শুভ নববর্ষ ১৪৩১
বাঙালির মানস ভুবনে বাংলা নববর্ষ দীপ্ত চেতনায় শাণিত
বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। দেশজুড়ে এ উৎসবের আয়োজন হয় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায়। মানুষের ঢল নামে রাস্তায়। তারা জড়ো হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রাঙ্গণে। বাংলা নববর্ষ উৎসব বাঙালির মানস চেতনার দিগবলয়। বাঙালির মানস ভুবনে বাংলা নববর্ষ দীপ্ত চেতনায় শাণিত। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই উৎসব বাঙালিকে ঐক্যসূত্রে গেঁথে রাখে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলা নববর্ষে ভারত-বাংলাদেশের দুই সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার এপারে-ওপারে দুই দেশের বাঙালি এক হয়ে মিলনমেলার আয়োজন করে। দেশভাগ হয়েছে সাতচল্লিশে। একাত্তরে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ বাংলাদেশ নামে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দুই দেশের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া বিভক্ত করতে পারেনি মিলনমেলার ভালোবাসার টান। এভাবে এ সময়ের বাংলা নববর্ষ উৎসব বাঙালির দিনযাপনকে আত্মিক সূত্রে গেঁথেছে। স্বজনহারা মানুষ মিলিত হয় স্বজনকে দেখার টানে।
বর্তমানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের এটি একটি দিক। এই উৎসব এখন শুধু উৎসবের আনন্দ মাত্র নয়। দূরে চলে যাওয়া স্বজনকে দেখার টান একদিকে যেমন প্রবল, অন্যদিকে চোখের জলও এই টানকে বেদনাঘন করে। অনেক দূর থেকে হেঁটে এসে অনেক সময় দেখা পাওয়া যায় না সেই মানুষটির, যার জন্য সারা বছরের অপেক্ষা ছিল। হয়তো অসুস্থতার কারণে আসা হয় না, কিংবা কোনো জরুরি কাজে আটকে যেতে হয়। কান্না-হাসিতে মিলনমেলা আবেগঘন হয়ে ওঠে। আমরা এই আবেগে এই আয়োজনকে গৌরবের জায়গায় দেখতে চাই। মানুষের আবেগের জায়গা থেকে মানুষকে দিনযাপনের পূর্ণতায় ধরে রাখতে দেখতে চাই। সে জন্য আয়োজকদের অভিনন্দন জানাই।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অনেক আগেই স্থানীয় একটি পত্রিকায় পাকিস্তানের বাঙালি বন্ধুদের কেউ নববর্ষ উদযাপনের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখলেন ‘পাকিস্তানি হুঁশিয়ার’ শিরোনামে। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পর বাংলা নববর্ষ উদযাপন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়; কিন্তু সামরিক শাসন দিয়ে কি একটি জাতির মূল উপড়ে ফেলা যায়?
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ভেতর দিয়ে এ দেশের মানুষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই শুরু আর থামেনি। এর পরবর্তী ঘটনা ‘ছায়ানট সংগীত বিদ্যালয়’র প্রতিষ্ঠা। এই প্রতিষ্ঠানটি ষাটের দশকে বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনা জাগিয়ে তোলায় ব্যাপক সহযোগিতা করে। এদের লক্ষ্য ছিল সাধারণ মানুষকে স্বীয় দেশজ বৈশিষ্ট্যে জীবনঘনিষ্ঠ করে তোলা। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ছায়ানট’। ১৯৬৪ সালে ঢাকা শহরে বাংলা নববর্ষ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে উদযাপিত হয়। ছায়ানটের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল রমনার বটমূলে ভোর ৬টায় নববর্ষের অনুষ্ঠানের সূচনা করা। প্রাদেশিক সরকার এই দিনটিকে ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে। এ অনুষ্ঠানে যে বিপুল জনসমাগম হয়, তা দেখে সে সময়ের কোনো কোনো পত্রিকা বিস্ময় প্রকাশ করে। এ বছরের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ছোট-বড় অসংখ্যা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা নববর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবার পয়লা বৈশাখ উদযাপন নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ এ সন শুধু আমাদের জীবনে একটি উৎসব নয়, আমাদের জাতিসত্তা বিকাশের প্রবল শক্তিও বটে। কেননা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ভেতর দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্তের প্রতিবাদী ধারার সঙ্গে গ্রামীণ সাধারণ মানুষের চেতনার ঐক্যবদ্ধ সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক সংগ্রামে এসেছে তীব্রতা, এসেছে তীক্ষ্ণতা। এসেছে সব মানুষের একই সমান্তরালে অবস্থানের দৃঢ়তা। এভাবেই সংস্কৃতির এই শুদ্ধতা ছোট-বড় ভেদ মুছে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বড় অর্জনের সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এখন এ উৎসব পালিত হয় শহরে, গ্রামে। নানা ধরনের উৎসব অনুষ্ঠানে, খেলাধুলা, মেলা ইত্যাদি আয়োজনের ভেতর দিয়ে। শহরের অসংখ্য ছোট-বড় জায়গায় আয়োজিত হয় অসংখ্য মেলা, যেগুলো দেশীয় পণ্য সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়। এটি নববর্ষ উদযাপনের একটি বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশিভাবে লোকসংগীত, সারি, জারি, ভাটিয়ালি, কবিগান, গম্ভীরা, লালন, হাছনরাজার গান ইত্যাদি আয়োজন বাংলার নিজস্ব স্বকীয়তা।
গত কয়েক বছর ধরে চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছেলেমেয়েরা রাস্তায় আল্পনা করে। নানা ধরনের হাতি, ঘোড়া, বাঘ, পেঁচা, বানর ইত্যাদি তৈরি করে। অসংখ্য মুখোশ বানায় এবং এই সবকিছু নিয়ে এক বর্ণাঢ্য মিছিল শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। সঙ্গে ঢোল বাজে, মাদল বাজে এবং একতারা দোতারা ইত্যাদি নিয়ে ছেলেমেয়েরা বাউলের ঢঙে নেচে বেড়ায়। এই আনন্দঘন পরিবেশের আড়ালে শুধু উৎসবই থাকে না, থাকে সংস্কৃতির প্রতিবাদী চেতনার ফল্গুধারা, যা বিভিন্ন আকারে পশু ও পাখির ভেতর দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির নানা ধরনের উৎসবের দিন থাকে, যেটা সবাই মিলে পালন করে। উৎসব একটি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম দিক। একে কেন্দ্র করে প্রবর্তিত হয় জাতির নাড়ির স্পন্দন-জাতির শেকড়ের সন্ধান এসব উৎসবের ভেতরে মূর্ত হয়ে থাকে। উৎসবের রূপান্তর ঘটে; কিন্তু টিকে তার নির্যাসটুকু- সেই নির্যাস আবার নতুন সময়ে নতুন আদলে ফিরে আসে মানুষের মাঝে।
উৎসব মানুষের মহামিলনকে মূর্ত করে দেয় মানবিকতার ছোঁয়ায়। উৎসব শুধুই আনুষ্ঠানিকতা নয়, উৎসব আবেগের, উৎসব পরিচয়ের। বাঙালির জীবনে উৎসব শুধু সামাজিকতা কিংবা আনুষ্ঠনিকতা নয়। এখানে কোনো উৎসব শোক এবং শক্তির মিলনক্ষেত্র, কোনো কোনো উৎসব অসাম্প্রদায়িক মানবপ্রীতির নিদর্শন। অন্যদিকে এসব উৎসবের বৈচিত্র্য, বিশিষ্টতা এবং এ নান্দনিক মাধুর্য বাঙালিকে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসব বিষয়ে ‘উৎসবের দিন’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেই দিন। যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না- যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখ-দঃখ দ্বারা ক্ষুব্ধ করি, সেদিন না- যেদিন প্রাকৃতিক নিয়ম পরম্পরার হস্তে আপনাদিগকে ক্রীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো- সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি না- সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট- সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না- সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না- সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘর ধ্বনি শোনা যায়; কিন্তু সংগীত শোনা যায় না। প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী- কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’
উৎসবকে নিজে রবীন্দ্রনাথের এই মহৎ ব্যাখ্যার উদাহরণ বাংলা নববর্ষ। বাঙালির আত্মশক্তির উৎসব। মানুষ্যত্বের জাগরণের উৎসব। গ্রামীণ অর্থনীতি হালখাতার উৎসব। মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। ১৪৩১ বঙ্গাব্দের নববর্ষ বাঙালির জীবনে শুভ বার্তা বয়ে আনুক, যেন এই জাতি মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করে মহৎ হয়।
লেখক: কথাশিল্পী ও সভাপতি, বাংলা একাডেমি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে