত্র মনে করতেন। বঙ্গবন্ধু স্টেপ বাই স্টেপ মুভ করেছেন। নিজের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগকেও মুভ করিয়েছেন। যে জন্য ১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে পাস হওয়া ঘোষণাপত্রের ৪ ধারায় ‘অর্থনৈতিক আদর্শ (শিল্প)’ শিরোনামায় যুক্ত করা হয়, ‘আওয়ামী লীগের আদর্শ শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শোষণ, বৈষম্য ও দুর্দশার হাত হইতে মুক্তিলাভ করা সম্ভব বলিয়া আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে।’ তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরা যখন ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ নীতিতে চলছেন, বঙ্গবন্ধু তখন লক্ষ্য স্থির করে জনগণকে প্রস্তুত করছেন, যখন যতটুকু প্রস্তুতি দরকার সেইমতো। সমাজ বদলে বঙ্গবন্ধুর ব্লু প্রিন্ট বইতে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ অনেক বিষয়ে আলোচনা করলেও বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি-মানস এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ‘সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থা’ নিয়ে আলোচনার ঘাটতি ছিল। হারুন-অর-রশিদ এই বিষয়টিকে যথার্থই গুরুত্ব দিয়েছেন।
চতুর্থ অধ্যায়ে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। লিখেছেন, ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ছিল অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতির এমন কোনো দিক নেই, যা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।’ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ৪টি কর্মসূচির গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করলেও হারুন-অর-রশিদ প্রশাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোসহ ৫টি যথা দুর্নীতি বন্ধ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিটি কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করলেও, এর সুফলগুলো কীভাবে মানুষ পেতেন এ-নিয়ে আলচনার ঘাটতিটুকু থেকেই গেলো। দ্বিতীয় বিপ্লব ছিল বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত, যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং আইন দিয়ে বাস্তবায়িত একটি স্বপ্ন ও একটি সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা খুবই প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে চতুর্থ সংশোধনীর পরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কতটুকু ইতিবাচক ছিল সেই আলোচনা পাঠকের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় ছিল। যা বইটিতে অনুপস্থিতি।
পঞ্চম অধ্যায়ে বাকশাল অর্থাৎ, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। বাকশাল ছিল জাতীয় ঐক্যের প্ল্যাটফর্ম। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এটি দেখিয়েছেন লেখক। মূলত ১৯৭৩ সালের ১৪ অক্টোবর গঠিত ‘গণ ঐক্যজোটে’র ধারাবাহিকতাতেই ‘ওয়ান পার্টি সিস্টেম’ বাকশাল কায়েম। সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ও আশু সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে প্রধানত ত্রিদলীয় ‘গণ ঐক্যজোট’ গঠিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ৬ জুন গঠিত বাকশাল ছিল সর্বদলীয় তথা জাতীয় ঐক্যের প্রথম ও একমাত্র আহবান এবং একমাত্র রাজনৈতিক পার্টি। চতুর্থ সংশোধনীর পরে ২০ এপ্রিল ৫টি আসনে উপনির্বাচনের কথা জানিয়েছেন। এই নির্বাচনি ব্যবস্থা ও আয়োজন নিয়ে বিশদ আলোচনার ঘাটতি লক্ষ্যণীয়।
একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাকশালের গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হারুন-অর-রশিদ মূল্যবান আলোচনা হাজির করেছেন। কবিতার ব্যাখ্যাতা প্রাবন্ধিক, সংবিধানের ব্যাখ্যাতা আইনজীবী, রাজনৈতিক দলের ঘোষণা ও গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যাতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ একই সঙ্গে গঠনতন্ত্রের স্পিরিটগুলোও তুলে ধরেছেন, যা পাঠে চোখের সামনে ভেসে উঠে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম, অবস্থান ও প্রগতিশীলতা ইত্যাদি। রাষ্ট্রের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের এক অপূর্ব মিলনকেন্দ্র ছিল বাকশাল। গবেষক হারুন-অর-রশিদ বাকশালের সম্ভাব্য ব্যবহারিক দিকগুলো নিয়ে আরও আলোচনা করতে পারতেন। বাকশাল সিস্টেমে আজীবন রাষ্ট্রপতি থাকার কোনো সুযোগ ছিল না, গঠনতন্ত্র না পড়লে এহেন মিথ্যাচার বাঙালির মগজ থেকে কস্মিনকালেও দূর হবে না।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে জেলা গভর্নর ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। লেখকের ব্যাখ্যা মতে- বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে জেলা গভর্নর একটি এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালনার নিয়ম ছিল। নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জেলা প্রশাসন পরিচালনার বিষয়টি মোটেও নতুন ছিল না। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে জেলা প্রশাসন পরিচালনা এবং সব মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরিত করার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। জেলা গভর্নর ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রীভূত, আমলাতান্ত্রিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের স্থলে বিকেন্দ্রীভূত, গণতান্ত্রিক, প্রতিনিধিত্বশীল, জবাবদিহিমূলক, জনকল্যাণ ও উন্নয়নমুখী প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। লেখক শুধু জেলা গভর্নর পর্যায়েই আলোচনা শেষ করেছেন; কিন্তু আমরা চতুর্থ সংশোধনীতে দেখতে পাই, থানা বা আঞ্চলিক এবং ইউনিয়ন/গ্রাম ভিত্তিক সমন্বিত শাসন ব্যবস্থা কায়েমের কথা। এটা ব্যবহারিক পর্বে পৌঁছানোর আগেই ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এজন্যই হয়তো লেখক থানা ও ইউনিয়ন পর্যায় নিয়ে আলোচনা করেননি।
সপ্তম অধ্যায়ে সর্বসাম্প্রতিক সময়কাল, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা নির্মাণ প্রসঙ্গে হারুন-অর-রশিদ লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার দ্বিতীয় স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হয়নি। এমনি অবস্থায় তার সে স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন জ্যেষ্ঠকন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা শুধু বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারীই নন, তার আদর্শেরও উত্তরাধিকারী।’
অধ্যায়ভিত্তিক আলাপে বইটির কিছু সীমাবদ্ধতা কিংবা আমার প্রত্যাশা পূরণ না হবার বিষয় তুলে ধরেছি। এ পর্যায়ে আরও কিছু বিষয়ে আলোচনার অনুপস্থিতির কথা জানাচ্ছি। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর কনটেন্টের আলোকে প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিসভা, জেলা গভর্নর ও প্রশাসন ব্যবস্থাপনা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের শাসনব্যবস্থা, গ্রাম সমবায় নিয়ে আরও বিশদ আলোচনার অনুপস্থিতি রয়েছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পরবর্তী ৪টি ভাষণ ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর আরও কয়েকটি ভাষণ রয়েছে, সেগুলোর প্রসঙ্গ আলোচনায় আসেনি। বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্রের আলোকে বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘এখানে যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। কোনো জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইম্পোর্ট করে এনে কোনো ইজম চলে না। আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে’ এ প্রসঙ্গে আলোচনার ঘাটতি রয়েছে। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর আস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা থাকতে পারত। এমনকি বাকশাল সিস্টেম প্রবর্তনের ফলে কূটনৈতিক সম্পর্কে কী রকম প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল, সেসব আলোচনাও দরকার ছিল বলে মনে করি। এভাবে আলোচনাটিকে বহুকৌণিক দৃষ্টি দিয়ে বিশ্লেষণ করলে মাটিচাপা দিয়ে রাখা ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর বাঙালির মুক্তির দর্শন নতুন প্রজন্মের কাছে নবতর আবেদন নিয়ে উপস্থিত হতে পারে।
বইটির ভূমিকাতেই সমালোচনার জবাব দিয়েছেন লেখক। তারপরেও মনে হয়েছে যে, সমালোচকদের কুৎসা ও মিথ্যাচার এবং তৎকালীন বামপন্থী অর্থাৎ, গণ ঐক্যজোটবিরোধী তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা থাকলে নতুন প্রজন্মের পাঠক লাভবান হতো। দ্বিতীয় অধ্যায়ের অষ্টম তথ্যনির্দেশে নিহত সংসদ সদস্যদের তালিকায় মইনুদ্দিন মিয়াজীর পরিবর্তে নেত্রকোণার আবদুল খালেক হবে। এটি সংশোধনের দাবি রাখে।
একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে, একজন পাঠক হিসেবে আমি বাকশাল সিস্টেম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে উৎসাহ আছে আমার। এই জানা-বোঝার আগ্রহ থেকেই বইটি পড়া এবং পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখা। অধ্যাপক আবু সাইয়িদের সমাজ বদলে বঙ্গবন্ধুর ব্লু প্রিন্ট পড়েও লিখেছিলাম। আবু সাইয়িদ সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ ও লেখক, হারুন-অর-রশিদ পেশায় শিক্ষক ও লেখক। এজন্য দুজনের লেখার ধরনই আলাদা, পাঠের স্বাদেও ভিন্নতাও পাওয়া যায়।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো আবারও পড়লাম। সমালোচনা তো মাঠে-ময়দানে সর্বত্রই পাওয়া যায়; কিন্তু যুতসই সমালোচনা অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক বা সিস্টেম সম্পর্কে সমালোচনার খুব অভাব। নতুন করে জানা হলো চতুর্থ সংশোধনী এবং বাকশালের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে। আমার লেখাটিকে হয়ত গ্রন্থ সমালোচনা বলা যেতে পারে। কোনোওভাবেই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব এবং বাকশাল নিয়ে আলোচনা বলা যাবে না। বইটির পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, বাকশাল সিস্টেম ছিল বাস্তবতা। যার ফলাফল পাওয়ার আগেই জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি সম্ভাবনারও মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।
বাকশাল নিয়ে যেখানে বইয়ের ব্যাপক অপ্রতুলতা, দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা যেখানে একেবারেই অনুপস্থিত এবং বিরোধী আক্রমণ যেখানে বহুমুখী; এরকম পরিস্থিতিতে হারুন-অর-রশিদের ‘বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কী ও কেন’ পাঠকের ক্ষুধা কিছুটা হলেও মেটাবে।
হারুন-অর-রশিদের বইটি ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ হয়েছে।
নুরুল আলম পাঠান মিলন: অনুসন্ধিৎসু পাঠক ও রাজনৈতিক কর্মী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে