Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বয়কট এখন বিশ্ব রাজনীতির বড় হাতিয়ার

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শুক্রবার, ৫ জুলাই ২০২৪

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোকা-কোলা বয়কটের পক্ষে-বিপক্ষে চলছে তর্ক-বিতর্ক। বাংলাদেশে পক্ষে এবং বিপক্ষের লোকসংখ্যা বের করার জন্য জরিপও হয়েছে, জরিপে পরিলক্ষিত হয়েছে ৮৯ শতাংশ লোক কোকা-কোলা বর্জনের পক্ষে। গত বছর অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর থেকে কোকা-কোলা বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছিল; কিন্তু তাতে খুব সাড়া মিলেনি। সম্প্রতি কোকা-কোলার একটি বিজ্ঞাপন স্তিমিত বয়কটের প্রচারণাকে উসকে দিয়েছে। কোকা-কোলার মালিক কোনো ইহুদি নয় এবং এর কারখানা গাজায়ও আছে- এমন কথা বলে বিজ্ঞাপন দেয়ার পর আবার নতুন উদ্যমে কোকা-কোলা বয়কটের আহ্বান আসছে। এ সুযোগে দেশীয় কোমল পানীয়গুলোর বিক্রি বাড়াতে বাংলাদেশি নাগরিকদের আবেগকে কাজে লাগানো হচ্ছে, দেশীয় পণ্য ‘মোজো’র প্রতিষ্ঠানটি ফিলিস্তিনের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘মোজো সাপোর্ট ফিলিস্তিন’ নামে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

বিশ্বের বৃহত্তম পানীয় উৎপাদনকারী কোকা-কোলা ইসরায়েলের পণ্য নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য। কোকা-কোলার নির্দিষ্ট কোনো মালিক নেই, এটা একটা পাবলিক লিমিটেড মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানি। কোকা-কোলা একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে সর্বজনীনভাবে তালিকাভুক্ত রয়েছে- তাই শেয়ারহোল্ডারাই হচ্ছে কোকা-কোলার মালিক। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগে ১৮৮৬ সালে কোকা-কোলার বিপণন শুরু হয়। কিউবা এবং উত্তর কোরিয়া ব্যতীত সারা বিশ্বে কোকা-কোলা বিক্রি এবং তৈরি হয়, ইসরায়েল এবং গাজায় কোকা-কোলার দুটি কারখানা আছে। ইসরায়েলে ব্যবসা করতে অস্বীকার করায় কোকা-কোলাকে এক সময় ইহুদিবিরোধী বলে মনে করা হয়েছিল।

ইসরায়েলে কোকা-কোলার কোনো কারখানা না থাকায় আমেরিকার একটি জায়নবাদী গোষ্ঠী ১৯৬৬ সালে কোকা-কোলা বয়কট করেছিল, তাদের অভিযোগ ছিল কোকা-কোলা আরব দেশগুলোর সমর্থক। জাতিগত বিদ্বেষের দুর্নাম ঘুচাতে ১৯৬৬ সালে ইসরায়েলে কোকা-কোলার কারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসরায়েলে কোকা-কোলার কারখানা করার কারণে আরব বিশ্ব কোকা-কোলা বয়কট করে। পেপসি এই সুযোগে ইসরায়েলের বাজারে না গিয়ে আরব দেশগুলোতে ঢুকে পড়ে এবং এ জন্য ইসরায়েলের ইহুদিরা পেপসি বয়কট করে। এই জাতীয় সমস্যা উত্তরণে মার্কিন কংগ্রেস ১৯৭৭ সালে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতীয়তা বা জাতীয় উৎসের ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তি বা ব্যবসার প্রতি বৈষম্য করাকে বেআইনি ঘোষণা করে। ফলে ১৯৯২ সালে পেপসি ইসরায়েলেও প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।

আমেরিকার অন্যান্য পণ্য বয়কট না করে শুধু কোকা-কোলা বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে কেন? বলা হচ্ছে, এক- কোকা-কোলা কোম্পানিটি মার্কিন-ইসরায়েলি চেম্বার অব কমার্স অ্যাওয়ার্ডসকে স্পন্সর করে এবং এর মাধ্যমে ইসরায়েলের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে; দুই- ২০০৯ সালে কোকা-কোলা আইপ্যাকের মাধ্যমে লবিংয়ের জন্য যে পুরস্কারটি স্পনসর করেছিল তা গাজায় জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির আহবান প্রত্যাখ্যান করেছে; আইপ্যাকের কাজ হল ইসরায়েল সম্পর্কিত বিষয় এবং আইন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে লবিং করা। তিন- ২০০৯ সালে কোকা-কোলা যে বেন-এলিয়েজারকে সংবর্ধনা দেয় সেই এলিয়েজার ইসরায়েলের হাতে বন্দি তিন শতাধিক মিশরীয়কে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল; চার- কোকা-কোলার প্রধান শেয়ারহোল্ডার ওয়ারেন বাফেট ইসরায়েলি বন্ডের শক্তিশালী প্রচারক এবং ইসরায়েলের বড় বড় কোম্পানিতে তার বিনিয়োগ রয়েছে।

কোকা-কোলার সঙ্গে ইহুদিদের সম্পর্কের অনুসন্ধান চললেও কোকা-কোলা আমেরিকান পণ্য বলেই বর্জনীয়- এ কথাটি শক্তভাবে কেউ বলছে না। বয়কট এখন বিশ্ব রাজনীতির বড় হাতিয়ার। সাম্প্রতিককালে বয়কট সারা বিশ্বেই হচ্ছে। আমেরিকা এখন কথায় কথায় বিভিন্ন দেশের পণ্য ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে; শুধু নিজেদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে নয়, তাদের করা নিষিদ্ধ পণ্য অন্যকেও ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর আমলে কিউবার কাছে চটের বস্তা বিক্রি করার কারণে আমেরিকা বাংলাদেশে দুর্বিষহ দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে দিয়েছিল। কিউবা, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের শুধু পণ্য নয়, পুরো দেশকেই আমেরিকা বর্জন করে চলেছে এবং এই দেশগুলোর সঙ্গে যারা ব্যবসা করে সেই দেশগুলোর ওপরও নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। চীনের বিভিন্ন পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আমেরিকা বিশ্ব বাণিজ্যে চীনকে কোণঠাসা করে ফেলেছে, চীনের প্রবৃদ্ধি দিন দিন কমছে।

বর্তমানে সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞার কবলে রাশিয়া; রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার লক্ষ্যে আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো বয়কটের নানাবিধ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্বদেশি আন্দোলনে ব্রিটিশ পণ্য বয়কট করে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের ডাক দেয়া হয়েছিল। স্বদেশি আন্দোলনকে সফল করার জন্য বর্জননীতি ছিল মূল হাতিয়ার। এই স্বদেশি আন্দোলনে ব্রিটিশদের পণ্য বিক্রি ২০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জনপ্রিয় পোস্টারে মহাত্মা গান্ধীকে চরকায় সুতা কাটতে দেখা গেছে, তখন দেশি খাদি কাপড়ের ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল, খাদিই ছিল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর একমাত্র পরিধেয় বস্ত্র।

তবে দেশীয় পণ্যে স্বয়ম্ভর হওয়ার লক্ষ্যে তাঁত শিল্পে কিছুটা অগ্রগতি হলেও অন্য কোনো সেক্টরে সফলতা আসেনি; সফলতা না এলেও স্বদেশি আন্দোলনের কারণে দেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা স্থাপনের প্রতি ভারতীয়দের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়; কিন্তু বর্তমান বিশ্বে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের পণ্য ও প্রযুক্তি বর্জন করলে আমাদের জীবন অচল হয়ে যাবে। আমেরিকার মদদে ইসরায়েল বেপরোয়া, আমেরিকার অস্ত্রের আঘাতে গাজায় ৩৮ হাজার নিরস্ত্র জনতা মারা গেছে এবং আমেরিকার সমর্থনে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে অবৈধ বসতি গড়ে তুলছে। তাই শুধু কোকা-কোলা নয়, আমেরিকার সব পণ্য বর্জন করা ফরজ; কিন্তু সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই বয়কটের জন্য শুধু কোকা-কোলাকে বেছে নেওয়া হয়েছে, কারণ এই পণ্যটি গণমানুষের কাছে সুপরিচিত, বর্জনের আন্দোলনে সাধারণ লোকও অংশ নিতে পারছে।

এ ছাড়াও পণ্যটি মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্যও নয়, বরং পণ্যটি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও খেতে ইচ্ছে হলে কোকা-কোলার বিকল্প পাণীয় বাজারে রয়েছে; কিন্তু মুসলিমদের জন্য দুঃখজনক হচ্ছে তাদের প্রতিবাদের অস্ত্র হচ্ছে প্রতিপক্ষের পণ্য বর্জন; কিন্তু প্রতিকারের কোন অস্ত্র তাদের হাতে নেই। মুসলমানরা এখনো মহাবীর গাজী সালাউদ্দিনের বীরত্বের স্মৃতিগাথায় আত্মহারা; কিন্তু তাদের মনে রাখতে হবে, আগের মতো এখন আর পৃথিবীতে ধর্মযুদ্ধ নেই, এখন যুদ্ধ চলছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির; এই যুদ্ধে সফল না হলে ৭০ লাখ অধিবাসীর ইসরায়েল কখনো ২০০ কোটি মুসলমানের ৫৬টি দেশকে সমীহ করবে না। ইসরায়েল জাতিসংঘের সিদ্ধান্তও মানছে না; এই না মানার প্রধান কারণ হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনায় আরব লীগের মৌন সম্মতি।

কোকা-কোলা বর্জন করছে সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে আরব লীগ আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় ওঠবস করছে। কলম্বিয়া, বলিভিয়া, চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দেশ ইসরায়েলকে বয়কট করলেও আরব লীগ করেনি; বরং হামাসকে নিশ্চিহ্ন করতে ইসরায়েলের অভিযানে আরব লীগের অধিকাংশ দেশের মৌন সম্মতি রয়েছে। হামাসদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে আরব লীগের কোনো কর্মকাণ্ড নজরে আসেনি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে ‘উন্মাদ’ বলে অভিহিত করেছেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো মুসলিম দেশ মামলা করেনি, মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা।

অন্যদিকে তুরস্ক শুধু বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, বড় বড় কথা বলছে, কাজের কাজ কিছুই করছে না। তুরস্ক পণ্য রপ্তানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে মিশর ও জর্ডান ইসরায়েলে রপ্তানি বাড়িয়ে দিয়েছে। কোকা-কোলা বর্জনের কোনো প্রয়োজন হতো না, যদি সব মুসলিম দেশ একযোগে ইসরায়েলকে বর্জন করত। ইসরায়েলকে বর্জন না করে জর্ডান ইরানের ছোড়া গোলা ধ্বংস করে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে। বাংলাদেশই বোধ হয় একমাত্র দেশ যে দেশটির জন্ম থেকেই ইসরায়েলকে বর্জন করে চলছে।

লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ