স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ছিল একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়। বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য জরুরি ছিল একটি উদার ও কার্যকর পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের তাগিদ নিয়ে যে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন, কালক্রমে গত ৫৪ বছরে তা নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে আজকের এই ব্যবস্থায় এসেছে।
গত ৫৪ বছরে কীভাবে বদলেছে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ধারা- সেটি জানতে হলে ইতিহাসের কয়েকটি অধ্যায়ের পরিক্রমণ অত্যন্ত জরুরি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগ (১৯৭২-১৯৭৫): স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির পুনর্গঠন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়”- এই নীতিকে আদর্শ করে গড়ে তোলেন অসম্মিলিত আন্দোলন (নন-অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট)-ভিত্তিক কৌশল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলেও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গেও কূটনৈতিক সেতুবন্ধন রচনার চেষ্টা চলেছে।
১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ এবং ১৯৭৫ সালে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-তে যোগদান বাংলাদেশের বহুমুখী নীতিরই প্রতিফলন। তবে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর পররাষ্ট্রনীতি সাময়িকভাবে গতিহীন হয়ে পড়ে।
সামরিক শাসন ও নতুন দিশা (১৯৭৫-১৯৯০):
জেনারেল জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আসে উল্লেখযোগ্য মোড়। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ে। ইসলামিক পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ওআইসির সদস্য হয়।
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে পররাষ্ট্রনীতিতে ইসলামিক রাষ্ট্রের পরিচয় স্পষ্ট হয়। সৌদি আরব, ইউএই-সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক বন্ধন সুদৃঢ় করা হয়। এ সময় চীনের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু হয় যা পরবর্তীতে রপ্তানি ও প্রতিরক্ষা খাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিমা সাহায্যের প্রবাহ ফিরে আসে।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সরকার পররাষ্ট্রনীতিকে ইসলামিক ভ্রাতৃত্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার দিকে প্রসারিত করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি সার্ক (SAARC) গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন যা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমন্বয়ে মাইলফলক হয়ে ওঠে। এ সময় মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো মুসলিম প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হয়।
এরশাদ সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে “ওপেন মার্কেট” নীতি গ্রহণ করে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে টেক্সটাইল ও ইলেকট্রনিক্স খাতে সহযোগিতা বাড়ে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে বাধ্য করে যা এরশাদের পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে।
এ সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন দেখা দেয়, বিশেষত ফারাক্কা চুক্তি ও সীমান্ত ইস্যুতে। তবে অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য পশ্চিমা দাতাদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে যা পরবর্তীতে রপ্তানি ও শ্রমবাজার বিকাশে ভূমিকা রাখে।
গণতন্ত্রের উত্তরণ ও ভারসাম্য কূটনীতি (১৯৯১-২০০৮):
১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর পররাষ্ট্রনীতি হয়ে ওঠে আরও গতিশীল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারগুলো ভারত, চীন ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে “লুক ইস্ট” নীতি গ্রহণের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়।
২০০০-এর দশকে বৈদেশিক নীতিতে যোগ হয় “অর্থনৈতিক কূটনীতি”-র ধারণা। পোশাক শিল্পের বিকাশ, শ্রমিক রপ্তানি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব বাড়ায়। এ সময় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সৈন্যরা সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় যা বৈশ্বিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে।
সমৃদ্ধির পথে বহুমুখী কৌশল (২০০৯-২০২৪): শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সাল থেকে পররাষ্ট্রনীতিকে যুক্ত করেছে “ডিজিটাল বাংলাদেশ” ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যের সঙ্গে। “ফ্রেন্ডশিপ টু অল, ম্যালিস টু নান” নীতির আওতায় চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সহযোগিতা।
চীন-ভারত সমীকরণ: চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে (বিআরআই) বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট, বিদ্যুৎ ও বন্দর উন্নয়ন চুক্তি একসঙ্গে এগিয়ে নিয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট: ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয়দান বাংলাদেশকে বৈশ্বিক মানবাধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রে নিয়ে যায়। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতে সক্রিয় কূটনীতির মাধ্যমে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চাপ প্রয়োগ চলছে।
জলবায়ু কূটনীতি: সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধির ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ জলবায়ু ভুক্তভোগী দেশগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা “ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম”-এর মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে সোচ্চার।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল: যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক চুক্তি (আইপিইএফ) ও ভারতের “নেইবারহুড ফার্স্ট”-এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ সমুদ্রপথের নিরাপত্তা ও ব্লু ইকোনমি বিকাশে কাজ করছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো চীন-ভারত-মার্কিন প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। পাশাপাশি, রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান, জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিতকরণ এবং ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাণিজ্য সুবিধা ধরে রাখার কূটনৈতিক প্রয়াস জরুরি। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার বৈচিত্র্যকরণ ও ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব বাড়ানো প্রয়োজন।
এরশাদের সময়ে গড়ে ওঠা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা (সার্ক) আজও বাংলাদেশের কৌশলগত অগ্রাধিকারে রয়েছে। তার শুরু করা অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি পরবর্তী সরকারগুলোর জন্য রোল মডেল হয়ে ওঠে যা বর্তমান রপ্তানিভিত্তিক অর্থনীতির ভিত্তি রচনা করে।
ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে সরকারপ্রধান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কূটনীতিকদের ভূমিকা মুখ্য। ড. ইউনূসের মতো ব্যক্তিত্বগণ বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণে অবদান রাখলেও, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে তাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব সীমিত। বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির ধারা অনেকটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের নীতিতেই পরিচালিত হচ্ছে।
অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো:
১. জলবায়ু ন্যায়বিচার: ইউনূসের সরকার বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলে উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য কূটনৈতিক চাপ অব্যহত রেখেছেন। তার “সামাজিক ব্যবসা” মডেলের আলোকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি বিনিময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
২. রোহিঙ্গা পুনর্বাসন: মিয়ানমারের সঙ্গে কঠোর আলোচনার পাশাপাশি তিনি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক জোট গঠনে মনোনিবেশ করেছেন।
৩. অর্থনৈতিক কূটনীতি: ক্ষুদ্রঋণ ও নারীর ক্ষমতায়নের মডেলকে বৈশ্বিকভাবে প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে “সফট পাওয়ার”-এর উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
৪. প্রযুক্তি ও শিক্ষা সহযোগিতা: ভারত, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ডিজিটাল লিটারেসি এবং টেকসই কৃষি প্রযুক্তি বিনিময়ে চুক্তি প্রাধান্য পেয়েছে।
৫. যুদ্ধবিরোধী অবস্থান: ইউক্রেন-রাশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মতো বৈশ্বিক দ্বন্দ্বে তিনি নিরপেক্ষতা বজায় রেখে মানবিক সহায়তা চ্যানেল খোলার পক্ষে সোচ্চার হয়েছেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে