স্বাস্থ্যসেবার সংকট নিরসনে চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুনর্মূল্যায়ন জরুরি
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার মান নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। আর তার জন্য ডাক্তারদের যোগ্যতাও যেমন নির্ধারণ করতে হবে, তাদের যথাযথ মূল্যায়নও করতে হবে। চিকিৎসাবিজ্ঞান ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে, নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব হচ্ছে, তার সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে; কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবস্থাটা এখনো ভিন্ন। বাংলাদেশে একবার একজন ডাক্তার এমবিবিএস বা বিশেষায়িত ডিগ্রি অর্জন করলে, কোনোরকম দক্ষতা মূল্যায়ন ছাড়াই তারা আজীবন চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন। যার ফলে চিকিৎসাগত ভুলত্রুটি এখানে হরহামেশাই ঘটে। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সঙ্গে অনেক চিকিৎসকই তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না। অনেকে এখনো সেকেলে চিকিৎসা-পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকেন যা রোগীদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটা স্বাস্থ্যসেবার সামগ্রিক মানকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
এই সমস্যা শুধু চিকিৎসকদের নয়, বাংলাদেশে এটি একটি বিরাট সামাজিক সমস্যা। প্রায়ই দেখা যায় সাধারণ মানুষরা সঠিক চিকিৎসা পান না। ভুল চিকিৎসার শিকার হলেও অভিযোগ জানাতে ভয় পান। এই ভয় ও সংশয় সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা খাতের দুর্বলতাকেই চিহ্নিত করে। এতেই বোঝা যায় চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এখনো আমরা কীরকম অসচেতন। যে কোনো সমস্যা সমাধানের সঠিক উপায় আগে সমস্যাটি যথাযথভাবে চিহ্নিত করা, সেদিকে জোর দেয়া হলে বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি আরও পরিষ্কার হবে।
উন্নত দেশগুলোতে চিকিৎসকদের নিয়মিত পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। নির্দিষ্ট বিরতিতে তাদের দক্ষতা মূল্যায়ন করা হয়। যুক্তরাজ্যে চিকিৎসকদের প্রতি পাঁচ বছর পর পর পুনরায় মূল্যায়ন করা হয়। যার মাধ্যমে জানা যায় রোগীদের মতামত। অন্যান্য চিকিৎসকের সঙ্গে একজন চিকিৎসকের কীরকম সম্পর্ক তাও জানা যায়। আর সবচেয়ে বেশি জানা যায় পাস করে বেরিয়ে যাওয়ার পরও একজন চিকিৎসক আধুনিক চিকিৎসার নতুন নতুন আবিষ্কারগুলো সম্পর্কে ঠিকঠাক খবরাখবর রাখছেন কি না। এ জন্য তাদের নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পূর্ণ করতে হয়। সিঙ্গাপুর এবং অস্ট্রেলিয়ায়, ডাক্তারদের পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ নিতে হয় এবং নির্দিষ্ট ক্রেডিট জমা না করলে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করা হয় না। বাংলাদেশে এই ধরনের ব্যবস্থার অভাব রয়েছে, যার অর্থ অনেক চিকিৎসক আধুনিক চিকিৎসা আপডেট সম্পর্কে জানেন না। এটা স্পষ্টতই রোগীদের সরাসরি ক্ষতি করতে পারে।
তা ছাড়া, সরকারি পদক্ষেপের অভাব এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সমস্যা চিহ্নিতকরণে যদিও কিছু সরকারি উদ্যোগ রয়েছে, দক্ষতা মূল্যায়নের কার্যকর পদক্ষেপ এখনো অনেক সীমিত। সরকারের সক্রিয় ভূমিকা এবং আইনি সংস্কার ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা খাতের এই সমস্যাগুলো দূর হবে না। বাংলাদেশে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায়ও চরম বিশৃঙ্খলা। সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য দক্ষ চিকিৎসা-প্রযুক্তিবিদ প্রয়োজন; কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রযুক্তিবিদদের ঘাটতির কারণে প্রায়শই অনভিজ্ঞ কর্মীদের দ্বারা জটিল সব পরীক্ষা করা হয়। এমন কি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ঝাড়ুদারদের দিয়ে পরীক্ষা করানোর অভিযোগ রয়েছে। এটা স্বাস্থ্যসেবার জন্য খুবই বিপজ্জনক সংকেত। বর্তমানে, মেডিকেল টেকনোলজিস্টের হাজার হাজার পদ খালি রয়েছে, তবুও কোনো নিয়োগ হচ্ছে না। যদি রোগ নির্ণয়েই ভুল হয় তাহলে ডাক্তার কীভাবে সঠিক চিকিৎসা দিতে পারবেন?
চিকিৎসকদের বাধ্যতামূলক দক্ষতা-উন্নয়ন এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি পাঁচ বছরে পুনর্মূল্যায়ন এবং দক্ষতা মূল্যায়নের ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। লাইসেন্স নবায়নের জন্য নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালা সম্পূর্ণ করা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। রোগীর মতামত এবং সহকর্মীদের পর্যালোচনার ভিত্তিতে ডাক্তারদের দক্ষতা মূল্যায়ন করা যেতে পারে। উপরন্তু, ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা এবং দক্ষতা উন্নয়নে অগ্রগতি নিরীক্ষণের জন্য একটি ডিজিটাল ডাটাবেস স্থাপন করা উচিত।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে স্বাস্থ্যসেবায় দক্ষতা মূল্যায়নের অভাব দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভুল চিকিৎসা, অসুস্থতা বা দুর্ঘটনার কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার খরচ বা বিদেশে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা জাতীয় অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করে। এই সমস্যাটি শুধু ব্যক্তি এবং পরিবার নয়, সমগ্র দেশকেও প্রভাবিত করে।
এআই-প্রযুক্তি বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছে। এআই-চালিত সফ্টওয়্যার দ্রুত রোগ নির্ণয় করতে রোগীর ল্যাব রিপোর্ট, স্ক্যান ইমেজ এবং চিকিৎসা ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে পারে। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় স্বয়ংক্রিয় ডায়াগনস্টিক টুল, রোবোটিক সার্জারি এবং এআই ব্যবহার চিকিৎসার নির্ভুলতাকে উন্নত করছে। এই প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য গবেষণা এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলোতে এআই-ভিত্তিক চিকিৎসা ডিভাইসগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো পরিচালিত হয়। একটি দ্বিতীয়-মতামত সিস্টেমের মাধ্যমে রোগীরা তাদের চিকিত্সার সিদ্ধান্তগুলো যাচাই করতে পারে। এটি চিকিৎসা প্রক্রিয়াটিকে আরও দক্ষ এবং স্বচ্ছ করে তোলে।
শুধু স্বাস্থ্যসেবা নয়, দক্ষতা মূল্যায়ন অন্যান্য পেশার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রের কর্মচারীরা একবার নিয়োগের পর আজীবন তাদের চাকরিতে থাকতে পারেন; কিন্তু তাদের দক্ষতা বিকাশের জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ফলে বাংলাদেশের উৎপাদন ও শিল্প খাত আন্তর্জাতিক মান মেনে চলতে ব্যর্থ হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার এটাই অন্যতম কারণ। উন্নত দেশগুলোতে, সিজিএমপি (বর্তমান গুড ম্যানুফ্যাকচারিং/ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিস) বাধ্যতামূলক, যাতে কর্মচারীরা আধুনিক ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে আপডেট থাকে।
দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা, সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানে সিজিএমপি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে অডিটিং সিস্টেম চালু করা এবং নিয়মিত বিরতিতে দক্ষতা মূল্যায়ন ও পুনঃপ্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা অত্যাবশ্যক। চিকিৎসকদের জন্য যেমন পুনর্মূল্যায়ন এবং দক্ষতা মূল্যায়ন প্রয়োজন, তেমনি শিল্প, উৎপাদন, প্রশাসন এবং অন্যান্য খাতেও অনুরূপ ব্যবস্থা থাকা দরকার।
একজন চিকিৎসকের ভুল সিদ্ধান্ত যেমন একজন রোগীর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, তেমনি অন্যান্য পেশায় অযোগ্যতা জাতীয় উন্নয়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা, শিল্প এবং অন্যান্য পেশাগত ক্ষেত্রে দক্ষতা উন্নয়ন এবং পুনর্মূল্যায়ন ব্যবস্থা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সমস্ত কর্মক্ষেত্রেই দক্ষতা বৃদ্ধি ও পুনর্মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার এখনই সময়।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে