বাজেট ২০২৫-২৬
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য বাস্তবায়নাধীন বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে বাজেটের আকার ৮ হাজার কোটি টাকা হ্রাস পাবে। আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে চলতি অর্থ বছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নতুন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা হবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
আগামী বছরের বাজেটে মেগা প্রকল্পে নতুন করে কোনো ব্যয় বরাদ্দ দেয়া হয়নি। আগামী অর্থবছর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নির্ধারণ করা হয়। চলতি অর্থ বছরে কৃষি খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তা ২০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমলে এটাই প্রথম বাজেট। কাজেই প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বেশ আগ্রহ প্রত্যক্ষ করা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাজেটে কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সেটাই ছিল আগ্রহের মূল কেন্দ্র বিন্দু। আমাদের মতো দেশে বাজেট প্রণয়ন করা বেশ কঠিন কাজ। আমি প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে সবশ্রেণির মানুষ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে।
গত তিন বছরে মূল্যস্ফীতির হার কখনোই ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। গত ১০ মাসের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল গত নভেম্বর মাসে। সেই সময় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই সময় খাদ্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার বাড়লেও মজুরির হার সেই অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি। ফলে মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে আনাটা অসম্ভব নয়, তবে কঠিন। ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হার ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল, যা ছিল বিগত ৪০ বছরের মধ্যে দেশটির সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। সেই অবস্থা থেকে তারা নানা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়।
এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত দেশ শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এক সময় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে তারা মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এখন নিগেটিভ পর্যায়ে রয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে তারা মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, আমরা এখনো মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারিনি। আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতি কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান থাকলে অর্থনীতিতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। বিনিয়োগ কমে যাবে। প্রবৃদ্ধির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ড. মোস্তফা কে মুজেরী: অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে