Views Bangladesh Logo

প্রতিশ্রুতি এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতার বিপিএল

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বলতে অধিকাংশ দর্শক বোঝেন চার-ছক্কার সমাহার, রানের ফুলঝুরি। এবারের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) প্রথম দিন দুই ম্যাচের ৪ ইনিংসের তিনটি ছিল ১৯০ ছাড়ানো। ব্যতিক্রমী আসরের প্রতিশ্রুতি ছিল এবার, সূচনায় দারুণ ব্যতিক্রম ছিল ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসর। কেবল কি সূচনা? নানা দিক থেকে ব্যতিক্রম এ আসর, এখনো ব্যতিক্রমী নানা ঘটনা জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যার অধিকাংশই কিন্তু ইতিবাচক নয়, বরং নেতিবাচক।

বৈশ্বিক অনেক তারকাকে একসময় দেখা গেলেও এবারের বিপিএল আসর কিন্তু ব্যতিক্রমী হয়ে আছে। খুব বেশি তারকা নেই; এমন তারকা, যাদের দেখতে দর্শকরা মাঠে ছুটে আসবেন। দেশি-বিদেশি খেলোয়াড়দের মানও প্রশ্নবিদ্ধ। গড়পড়তা মানের খেলোয়াড় নিয়ে লড়ছে দলগুলো, যা দর্শকদের মোটেও আকৃষ্ট করতে পারছে না। তারপরও কিন্তু নির্দিষ্টসংখ্যক দর্শক মাঠে যাচ্ছেন, খেলা দেখছেন; কিন্তু বিপিএল ঘিরে যে হাইপ তোলা হয়েছিল; তা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ আছে, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না।

এবারের আসর ঘিরে কিছু চাকচিক্য মাঠের বাইরে দেখা গেছে বটে; কিন্তু ৫ আগস্ট-পরবর্তী বদলে যাওয়া বাংলাদেশে ‘নতুন রূপের বিপিএল’ আয়োজনের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, সেটা আর দেখা যাচ্ছে কোথায়! বাইরের চাকচিক্য তো আসর জমাতে পারবে না। এ জন্য চাই মাঠের লড়াইয়ের বৈচিত্র্য। তা তো দেখা যাচ্ছে না। বিপিএল নিয়ে অতীতেও হতাশ ছিলেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা, তাদের হতাশা বরং বড়িয়ে যাচ্ছে এবারের আসরের নানা ঘটনাপ্রবাহ।

শুরুর পর থেকে পারিশ্রমিক ইস্যুতে ধারাবাহিকভাবেই শিরোনাম হচ্ছে বিপিএল। এবার আসর চলাকালেই এ-সংক্রান্ত শিরোনাম চোখে পড়েছে। পারিশ্রমিক ইস্যুতে অনুশীলন বর্জনের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় ক্রিকেটারদের যে চেক দিয়েছিল দুর্বার রাজশাহী, সে চেক বাউন্স হওয়ার পর অনুশীলন না করার সিদ্ধান্ত নেন দলটির ক্রিকেটাররা। ব্যঙ্গাত্মক একটা কথা প্রচলিত আছে, ‘প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় ভঙ্গ করার জন্যই।’ বিপিএল শুরুর আগে পারিশ্রমিক ইস্যুতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি ফারুক আহমেদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘পারিশ্রমিক ইস্যুতে ক্রিকেটারদের অসন্তোষ দেখা যাবে না।’ দুর্বার রাজশাহীর পারিশ্রমিক কেলেঙ্কারির পর প্রচলিত ব্যঙ্গাত্মক কথাটাই বারবার মনে পড়ছিল!

এবারের বিপিএল কেবল পারিশ্রমিক ইস্যুতে শিরোনামে আসেনি, ছিল দৈনিক ভাতার ইস্যুও। দুর্বার রাজশাহীর ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিকের সঙ্গে বকেয়া ছিল দৈনিক ভাতাও। ১০ দিন বকেয়া থাকার পর ওই ভাতাকে আদৌ ‘দৈনিক ভাতা’ বলা যৌক্তিক কি না- কে জানে! এসব কারণে এবারের বিপিএল ব্যতিক্রমী বটে। পারিশ্রমিক ইস্যুটা না হয় মেনে নেয়া গেল; কিন্তু এবারের আসরে একের পর এক ম্যাচ, ম্যাচের নানা ঘটনা প্রবাহ কি আদৌ মেনে নেয়ার মতো? প্রশ্নটা কি কারণে আসছে একটা পরিসংখ্যানেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে- ১০ ম্যাচে ১৬টি এমন ওয়াইড বল করা হয়েছে, যা বাউন্ডারির বাইরে গেছে! ১০ ম্যাচে ১৬ বার ৫ রান করে এসেছে! প্রথম ২৬ ম্যাচের ওই পরিসংখ্যান কি আপনার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
ওয়াইড বল ক্রিকেটের একটা অংশ, এটা হতেই পারে; কিন্তু তাই বলে ১০ ম্যাচে এমন ১৬ ওয়াইড বল, যা বাউন্ডারির বাইরে গেছে। লেগ সাইডে এমন ওয়াইডও হয়েছে, যা গিয়ে পিচ করেছে কয়েক গজ বাইরে। উইকেটকিপার তো বটেই, ফাইন লেগের ফিল্ডারও বলের নাগাল পাননি। হাস্যকর এমন ডেলিভারি স্পট-ফিক্সিংয়ের সন্দেহকে ঘনীভূত করেছে, এখনো করে যাচ্ছে।

ওয়াইড বলে বাউন্ডারি বিদেশিরা যেমন দিয়েছেন, দিয়েছেন স্থানীয় বোলাররাও। ফাস্ট বোলাররা রাগান্বিত হয়ে আরও জোরে বল করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে খেই হারান। ওই অবস্থায় অস্বাভাবিক কোন ডেলিভারি না হয় মেনে নেয়া যায়; কিন্তু স্পিনারদের বেলায় এমন উদ্ভট ডেলিভারি কিন্তু মোটেও স্বাভাবিক না। এবারের বিপিএল এমন অস্বাভাবিক ঘটনাও দেখিয়ে গেছে, দেখিয়ে যাচ্ছে। যা ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক এ লিগ ঘিরে স্পট ফিক্সিংয়ের সন্দেহ ঘনীভূত করছে। এ অবস্থায় আসর নিয়ে প্রকৃত ক্রিকেটামোদিদের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।

ওয়াইড বলের সঙ্গে আরেক সন্দেহজনক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ওভার থ্রো। বাজে ডেলিভারি দিয়ে ব্যাটারকে বড় শট খেলতে প্রলুব্ধ করতে না পেরে এক পর্যায়ে অযথাই স্ট্যাম্পের দিকে থ্রো করার দৃশ্যও দেখা গেছে। ব্যাকআপ ফিল্ডার না থাকার পরও করা ওই থ্রো বাউন্ডারির বাইরে গেছে, ওভার-থ্রো থেকে এসেছে চার রান। নির্দিষ্ট একটা ওভারে নির্দিষ্টসংখ্যক রানের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্যই এমনটা করা হয়েছিল কি না, কে জানে!

‘স্পট ফিক্সিং’ বাস্তবায়নের হাতিয়ার বানানো হয় সাধারণত বোলারদের। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের লর্ডস টেস্ট আলোচিত ছিল এমন স্পট ফিক্সিংয়ের কারণে। ওভারের নির্দিষ্ট ডেলিভারিকে ‘নো-বল’ করা হয়েছিল। ওই ‘নো-বল’ ছিল পূর্বনির্ধারিত। এ জন্য জুয়াড়িদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছিলেন পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ ও সালমান বাটকে ৫ বছরের জন্য সবধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

সময়ের বিবর্তনে স্পট ফিক্সিংয়ের ধরনও বদলেছে। ওভারে নির্দিষ্ট ডেলিভারি নো কিংবা ওয়াইড করাই নয়; ওভারে নির্দিষ্ট পরিমাণ রান দেয়ার বিষয়ও সন্দেহের উদ্রেক ঘটাচ্ছে। সন্দেহের উদ্রেক ঘটিয়ে যাচ্ছে এবারের বিপিএলও। এমন কিছু ক্রিকটার অস্বাভাবিক নানা ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যারা ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় চলে এসেছেন। ম্যাচের নির্দিষ্ট একপর্যায়ে অস্বাভাবিক নৈপুণ্যর সঙ্গে এমন কিছু ক্রিকেটার জড়িয়ে যাচ্ছেন; যাদের খেলাটিতে ভবিষ্যৎ নেই কিংবা জাতীয় দলে খেলার আশাও শেষ। এমন বিষয় তো স্পট ফিক্সিংয়ের সন্দেহকে প্রকট করবেই!

অস্বাভাবিক নানা ঘটনা দেখে সন্দেহ করা, সন্দেহজনক ক্রিকেটারকে বাঁকা চোখে দেখা ছাড়া আদৌ কিছু করার আছে! কারণ স্পট ফিক্সিং তো আর আপনি সহজে প্রমাণ করতে পারবে না। এসব দেখে ক্ষোভ-অভিমানে ওইসব দর্শক হয়তো নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছেন; যারা এখনো ক্রিকেটকে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা বলে জানেন, ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে মানেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ক্রিকেটের অন্যতম আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন তামিম ইকবাল। আলোচিত পঞ্চপাণ্ডবের একজন তিনি, যিনি মাঠে থেকে আলোচনায় ছিলেন, আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছিলেন মাঠের বাইরে থেকেও।

এবারের বিপিএল ব্যতিক্রম হয় কীভাবে! এ আসরে তামিম ইকবাল আলোচিত হলেন উগ্র আচরণের কারণে। একসময়কার জাতীয় দলের সতীর্থ সাব্বির রহমান এবং দুই বিদেশি ক্রিকেটার- দাউদ মালান ও অ্যালেক্স হেলসের সঙ্গে বিবাদে জড়ান তামিম। এক ম্যাচের পর তামিমের তেড়েফুঁড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা ছিল দৃষ্টিকটু। যে কারণে সমালোচিত হয়েছেন অভিজ্ঞ এ ক্রিকেটার। বিপিএলের অর্থে সরকারি কর্মকর্তাদের ম্যাচ উপভোগ এবং নানা সুযোগ-সুবিধা নেয়ার বিষয় গোপন থাকেনি। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন স্থানীয় ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক সংস্থার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা। এ-সংক্রান্ত আলোচনা-সমালোচনা ছিল সিলেট পর্বে। পরে না কি ম্যাচ উপভোগ-সংক্রান্ত খরচের বোঝা বিপিএল কর্তৃপক্ষের ওপর থেকে নামানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে!

বিপিএল সফল-সুন্দর করতে ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে সরকার। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের মাধ্যমে বিভিন্ন ভেন্যু সংস্কারে এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। সরকারি ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ের মঞ্চ বিপিএল একের পর এক উদ্ভট ঘটনা জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, স্পট ফিক্সিংয়ের কারণে এ আসর বাজিকরদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। অথচ এ আসর ঘিরে কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘তারুণ্যের উৎসব-২০২৫’ ঘোষণা করেছে। এ উৎসব বাস্তবায়নে বিভিন্ন ক্রীড়া ডিসিপ্লিনের কর্মকর্তারা মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অর্থ নেই- চলছে এ-সংক্রান্ত হাহাকার।

বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন দেশব্যাপী ‘যুব কাবাডি অনূর্ধ্ব-১৮ বালক ও বালিকা’ আয়োজন করছে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজন করছে অনূর্ধ্ব-১৫ প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন ৮ বিভাগে প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে। বিভাগীয় পর্যায়ের পর জাতীয় পর্যায়ে আয়োজিত হবে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। তার বাইরে অন্যান্য জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনও নানা আয়োজন হাতে নিয়েছে। এসব আয়োজনের জন্য সরকারি অর্থ সহায়তাও চেয়েছে বিভিন্ন ফেডারেশন। তাদের সে চাওয়া আদৌ পূরণে হয়েছে কি না- জানা যায়নি। ফুলে-ফেঁপে ক্রমেই বড় হচ্ছে ক্রিকেটের অর্থ ভান্ডার। সে ক্রিকেটের পেছনেই মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে। বাকিদের খোঁজ-খবর রাখার সময় কি আদৌ আছে ক্রীড়া নিয়ন্তাদের!

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সংবাদিক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ