Views Bangladesh Logo

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর: কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা উন্মোচিত হবার সম্ভাবনা

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে কূটনৈতি মহল। তারা বলছেন, এ সফরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। ২৬ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত নির্ধারিত প্রধান উপদেষ্টা চীনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করবেন।

২০২৫ সালে বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে চীন। এ উপলক্ষে উভয় দেশই পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এই সফরকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি বড় সুযোগ হিসেবে দেখছেন। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের মতে, ৫০ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে অধ্যাপক ইউনূসের সফর হবে একটি মাইলফলক। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি বলেন, এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

ড. ইউনূসের এ সফর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিধি আরও বিস্তৃত করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সফরের ফলে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আরও গভীর হবে এবং দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। এই সফরটি ভূ-রাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা ভাবছেন এই সফরের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নতুনভাবে তৈরি হতে পারে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের নীতি বাংলাদেশ সম্পর্কে এখনো স্পষ্ট নয়। আবার ভারতের সঙ্গে একদিকে যেমন চীনের আঞ্চলিক আধিপত্যের প্রশ্নে বৈরিতা রয়েছে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বৈরিতা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আরও ঘনীভূত হয়েছে। ফলে এই অবস্থায় এই সফর পরবর্তীতে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

রাজনৈতিক ভূমিকার পাশাপাশি এই সফর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। চীন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং অবকাঠামো উন্নয়নে প্রধান সহযোগী। দুদেশের মধ্যে বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশ চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (BRI)-এর অংশীদার হওয়ায় দেশটির বিভিন্ন বড় প্রকল্পে চীনের সরাসরি বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত।

ড. ইউনূসের সফরকে কেন্দ্র করে নতুন বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার দরজা উন্মোচন হতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য হতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ড. ইউনূসের চীন সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। এ সফরের মাধ্যমে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে এবং ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হবে। চীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় অবকাঠামো উন্নয়ন সহযোগী হওয়ায়, দুই দেশের অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের ভবিষ্যৎ আরও মজবুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সফরের ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কৌশলগত সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি পাবে। এই সফর কেবলমাত্র বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ককেই শক্তিশালী করবে না, বরং এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তার চীন সফরে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ৩০ বছরে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া, ঋণের সুদের হার দুই-তিন শতাংশ থেকে এক শতাংশে নামিয়ে আনার কথাও বলেছিলেন তিনি।

এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ- সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সফরে আলোচিত বিষয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠকেও আলোচিত হবে বলে ধারণা করা যায়। তিনি বলেন, চীনের থেকে বিপুল পরিমাণ আমদানির ক্ষেত্রে ডেফারড পেমেন্ট (বিলম্বে পরিশোধ) সুবিধা পাওয়া যায় কি না, সেটাও আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়া উচিত। কারণ, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চীনের আমদানি ব্যয় মেটাতে চলে যায়। তাই এই উদ্যোগ গৃহীত হলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে থাকা বাংলাদেশের জন্য তা স্বস্তির কারণ হবে। এদিকে চলমান প্রকল্পের জন্য নতুন ঋণ এবং নতুন প্রকল্প বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে সেটিও ইতিবাচক হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

সফরের সময়সূচি ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম
ড. ইউনূস ২৬ মার্চ দুপুরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। সফরের প্রথম গন্তব্য হবে হাইনান প্রদেশ, যেখানে তিনি বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (BFA) বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেবেন। ২৭ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য উদ্বোধনী প্ল্যানারি সেশনে তিনি মূল বক্তব্য প্রদান করবেন। ২৮ মার্চ তিনি বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন অর্থনৈতিক সহযোগিতা, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়াও তিনি চীনের স্টেট কাউন্সিলের নির্বাহী ভাইস প্রিমিয়ার দিং ঝুঝিয়াংয়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন।

সফরের অংশ হিসেবে তিনি হুয়াওয়ের গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন করবেন এবং পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণ করবেন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেবেন যেখানে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করবেন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ