Views Bangladesh Logo

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর

চীনের সঙ্গে চুক্তি করার আগে তাদের পূর্বশর্ত যাচাই করতে হবে

ন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস আগামী ২৬ মার্চ ৪ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীন যাচ্ছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই ড.মোহাম্মদ ইউনূসের চীনে প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফর। ড.মোহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হলেও এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করা। রাজনৈতিক কারণেও এই সফর গুরুত্বপূর্ণ তবে অর্থনৈতিক ইস্যুই বেশি প্রাধান্য পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। এই মুহূর্তে চীন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম বড় আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী দেশ। চীন উদারভাবে বিভিন্ন দেশকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে চলেছে। চীন শ্রীলঙ্কাকেও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশকেও তারা উদারভাবে সহায়তা প্রদান করছে।

চীন বিভিন্ন দেশকে যে ঋণ সহায়তা প্রদান করে, তা কিন্তু সফট লোন নয়। তারা ঋণদানের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক হারে সুদারোপ করে। চীনের ঋণ গ্রহণ করতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে নানা ধরনের পূর্ব শর্ত মেনে নিতে হয়। যেমন উন্নয়ন কাজে চীনের ঋণ গ্রহণ করতে হলে তাদের কাঁচামাল ব্যবহার করতে হবে। চায়না বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দিতে হবে। এসব শর্তাবলি মেনে নিলে চীন সংশ্লিষ্ট দেশকে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকে। অন্য কোনো সূত্র থেকে ঋণ না পেয়ে একটি দেশ সহজেই চীনা ঋণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। চীন কোনো দেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে প্রকল্পের উপযোগিতা চিন্তা করে না। তাদের চিন্তা হচ্ছে প্রদত্ত ঋণ যথাসময়ে সুদসমেত আদায় করা যাবে কি না? এভাবে বাছ-বিচার না করেই ঋণ গ্রহণের ফলে অনেক দেশ চায়না ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে প্রচলিত অন্যান্য সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক সাড়া পাচ্ছে না। তাই চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেনি। তাই ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা থাকার কথা নয়। তবে চীন বা অন্য যে কোনো সূত্র থেকেই ঋণ গ্রহণ করা হোক না কেন দেশের স্বার্থের কথা সবার আগে চিন্তা করতে হবে। দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোনো ঋণ গ্রহণ করা যাবে না। চীনের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। জাতীয় স্বার্থে অত্যাবশ্যক নয় এমন কোনো প্রকল্পের জন্য চীনের ঋণ গ্রহণ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

শুধু চীনের ঋণের ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো ঋণের ক্ষেত্রে প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা এবং উপযোগিতাকে বিবেচনায় রাখতে হবে। শ্রীলঙ্কার সাবেক সরকার ঢালওভাবে চীন থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে। শ্রীলঙ্কা চীন থেকে যেসব ঋণ গ্রহণ করেছে, তার সবই ছিল বাণিজ্যিক ঋণ। সেই ঋণ ব্যবহার করে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়েছে। ফলে শ্রীলঙ্কা ঋণখেলাপি দেশে পরিণত হয়। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের নিজস্ব জেলায় একটি অত্যাধুনিক বিমানবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। সেই বিমান বন্দরে দিনে মাত্র কয়েকটি বিমান ওঠানামা করে। বিমানবন্দরটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছিল; কিন্তু সরকার তা কর্ণপাত করেনি। বিগত সরকার আমলে বাংলাদেশ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এদের কোনো কোনোটি যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প নির্মাণ ব্যয় অস্বাভাবিক রকম বেশি হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। আগামীতে যে কোনো সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণকালে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। শুধু ঋণ গ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না।

বাংলাদেশ এক সময় ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করত। বর্তমানে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান সবার শীর্ষে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন টাকা। একই সময়ে বাংলাদেশ-ভারতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ৪৬ ট্রিলিয়ন টাকা। ওই বছর বাংলাদেশের মোট আমদানি বাণিজ্যে চীনের অংশীদারত্ব বৃদ্ধি পায় ১৫ দশমিক ১৭। আর বাংলাদেশ-ভারতের বাণিজ্য হ্রাস পায় ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ মোট ৬৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য চীনে রপ্তানি করে। এর বিপরীতে চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ২২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য। চীন থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও বাংলাদেশ থেকে চীনে পণ্য রপ্তানি আশানুরূপভাবে বাড়ছে না। ড.মোহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের সময় দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে; কিন্তু পুরো ব্যাপারটি আমি ওইভাবে দেখি না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কোনো দেশের সঙ্গে দেশের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকবে। আবার কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকবে।

আমাদের সামগ্রিকভাবে বিচার করতে হবে কীভাবে বাণিজ্যিক ভারসাম্য দেশের অনুকূলে নিয়ে আসা যায়। তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বিভিন্ন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ চীন থেকে আমদানি করা হয় ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসির মাধ্যমে। চীন থেকে যেসব যন্ত্রপাতি আমদানি করা হচ্ছে তার গুণগত মান ভালো, দামেও কম। ফলে এসব পণ্য আমদানি করা আমাদের জন্য তুলনামূলকভাবে ব্যয়সাশ্রয়ী। চাইলেই চীন বা অন্য কোনো দেশ থেকে পণ্য আমদানি রাতারাতি কমে যাবে, তা আশা করা যায় না। তবে আমরা চাইলে মূল্যের বিষয়ে দর কষাকষি করতে পারি।

কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি থাকবে নাকি উদ্বৃত্ত থাকবে তা অনেক ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে। গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য যদি তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে ভোক্তাদের হাতে তুলে দেয়া যায়, তাহলে সেই পণ্য বাজারে টিকে থাকবে। বাণিজ্য ঘাটতি বা উদ্বৃত্ত শুধু এক দেশের অর্থনৈতিক শক্তির ওপর নির্ভর করে না। আরও অনেক কিছু বিবেচনায় রাখতে হয়। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি বৈশিষ্ট্য (দুর্বলতা) হচ্ছে, আমরা যেসব দেশ থেকে বেশি পরিমাণে পণ্য আমদানি করি সেই সব দেশে আমাদের পণ্য রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে থাকে; কিন্তু এই দুটি অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির পরিমাণ খুবই কম। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।

আবার চীন এবং ভারত থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য আমদানি করে থাকে। কিন্তু এই দুটি দেশে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির পরিমাণ খুবই কম। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল; কিন্তু এ জন্য আমাদের কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ খুবই প্রয়োজন। সীমিতসংখ্যাক পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কারও দয়ায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। সেখানে যোগ্যতা বলেই টিকে থাকতে হয়। গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে রপ্তানি করা না গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো করা সম্ভব নয়। এমনকি বাজারজাতকৃত পণ্য গুণগত মানসম্পন্ন এবং মূল্য সাশ্রয়ী না হলে তা নিয়ে স্থানীয় বাজারেও টিকে থাকা সম্ভব নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিকল্পনা করছেন, আগামী বছর বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ করাবেন। যদিও দেশের ব্যবসায়ীদের একটি শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণের সময়সীমা ১০ বছর পিছিয়ে দেবার প্রস্তাব করেছিল। উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা হারাবে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের অন্তত ১২ শতাংশ হারে শুল্ক প্রদান করতে হবে। একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রতি বছর ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থার একটি বড় ধরনের দুর্বলতা হচ্ছে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয় তার অধিকাংশই আমদানিকৃত কাঁচামাল নির্ভর। শিল্পে ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্যও আমদানি করতে হয়। ফলে রপ্তানিকৃত পণ্য থেকে যে আয় হয়, তার একটি বড় অংশই কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। ফলে রপ্তানি আয় থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম।

ড.মোহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরকালে দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। চীনকে বলতে হবে বাংলাদেশি পণ্য আমদানি করার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে, তা দূর করতে হবে। চীন যাতে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বাণিজ্যিক সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা দেয় তা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর বর্ধিত হারে শুল্কারোপ করার ফলে চীনের অনেক কোম্পানি বিদেশে স্থানান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে। এসব শিল্প যাতে বাংলাদেশে স্থানান্তর করা হয় সে বিষয়ে চীনকে অনুরোধ জানানো যেতে পারে।

ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)
অনুলিখন: এম এ খালেক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ