Views Bangladesh Logo

বাংলা একাডেমি পুরস্কার যখন তিরস্কার হয়ে জাতির লজ্জার ইতিহাস হয়ে ওঠে

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

বাংলা একাডেমির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতি-রাষ্ট্র গড়ে ওঠার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকেই আমাদের জাতিসত্তা ও মাতৃভাষার অধিকারের ওপর আক্রমণ আসতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে। সেই অধিকার আদায়ের লড়াই রূপ নেয় ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে কেবল বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা অর্জনের লড়াই ছিল তা না, ছিল আমাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষার লড়াই। যার মধ্য দিয়ে মূলত একটি অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্র বিকাশের সূচনা ঘটে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে আসে ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচন। পূর্ব বাংলার তৎকালীন তিন মহান নেতা: এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এক হয়ে তখন গড়ে তোলেন রাজনৈতিক মোর্চা: ‘যুক্তফ্রন্ট’। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশ করে যা আজও স্মরণীয়; আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে যার গুরুত্ব অপরিসীম। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১১ দফায়ও এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ২১ দফার ১৬নং ধারায় প্রথম বলা হয়, ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা, উন্নয়ন, প্রচার এবং প্রসারের জন্য একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার কথা’। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে ‘দি বেঙ্গলি একাডেমি অ্যাক্ট ১৯৫৭’ পাস করে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৭ মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ‘দি বাংলা একাডেমি অর্ডার, ১৯৭২’ জারির মাধ্যমে পূর্ববর্তী ‘দি বেঙ্গলি একাডেমি’ ‘বাংলা একাডেমি’র রূপ নেয়, অধুনা যা বানান সংশোধন করে হয়েছে- ‘বাংলা একাডেমি’।

বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণে-প্রকাশে-বিকাশে-গবেষণায় বাংলা একাডেমির ভূমিকা শুধু মননের প্রতীক বললে ভুল হবে, বাংলা একাডেমি মূলত আমাদের লড়াই-সংগ্রামের প্রতীক। এই বাংলা একাডেমির সভাপতি পদ অলঙ্করণ করেছেন আমাদের অগ্রগণ্য কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী-চিন্তাবিদগণ। মহাপরিচালকের পদেও ছিলেন আমাদের সবচেয়ে মেধাবী, শ্রদ্ধেয় গুণীজন। সাম্মানিক ফেলোরাও আমাদের দেশের গুণী, পণ্ডিতব্যক্তি, বিশিষ্টজন। সব মিলিয়ে বাংলা একাডেমির প্রতি আমাদের আলাদা এক ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আছে। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির যতটুকু গৌরব, তার অনেকখানিরই ধারক-বাহক বাংলা একাডেমি। এবার সেই গৌরব ধুলিসাৎ হয়ে যেতে বসেছে।

ঘটনার সূত্রপাত বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪ ঘিরে। বাংলাদেশের বর্তমান শিল্প-সাহিত্যের যারা খোঁজ-খবর রাখেন তাদের নিশ্চয়ই জানতে বাকি নেই- দুদিন আগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২৪ ঘোষণা করা হয়েছে এবং দুদিনের মাথায় তা স্থগিত করা হয়েছে। এরকম লজ্জাজনক ইতিহাস বাংলা একাডেমির ৭০ বছরের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি।

পুরস্কার ঘোষণা করে তা স্থগিত করা তিরস্কারের শামিল। এরকম ঘটনা গ্রামগঞ্জেও ঘটতে পারে না। আর এরকমই এক ঘটনা ঘটল জাতির সবচেয়ে সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে। গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০২৪ কারা পাচ্ছেন তাদের নাম ঘোষণা করে বাংলা একাডেমি। পুরস্কারের জন্য এবার যাদের মনোনীত করা হয়েছিল, তারা হলেন কবিতায় মাসুদ খান, কথাসাহিত্যে সেলিম মোরশেদ, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ-গদ্যে সলিমুল্লাহ খান, শিশুসাহিত্যে ফারুক নওয়াজ, অনুবাদে জি এইচ হাবীব, গবেষণায় মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞানে রেজাউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ হাননান এবং ফোকলোরে সৈয়দ জামিল আহমেদ।

মনোনীত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। অনেকে সমালোচনা করেন, মনোনীত ব্যক্তিদের মধ্যে একজনও নারী নেই কেন? বাংলাদেশে কি কোনো নারী কবি-সাহিত্যিক নেই? দ্বিতীয় সমালোচনাটি সবচেয়ে তীব্র- মনোনীত একাধিক ব্যক্তির বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগ ওঠে।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে সবসময়ই কিছু না কিছু বিতর্ক ওঠে। পুরস্কারপ্রাপ্ত অনেকেই সমালোচনার শিকার হন। গত ৩০ বছর ধরেই প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত হচ্ছে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেতে হলে যে ফেলো-কমিটি-মহাসচিব-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তির নিকট ধর্না দিতে হয় তা খোলাখুলিই সবাই জানেন।

সাধারণত বাংলা একাডেমির ফেলোদের মধ্য থেকেই একেক বছর ২০-৩০ জনকে নিয়ে একটা নির্বাচক কমিটি বানানো হয়। এই নির্বাচকমণ্ডলীর কাজ হচ্ছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত একজন করে লেখক-কবি-গবেষকসহ অন্যান্য ক্যাটাগরির লেখকদের নাম প্রস্তাব করা। এরপর বাংলা একাডেমির ডিজি মহোদয় নিজের পছন্দের লোকজন নিয়ে একটা কমিটি বানান। তারাই আসলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন, এবার কাকে তারা পুরস্কারটা দেবেন। এ পর্যায়ে নিয়মটা হলো, নির্বাচকরা যাদের নাম পাঠিয়েছেন, ডিজি সাহেবের এই কমিটিকে তাদের মধ্য থেকেই নামগুলো চূড়ান্ত করতে হবে। তারা নতুন কোনো নাম ঢোকাতে পারবেন না।

মোটামুটি এই প্রক্রিয়ায় যদি পুরস্কার দেয়া হয় তাহলে এই পুরস্কার নিয়ে গৌরবের কিছু নেই। অনেকে গর্ববোধ করেনও না। তাও কেউ কেউ এ নিয়ে লাফায় এবং কেউ কেউ মাতম তোলে। বিগত বছরগুলোতে বাংলা একাডেমি পুরস্কার একটা হাস্যকর বিষয় হয়েই দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত কবি-সাহিত্যক-গবেষকের চেয়ে রাজনৈতিক দলের পোষা নিম্নমানের কবি-সাহিত্যিকরাই এ পুরস্কারটির জন্য বেশি লালায়িত বলে প্রকৃত কবি-সাহিত্যিকরা পুরস্কারটি পেয়ে গর্ববোধ করার বদলে লজ্জাবোধ করেন।

গণঅভ্যুত্থানের পর, এবার যখন রাষ্ট্রের অনেক কিছু সংস্কার হচ্ছে, তাই আশা করা গিয়েছিল এবার অন্তত বাংলা একাডেমির পুরস্কার নিয়ে কোনো বিতর্কের জন্ম হবে না। আর এবারই হলো স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি বিতর্ক। ব্যাপারটা শুধু বিতর্কে সীমাবদ্ধ থাকলে সহনশীল হতো, এ নিয়ে রীতিমতো মব-জাস্টিস শুরু হয়েছে। প্রতিবাদের নামে অনেকে বাংলা একাডেমি ঘেরাও করতে চাচ্ছে, মহাপরিচালকের অপসারণ চাচ্ছে, বাংলা একাডেমিতে কর্মরত অনেকের চাকরি থেকে অব্যাহতি চাচ্ছে।

বাংলা একাডেমির আমূল সংস্কার, ফ্যাসিবাদের অপসারণ ও পুরস্কার কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে রোববার (২৬ জানুয়ারি) দুপুরে বাংলা একাডেমি ঘেরাও করেছে বিক্ষুব্ধ লেখক-সমাজ এবং জাতীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নেতারা। তাদের দাবি, অবিলম্বে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার বাতিল ও এই পুরস্কার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

বিক্ষোভ কর্মসূচিতে কবি শামস মুসা বলেন, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, সংস্কৃতিই সার্বভৌমত্ব। যদি এর সঙ্গে খেলতামাশা করেন, প্রহসনের খেলা খেলেন, আমরা অবশ্যই সেটি শক্ত হাতে প্রতিহত করব। যেভাবে আমরা স্বৈরাচারের দোসরদের প্রতিহত করেছিলাম।

সমালোচনার তীর উঠেছে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজমের দিকে এবং সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর দিকে। এ রকম পরিস্থিতি সংস্কৃতি উপদেষ্টা তার ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য ঘোষিত নামের তালিকা স্থগিত করা হয়েছে। পাশাপাশি এটাও বলা প্রয়োজন, যে আজব নীতিমালা এই ধরনের উদ্ভট এবং কোটারি পুরস্কারের সুযোগ করে দেয়, সেগুলা দ্রুত রিভিউ করা আমাদের প্রথম কাজ। পাশাপাশি বাংলা একাডেমি কীভাবে পরিচালিত হবে, কোন সব নীতিতে চলবে- এসব কিছুই দেখতে হবে। একাডেমির আমূল সংস্কারের দিকে আমরা যাব এখন। দেশের সংস্কার হবে, বাংলা একাডেমির সংস্কার কেন নয়?’

প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় সংস্কৃতি উপদেষ্টা তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমাধান করতে পারেন কি না? এটা তো একটা প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত। আর বাংলা একাডেমির যদি সংস্কার করতেই হয়, পুরস্কারের আগে করলেন না কেন? গণঅভ্যুত্থান হয়েছে পাঁচ মাস হয়, এর মধ্যে তারা স্বৈরাচারের দোসরদের চিহ্নিত করতে পারেননি? পুরস্কার ঘোষণার পর কেন তাদের নাজেহাল করা হচ্ছে? এটা তো সামাজিকভাবে অত্যন্ত অপমানজনক একটা বিষয়। আর এটা কেন মব-লিনচিংয়ের মাধ্যমে করতে হলো?

পুরস্কারের পূর্বঘোষিত নামের তালিকা স্থগিত করে অনধিক তিন কর্মদিবসের মধ্যে পুনর্বিবেচনার পর তালিকা পুনঃপ্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি। অভিযুক্তদের হয়তো নামের তালিকা থেকে বাদ দিবে কিন্তু এটা কি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য? তাদের স্থানে কার নামই-বা যুক্ত করবে? নতুন তালিকাভুক্ত নামের পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কি এতে খুশি হতে পারবেন? এবার হয়তো কোনো নারী লেখকও অন্তর্ভুক্ত হবেন, তার জন্যও কি এটা সম্মানের বিষয় হবে? অনেক প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর কমই পাওয়া যাবে। যা হবে তা হলো সমালোচনা চাপা দেয়ার জন্য শাক দিয়ে মাছ ঢাকা হবে। কিন্তু তারপর যদি আবারও কারো নাম নিয়ে সমালোচনা ওঠে, মব জাস্টিস শুরু হয় তাহলে কি বাংলা একাডেমি আবারও পুরস্কার স্থগিত করবে!

যাই হোক আর না হোক, এবার এই পুরস্কার নিয়ে তিরস্কারের ঘটনা আমাদের জাতির জন্য দীর্ঘদিনের জন্যই লজ্জার ইতিহাস হয়ে থাকবে।

কামরুল আহসান: কথাশিল্পী ও সাংবাদিক





মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ