সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন, কী হচ্ছে সেখানে
প্রায় ১৪ বছর গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এই প্রথম ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। সিরিয়ার বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছে 'স্বৈরশাসক' প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন এবং সিরিয়া এখন মুক্ত। দু-চার দিনের মধ্যে যদি শোনা যায় বাশার আল আসাদ ক্ষমতা ত্যাগ করার পর গ্রেপ্তার হয়েছেন, অথবা বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছেন- তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তবে সিরিয়ার এই যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলার চেয়ে বরং আন্তঃদেশীয় যুদ্ধ বলাই সঠিক। কারণ ২০১১ সালে গণতন্ত্র এবং বাশার আল আসাদের পতনের দাবিতে যে বিক্ষোভ আন্দোলন শুরু হয় তাতে শুধু নন-স্টেট অ্যাক্টরগুলোই নয়, জড়িয়ে পড়ে তুরস্ক, ইরান, ইসরায়েল, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটো জোট ও গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত সিরিয়ার প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ।
শুরুতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক আন্দোলন রূপ নিয়েছিল সশস্ত্র বিদ্রোহে, গঠিত হয়েছিল ফ্রি সিরিয়ান আর্মি। এর কারণ ছিল দীর্ঘকাল ক্ষমতা ধরে রাখা। বাশার আল আসাদ ২০০০ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর থেকেই ২৪ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। তার পিতা হাফিজ আল আসাদ ১৯৭১ সাল থেকে ২০০০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ২৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। যদিও অফিসিয়ালি দেশটি সিরিয়ান আরব রিপাবলিক। তার পিতার বিরুদ্ধেও কয়েকবার উৎখাতের আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। বাশার আল আসাদকে উৎখাতের দীর্ঘ আন্দোলনে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত সিরিয়ায় ৬ লক্ষাধিক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। প্রায় ৭০ লাখ মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
সিরিয়ায় এই সরকার উৎখাতের আন্দোলন ছিল আরব বসন্তেরই একটি অংশ। লিবিয়া, মিশর, তিউনিশিয়ার মতো দেশগুলোতে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন শাসকদের পতন হলেও সিরিয়ায় তা সম্ভব হয়নি। কারণ সিরিয়াকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়েছে রাশিয়া এবং ইরান। সিরিয়ার এই যুদ্ধ এত জটিল এবং এত স্টেক হোল্ডার ইনভলব রয়েছে, যা বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন ফ্রি সিরিয়ান আর্মি এবং কুর্দিশ গেরিলাদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সকে সরাসরি আর্থিক সহায়তা এবং হালকা অস্ত্র সরবরাহ করতে থাকে। তুরস্ক বাশারবিরোধী হলেও এসডিএফকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে নাখোশ হয়েছে। কুর্দিশ গেরিলাদের সহায়তা দেয়ার কারণে ন্যাটো দেশভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে ফাটল ধরে। বলা উচিত ফাটল প্রসারিত হয়েছে; কিন্তু যুগপৎ তারা সকলেই আসাদের পতনের জন্য বিভিন্ন গ্রুপকে সহায়তা দিতে থাকে।
এক সময় যুক্তরাষ্ট্র আইএসআইএস বা দায়েশকে শুধু নিষিদ্ধই করেনি, তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলাও চালিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ সিরিয়ায় বারবার বিমান হামলাও চালিয়েছে। তবে ইসরায়েলের এবং যুক্তরাষ্ট্রের হামলার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। ইসরায়েলের হিসাব অনুযায়ী সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ থাকুক বা না থাকুক, ইসরায়েলের জন্য হুমকি যেই হোক তাদের দমন করা। ইসরায়েলকে প্রায়ই দেখা যায় সিরিয়ায়, বিশেষ করে ইরানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট জায়গায় হামলা করতে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্যটা হলো বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এদিকে সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং বাশার আল আসাদকে রক্ষা করতে রাশিয়া ভুমধ্যসাগরে রণতরীও পাঠায়। তখন আসাদের পক্ষে খানিকটা ভারসাম্য আসে। যুক্তরাষ্ট্র বৃহৎ সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সিরিয়ায় একচ্ছত্র হামলা বন্ধ করে। এই জটিলতার মধ্যে সিরিয়ার ভুখণ্ডে কমপক্ষে পাঁচটি দখল নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও আলেপ্পো, হোমস, হামার মতো শহরগুলো এতদিন সিরিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণেই ছিল; কিন্তু বিশাল সিরিয়ার ‘সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’, ‘সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস, ‘আইএস আইএল’ (অর্থাৎ সিরিয়ান আইএসআই) এবং ‘হায়াত তাহরির আল শ্যাম’ সংক্ষেপে এইচটিএস নামের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়।
এই হায়াত তাহরির আল শ্যাম নামের সংগঠনটিই এখন রাজধানী দামাস্কাসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এই সংগঠনটি জয়শ-ই-সুন্না, নুর আলদীন জেঙ্কি মুভমেন্টসহ আরও পাঁচটি গ্রুপের সঙ্গে একত্রিত হয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যদিও বিস্তর ধারণা আছে যে হায়াত তাহরির আল শ্যামের শেকড় হচ্ছে আল কায়দা; কিন্তু এই গ্রুপের নেতা জোলানি সেটা অস্বীকার করেছেন।
২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম দফায় হায়াত তাহরির আল শ্যাম বা এইচটিএসকে টেরোরিস্ট সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র, এবং এর নেতা আল জোলানির বিরুদ্ধে ১০ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছিল। ৬ বছর পর ডেমোক্র্যাট সরকারের শাসনের শেষ প্রান্তে এসে ডেমোক্র্যাট দলেরই ঘোর সমর্থক সিএনএনকে সাক্ষাৎকার দিলেন বাউন্টি ঘোষণা করা আবু মোহাম্মদ আল জোলানি; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কীভাবে পাল্টে গেল? এতকাল আলেপ্পোসহ বড় কয়েকটি শহর ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপ এক রকম পাহাড়া দিয়ে রেখেছিল। তারা ইরানের সমর্থিত বিধায় বাশার আল আসাদের সরকারের সমর্থনেই ছিল। ইসরায়েল লেবাননে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ শুরু করলে হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা অধিকাংশ লেবাননে চলে যায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং সিরিয়ায় তাদের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। ইসরায়েল শুধু লেবাননে নয়, সিরিয়াতেও একের পর এক হিজবুল্লাহর অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। ফলে কার্যত সিরিয়ায় হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা সিরিয়ায় যুদ্ধ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। বাহ্যত এই অবস্থার সুযোগ নিয়েই সম্প্রতি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে শুরু করে। এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এতটাই ব্যস্ত যে সিরিয়ার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদিও রাশিয়া এইচটিএসকে ঠেকাতে কয়েক দফা বিমান হামলা চালিয়েছে, তাতে কাজ হয়নি।
এ ছাড়া সিরিয়ায় রাশিয়ার যে ওয়াগনার গ্রুপ ছিল তারাও সংখ্যায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বাশার আল আসাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং শিয়া অধ্যুষিত দেশ ইরান নিজেও লেবানন ও গাজায় এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, তাদের দ্বারা বাশার আল আসাদকে সুরক্ষা দেয়া কঠিন ছিল। ফলে সিরিয়াকে এখন, এই লেখা পর্যন্ত দামাসকাস রক্ষায় নিজেদের সেনাবাহিনীর ওপর পুরোটাই নির্ভর করতে হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাশারের পতন হলো ।
উল্লেখ্য, সিরিয়ায় ৭৪ শতাংশ মানুষ ইসলামের সুন্নি সম্প্রদায়ভুক্ত এবং ১৩ শতাংশ শিয়া সম্প্রদায়ের আলাউতি সেক্টের অনুসারী। বাশার আল আসাদ নিজে এই সেক্টের মানুষ। বাশার আল আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন, তাতেও কি সিরিয়ার সমস্যা দূর হবে, নাকি দেশটি খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যাবে স্থায়ীভাবে। একসময় সিরিয়ার আলেপ্পো, দামাস্কাস শহরে ধর্ম ও মতের বৈচিত্র্যের অসাধারণ সংহতি ছিল। এখন অনেক সশস্ত্র গ্রুপের প্রধান লক্ষ্যই ছিল বাশার আল আসাদকে গদিচ্যুত করা, ফলাফল তাই হলো। এখন তারা সিরিয়া দখলে নিয়েছে, পাশাপাশি ক্ষুধার্ত মানুষজনের খাবার ও সাহায্য দিচ্ছে। তারা বলছে ‘টুগেদার উই রিটার্ন’; কিন্তু বাশার উৎখাত হয়েছে এখন কি এই ‘টুগেদার’ ব্যাপারটি থাকবে? নিশ্চিত করেই বলা যায়, থাকবে না। ২০১৬ সাল থেকে সিরিয়ার দক্ষিন পূর্ব এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র আল তানফ নামক স্থানে সামরিক এলাকা হিসেবে দখলে রেখেছে ইরাকে এবং সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি নিরাপদ রাখার জন্য।
যে গ্রুপগুলো এখন বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তারা অচিরেই ভাগ হয়ে যাবে। কারণ এর মধ্যে কট্টরপন্থিরাও যেমন রয়েছে, তেমন মডারেট ফোর্সও রয়েছে। কুর্দিরা চাইবে একটি এলাকাকে স্বাধীন করে নিতে, যাতে তুরস্কের রয়েছে ঘোর আপত্তি। এমন অনেক ইকুয়েশনের কারণে এটা পরিষ্কার যে বাশার আল আসাদের পতন হওয়ার পরও সিরিয়ার সংঘাত সহসা বন্ধ হবে না।
মহসীন হাবিব: সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে