নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে
আবুল কাসেম ফজলুল হক। শিক্ষাবিদ ও চিন্তক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক ‘ভিউজ বাংলাদেশ’ এর সঙ্গে কথা বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধান ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সহকারী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক।
ভিউজ বাংলাদেশ: বিভিন্নস্তরের মানুষের কাছ থেকে সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়ে কথা হচ্ছে। তারা মনে করছেন, রাষ্ট্রসংস্কার করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: সংবিধান অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের সংবিধান প্রথম রচিত হয়েছে ১৯৭২ সালে। ঘোষিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ পর্যন্ত এই সংবিধানের অনেক সংশোধন হয়েছে। ১৬ বার কী ১৭ বার সংশোধন এসেছে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য এই সংবিধান যথেষ্ট উপযোগী হলে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত সংশোধন দরকার হতো না। তা ছাড়া এটা খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় এই সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখছে। যে দলেরই প্রধানমন্ত্রী হোক, তাকে সমালোচনা করার কোনো সুযোগ এই সংবিধানে নেই। আরও নানা দিক থেকে বর্তমান সংবিধানের নানা ত্রুটিবিচ্যুতি আছে।
যে চারটি মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছিল, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র, এখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আলাদাভাবে না থাকলেই ভালো হতো। গণতন্ত্রের মধ্য দিয়েই ধর্মের বিষয়টি মীমাংসা করা যেত। জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়েও সমাধান করার উপায় আছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটা যখন সংবিধানে জাতীয় আদর্শের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে চান তারা ক্ষুব্ধ হবেন। আমি যতটা লক্ষ্য করেছি, সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ যুক্ত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে পক্ষ-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। যারা বামপন্থি ছিলেন তারা প্রবলভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সমর্থন করেছেন। তারা অকারণেই এমন কিছু কথা বলেছেন, যা মুসলিম সমাজের মধ্যে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই একটি বিষয়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, গণতন্ত্র যদি ঠিকভাবে কার্যকর হয়, রাজনৈতিক দলগুলো যদি গণতন্ত্র অনুসরণ করে, জনসাধরণ যদি গণতন্ত্রকেই আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় শ্রেষ্ঠ আদর্শ মনে করে, তাহলে শুধু গণতন্ত্র দিয়েই তো হয়। ‘জাতীয়তাবাদ’ রাখার প্রয়োজন আছে, কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আমরা এগিয়েছি। ভবিষ্যতেও ‘জাতীয়তাবাদ’ দিয়ে অগ্রসর হতে পারি। সে জন্য জাতীয়তাবাদের দরকার আছে। সংবিধানে তাই জাতীয়তাবাদের বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে রাখা দরকার। এ ছাড়াও আরও নানান পয়েন্ট আছে।
আমাদের জাতীয়জীবনে এখন যা দরকার তা ১৯৭২ সালে বোঝা যায়নি। সময় এর মধ্যে অনেক বদলে গেছে। পরিবেশ, প্রযুক্তির বদল ঘটেছে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে বৈশ্বিক পরির্তন এসেছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জাতি-রাষ্ট্রকে সফল করার জন্য কিছু সংশোধন আনতে হবে। সংবিধানে হাত দিতে গেলেই দেখা যাবে, অনেক বিষয়ই পরিবর্তন আনতে হবে। সেই জন্য সংবিধান সভার মাধ্যমে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। ক্ষমতা জাতীয় নির্বাচিত প্রতিনিধির ওপরই রাখতে হবে, কেবল বিচারকদের হাতে বা মন্ত্রণালয়ের হাতে রাখলে ঠিক হবে না।
আমার মনে হয়, এই সরকার চাইছে সবকিছু আমূল পরিবর্তন করে একটা ভালো পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। সে উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন আছে; কিন্তু এই সরকার এটা হঠাৎ করে করতে পারবেন না। তারা নির্দেশ করতে পারেন যে, এই পরিবর্তন দরকার। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই এই পরিবর্তন করা উচিত।
ভিউজ বাংলাদেশ: কেউ কেউ মনে করছেন, পুরোনো সংবিধান বাদ দিয়ে সংবিধান আবার নতুন করে লিখতে হবে। সে ক্ষেত্রে কী অন্তর্বর্তী সরকার এই সংবিধান বাদ দিয়ে নতুন করে সংবিধান লিখতে পারবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: যারা পুরোনো সংবিধান বাদ দিয়ে নতুন করে সংবিধান লিখতে চাচ্ছেন, এই চিন্তা খারাপ না; কিন্তু বর্তমান সরকারে এটা করা উচিত হবে না। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই এটা করা উচিত।
ভিউজ বাংলাদেশ: বর্তমান সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায় এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা সেটি করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে তার এই কাজ রাষ্ট্রদ্রোহি হবে এবং ওই ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী হবেন। আর এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত অপরাধে দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে (মৃত্যুদণ্ড) দণ্ডিত হবেন।’ তাহলে কি ৭(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সংবিধান পরিবর্তন করে তাহলে কী তারা পরবর্তীতে দণ্ডিত হবেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: এই সরকারের ততটা ক্ষমতা বোধহয় নেই। আমি এটা ভালো করে লক্ষ্য করিনি। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ড. ইউনূসের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন। এখন বাকিটা নির্বাচিত সরকারকেই করতে হবে। তবে, এই সরকার যদি তিন বছর চার বছর ক্ষমতায় থাকেন তাহলে কী কী পরিবর্তন আনা দরকার, তার সুপারিশ করতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা, শিক্ষাদীক্ষা অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনা করে সব করতে হবে। যারা সংবিধান রচনা করবেন তারা নিশ্চয়ই এসব দিক বিবেচনা করবেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে হবে সংবিধান সভার কাছ থেকে।
ভিউজ বাংলাদেশ: জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আজমের পুত্র সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী বলেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করতে হবে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার কথা আগেও কেউ কেউ বলেছেন; কিন্তু কোনো সরকারই এতে একমত হননি, পরিবর্তনের কোনো চেষ্টাও করেননি। জাতীয় সংগীত তো আইনত পরিবর্তনের সুযোগ আছে। কেউ তার মতামতও প্রকাশ করতে পারেন। কেউ বললেই তা হয়ে যাবে তা না। জামায়াতে ইসলামী তো একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদারকে সমর্থন দিয়েছে, এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তারা বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ, ঐক্য ও সংহতি এগুলোতে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে তারা বিরোধিতা করেছে। সেই দল থেকে এসব কথা বলা হলে অনেকে আহত হন। কথাটা কিছু যুক্তিসংগত, সবটাই যুক্তিসংগত নয়। পাকিস্তান আমলেও জামায়াত ইসলামকে নিয়ে অনেক কূটনীতি হয়েছে রাজনীতির নামে। স্বাধীন বাংলাদেশেও তা হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর তাজউদ্দীন সরকার, প্রথম বাংলাদেশ সরকার, ঘোষণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশে চারটি দল নিষিদ্ধ থাকবে- মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেযামী ইসলাম এবং পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি। কারণ এই চারটি দল কখনো পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ছিল না। বরং বিরুদ্ধে ছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগিতা করেছে। এই চারটি দল স্বাধীন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ থাকবে- এই কথাটা ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাখা হয়নি। ১৯৭২ এর সংবিধানে বলা হয়েছে, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো রাজনীতি করার অধিকার থাকবে না।
জামায়াতে ইসলাম ছাড়া আর কোনোটা কি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি? মুসলীম লীগের রাজনীতিকে কি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বলা যাবে? মুসলিম লীগের রাজনীতিও মুসলিম সম্প্রদায়ের কল্যাণে। সারা ভারতে হিন্দুদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল, মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, জিন্নাহ সাহেবের দাবি ছিল এই মুসলমানদেরও স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। জিন্নাহ নিজে তো নিরিশ্বির ছিলেন। আল্লা-খোদায় তার বিশ্বাস ছিল না। তিনি সব সময়ই বলেছেন, মোল্লা-মৌলভীর স্থান মুসলিম লীগে নেই। তারা যদি মুসলিম লীগে আসেন তাহলে আমরা আধুনিক পাকিস্তান গড়ে তুলতে পারব না।
মুসলিম লীগের মধ্যে কি আলেম সমাজ এসেছিলেন? তারা চেয়েছেন যে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা করে তারা আধুনিক ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। তাদের মধ্যে কোনো সংকীর্ণতা থাকবে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান হওয়ার পর যেদিন তিনি প্রথম গণপরিষদে বক্তৃতা দেন সেদিনই তো তিনি বলেন, হিন্দু-মুসলমানের ব্যবধানের কথা আমাদের ভুলে যেতে হবে। লিয়াকত আলী খান বলি, খাজা নাজিমুদ্দিন বলি তারা কেউই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করেননি। তবে, মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতি করেছেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে