বাংলাদেশের কাম্যতম বহুভাষী শিক্ষা
সারাংশ: প্রতিটি ভাষা পৃথকভাবে জীবন ও জগৎকে ধারণ ও বর্ণনা করে থাকে- ত্রিশের দশকে স্যাপির-হোর্ফ হাইপথিসিসে এমনটা দাবি করা হয়েছে। এই দাবি যদি সত্য হয়, তবে বহুভাষী শিক্ষা একভাষী শিক্ষার তুলনায় কার্যকর ও সম্পূর্ণতর হবার কথা। বহুভাষী শিক্ষা ১) স্বাভাবিক (Natural/Organic) হতে পারে এবং ২) কৃত্রিম হতে পারে (Artificial)। রোমান আমলে (খ্রিষ্টপূর্ব ১ম থেকে ৫ম শতক) ল্যাটিন ভাষা-ভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল একটি স্বাভাবিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা (Natural/Organic Multilanguage Education), কারণ ল্যাটিন তখনও একটি জীবিত ভাষা। মধ্যযুগের দ্বিতীয় পর্বে (১০০০ থেকে ১৫০০) ল্যাটিন ভাষা-ভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা ছিল একটি কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা (Artificial/Imposed Multilanguage Education), কারণ ল্যাটিন তখন একটি মৃত ভাষা। আমার দাবি, স্বাভাবিক বহুভাষী শিক্ষা ব্যবস্থা যতটা সর্বজনীন ও কার্যকর শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে, কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা এই দুই কর্তব্য পালনে ততটাই ব্যর্থ হবার কথা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা হবে একটি স্বাভাবিক শিক্ষাব্যবস্থা, কারণ বাংলা সর্বসাধারণের মুখের ভাষা। সুতরাং একমাত্র বাংলাভাষা-ভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থাই সর্বজনীন ও কার্যকর শিক্ষা নিশ্চিত করতে সক্ষম। পক্ষান্তরে ইংরেজিভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা কৃত্রিম, কারণ মধ্যযুগের ল্যাটিনের মতোই ইংরেজি বাংলাদেশের সর্বসাধারণের মুখের ভাষা নয়, সম্ভবত হবেও না কোনো দিন। এই কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা সর্বজনীন ও কার্যকর শিক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ তো হবেই, তদুপরি বাংলা ভাষার ব্যবহার সীমিত করে দিয়ে এই শিক্ষাব্যবস্থা বাংলা ভাষারও চূড়ান্ত ক্ষতি সাধন করতে পারে।
ত্রিশের দশকে প্রস্তাবিত সাপির-হোর্ফ হাইপথিসিসে দাবি করা হয়েছে, প্রতিটি ভাষা তার একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জীবন ও জগৎকে ধারণ ও বর্ণনা করে। এই দাবি যদি সত্য হয়, তবে একই জ্ঞান দুটি ভিন্ন ভাষার মাধ্যমে অর্জিত হলে সেই জ্ঞান সম্পূর্ণতর হবে। তাই যদি হয়, তবে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে বহুভাষী শিক্ষা অবশ্যই একভাষী শিক্ষার চেয়ে বেশি কার্যকর হবার কথা; কিন্তু আমাদের জানতে হবে, কোন ধরনের বহুভাষী শিক্ষা, কারণ বহুভাষী শিক্ষার রকমফের আছে, শিক্ষার মাধ্যমের মধ্যে কৃত্রিমতা আছে, স্বাভাবিকতা আছে। আমার দাবি, স্বাভাবিক বহুভাষী শিক্ষাই (Natural/Organic Multilanguage Education) জ্ঞানার্জনের পদ্ধতি হিসেবে সর্বোত্তম এবং শ্রেয়তম।
কোন ভাষা সাধারণত সাহিত্য ও শিক্ষার মাধ্যম হয়ে থাকে?
একটি ভাষার চার ধরনের স্বীকৃতি থাকতে পারে: ১) সামাজিক স্বীকৃতি, ২) রাজনৈতিক স্বীকৃতি, ৩) অর্থনৈতিক স্বীকৃতি, এবং ৪) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ইংরেজি ভাষার এই চারটি স্বীকৃতিই আছে। আমার মাতৃভাষা চট্টগ্রামী, গারো কিংবা ককবরোক ভাষার একটি স্বীকৃতিও নেই। যে ভাষার অন্ততপক্ষে সামাজিক স্বীকৃতিটুকুও নেই, সে ভাষা সাধারণত সাহিত্য কিংবা শিক্ষার মাধ্যম হয় না।
১৬৪৮ সালে ওয়েস্টফালিয়া চুক্তির পূর্বে পৃথিবীতে ‘রাষ্ট্র’ বা ‘জাতিরাষ্ট্র’ বলে কিছু ছিল না। বিভিন্ন সাম্রাজ্য ছিল, কিন্তু তখনও ভাষার রাজনীতি ছিল, ভাষার স্বীকৃতির প্রশ্ন ছিল। স্বীকৃতি রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক, মাপকাঠি। মধ্যযুগে বাংলার সুলতানেরা কিংবা আরাকানের রাজারা তৎকালীন প্রমিত বাংলায় সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দিয়েছিলেন, কারণ বাংলার একটা সামাজিক স্বীকৃতি ছিল। গারো কিংবা ককবরোক ভাষা বা চট্টগ্রামী উপভাষায় সাহিত্যচর্চায় তারা উৎসাহ দেননি, কারণ এই সব ভাষা-উপভাষার সামাজিক স্বীকৃতি ছিল না, কিংবা বাংলার তুলনায় কম ছিল। ষোড়শ শতকে (১৫৩৪) মার্টিন লুথার প্রমিত জার্মানের পরিবর্তে সাধারণ মানুষের কথ্য জার্মানে বাইবেল অনুবাদ করার ফলে এই উপভাষাটির সামাজিক স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছিল। সেই কথ্য জার্মানই আধুনিক জার্মানে বিবর্তিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণে দুটি ভিন্ন ভাষা যখন পরস্পরের সংস্পর্শে আসে, তখন অধিক স্বীকৃতিবান ভাষাটিকে বলা যেতে পারে ‘উত্তমর্ণ’ বা সুপারস্ট্র্যাট ভাষা এবং তুলনামূলকভাবে কম স্বীকৃতিবান ভাষাটিকে বলা যেতে পারে ‘অধমর্ণ’ বা সাবস্ট্র্যাট ভাষা। ‘জোর যার মুল্লক তার।’ যে কোনো উত্তমর্ণ ভাষা সুযোগ পেলে প্রতিযোগী অধমর্ণ ভাষাকে রাজনৈতিকভাবে দাবিয়ে রাখতে চায়। সে শিক্ষার মাধ্যম হতে চায়, প্রশাসন ও বিচারের ভাষা থাকতে চায়। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরাও মনে করে, অধমর্ণ বাংলা নয়, উত্তমর্ণ ইংরেজিই শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত। এর মানে হচ্ছে, বাংলা ডি ফ্যাক্টো বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা নয়, বাংলাভাষার ডি ফ্যাক্টো রাজনৈতিক স্বীকৃতি নেই।
এই পরিস্থিতি অধমর্ণ ভাষা এবং এর ভাষীদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়?’ অধমর্ণ ভাষাভাষীরা সাধ্যমতো বিদ্রোহ করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে থাকে, যার প্রমাণ: ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়!’ কিংবা ‘দাবায়ে রাখতে পারবে না!’ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন চলাকালীন ফরিদপুর জেলে বঙ্গবন্ধুর অনশন-ধর্মঘট ছিল মূলত বাংলা ভাষার রাজনৈতিক স্বীকৃতি অর্জনের সংগ্রাম।
বহুভাষী শিক্ষার রকমফের
‘বহুভাষী শিক্ষা’ বলতে ৪ (চার) ধরনের ভিন্ন শিক্ষা-পরিস্থিতি বোঝাতে পারে:
ক. বহুভাষী শিক্ষা-১
এ ধরনের বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষণীয় সমস্ত বিষয়- যেমন ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ভূগোল ইত্যাদি উত্তমর্ণ ও অধমর্ণ- এই উভয় ভাষায় সমান গুরুত্ব দিয়ে শেখানো যেতে পারে। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মাধ্যম একটি নয়- দুটি ভিন্ন ভাষা। পৃথিবীর কোথাও এমন শিক্ষাব্যবস্থা আছে কি না, আমার জানা নেই। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা আদৌ সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও অসঙ্গত নয়। দ্বিভাষী মন্ট্রিয়ল শহরে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় ফরাসি, নয়তো ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেয়া হয়। ইংরেজিভাষী বিদ্যালয়ে ফরাসি শেখানো হয় একটি ভাষা হিসেবে। ফরাসিভাষী বিদ্যালয়েও ভাষা হিসেবেই ইংরেজি শেখানো হয়। এমন কোনো শিক্ষায়তন বিরল, যেখানে ইংরেজি এবং ফরাসি- উভয় ভাষায় পাঠদান করা হয়।
খ. বহুভাষী শিক্ষা-২
এ ধরনের বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার মাধ্যম একটিই থাকে, তবে শিক্ষার্থীরা এর বাইরেও একাধিক ভাষা শেখে। রোমান আমলে এবং মধ্যযুগে ল্যাটিন ছিল শিক্ষার মাধ্যম, তবে ভাষা হিসেবে গ্রিকও শেখানো হতো। আরবদেশে উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে আরবি ছিল শিক্ষার মাধ্যম, তবে গ্রিক ও ল্যাটিনও শিখতো অনেকে। রেনেসাঁ থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ইউরোপে দেশভেদে ইংরেজি-ফরাসি-জার্মান-স্পেনিশ ইত্যাদি ভাষা ছিল শিক্ষার মাধ্যম, তবে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে গ্রিক ও ল্যাটিনও শিখতে হতো।
গ. বহুভাষী শিক্ষা-৩
তৃতীয় আরেক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিজ্ঞান, অঙ্ক ইত্যাদি তথাকথিত ‘কঠিন’ বিষয় উত্তমর্ণ ভাষায় শেখানো হয়। সাহিত্য, কলা, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি তথাকথিত ‘সহজ’, বিষয় শেখানো হয় অধমর্ণ ভাষায়। মাগরেব (আলজেরিয়া-তিউনিশিয়া-মরক্কো) অঞ্চলে বিজ্ঞানের বিষয়গুলো ফরাসি ভাষায় পড়ানো হয়। কলা বা সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো কমবেশি পড়ানো হয় আরবি ভাষায়।
গ. বহুভাষী শিক্ষা-৪
এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় নিচের দিকের শ্রেণিগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম থাকে অধমর্ণ মাতৃভাষা এবং ওপরের দিকের শ্রেণিগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হয়ে যায় একটি উত্তমর্ণ ভাষা। বাংলাদেশের কয়েকটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর শিশুদের নিচের দিকের শ্রেণিতে নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে। উচ্চতর শ্রেণিতে তাদের শিক্ষার মাধ্যম হয়ে যায় বাংলা কিংবা ইংরেজি। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা হয়েছে, যেমন- আয়ারল্যান্ড এবং পেরুতে; কিন্তু সরকার ও জনগণের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও আয়ারল্যান্ডে ইংরেজির বিপরীতে আইরিশ এবং পেরুতে স্প্যানিশের বিপরীতে স্থানীয় ভাষা কেচোয়াকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি।
যে সমাজে একটি উত্তমর্ণ এবং একটি অধমর্ণ ভাষা সহাবস্থান করে, সে সমাজের লোকজন চায়, উত্তমর্ণ ভাষাটিই শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হোক। বাংলাদেশে অনেকেই ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম করার পক্ষে। যাবতীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামও রাখা হয়েছে ইংরেজিতে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার বলে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি করার পক্ষে। ইংলিশ ভার্সন যারা চালু করেছেন, তারাও বাংলা ভাষাকে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গ্রহণের পক্ষে নন।
স্বাভাবিক ও কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষা মডেল
শিক্ষার শুরু হয়েছিল পৃথিবীর যেসব এলাকায়, ধরা যাক, প্রাচীন গ্রিস, সেখানে গ্রিক ভাষাতেই পাঠদান করা হতো। প্রাচীন ভারতবর্ষে সংস্কৃত ছিল শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম। রোমান আমলে সংখ্যাগরিষ্ঠ রোমান নাগরিকের মাতৃভাষা ল্যাটিন ছিল শিক্ষার মাধ্যম; কিন্তু জ্ঞানের অন্যতম উৎস হিসেবে গ্রিক ভাষাও শেখানো হতো। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের প্রায় ৫০০ বছর পর, মধ্যযুগের ইউরোপে শিক্ষা যখন পুনরায় শুরু হলো, তখন শিক্ষার মাধ্যম ছিল ল্যাটিন, যদিও গ্রিক ভাষা তখনও শেখানো হতো।
সুতরাং ল্যাটিন দুইবার ইউরোপে লিঙ্গুয়া একাডেমিকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, একবার জীবিত ভাষা হিসেবে, একবার মৃত ভাষা হিসেবে। শিক্ষার মাধ্যম করার প্রয়োজনে ৫ম শতকে মৃত্যুর ৫০০ বছর পর ১০০০ সালে ল্যাটিনকে অনেকটা গায়ের জোরে পুনর্জীবিত করা হয়েছিল। তখন স্কুল-কলেজে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ইত্যাদি ভাষা বলা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। কালক্রমে ইংরেজি-ফরাসি-জার্মানের উত্থান ঘটে এবং ল্যাটিনের দ্বিতীয়বার মৃত্যু হয়।
রোমান আমলের জীবিত ল্যাটিনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বাভাবিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা (Natural/Organic Multilanguage Education), এবং মধ্যযুগের ল্যাটিনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থাকে কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা (Artificial/Imposed Multilanguage Education) বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যম বহুভাষী শিক্ষা হবে একটি কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষা, কারণ মৃত ভাষা না হলেও ইংরেজি বাংলাদেশে সর্বজন ব্যবহৃত কোনো ভাষা নয়।
কোন ভাষা বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত?
রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বেশির ভাগ শিক্ষাচিন্তক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার অপরিহার্যতার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ সরকারও মাতৃভাষার দাবি মেনে নিয়ে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছেন। ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষা, যেমন, গারো বা ককবরোক কিংবা চট্টগ্রামী উপভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা যাবে কি না, সে প্রশ্ন অসঙ্গত নয়, কারণ দেশে প্রচলিত সব ভাষায় শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষা প্রদানের আর্থিক সক্ষমতা রাষ্ট্রের সাধারণত থাকে না। প্রতিটি ভাষায় শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষা দেবার মতো উপকরণ, যেমন বইপত্র ইত্যাদি থাকে না এবং শিক্ষকেরও অভাব থাকে। এর মানে হচ্ছে, ইচ্ছা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাতৃভাষামাত্রকেই শিক্ষার মাধ্যম করে তোলা সম্ভব হয় না। ফলে বেশির ভাগ দেশে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে এলাকার উত্তমর্ণ ভাষাতেই শিক্ষাগ্রহণ করতে হয়।
বাংলাদেশে কিংবা যে কোনো দেশে কোন ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হবে- এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দুটি বিষয় বিবেচনায় নিতেই হবে।
১) সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা যাচ্ছে কি না, এবং
২) সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা যাচ্ছে কি না।
একমাত্র প্রমিত বাংলা যদি বহুভাষী শিক্ষার মাধ্যম হয়, তবেই উপরোক্ত দুই শর্ত পূরণ হতে পারে। পক্ষান্তরে ইংরেজি ভাষাকে যদি বহুভাষী শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষার মাধ্যম করা হয়, তবে সেটা হবে মধ্যযুগের মতো একটি কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষাপরিস্থিতি। কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থার কমপক্ষে দুটি সমস্যা আছে:
১) শিক্ষার মাধ্যম না হবার কারণে অধমর্ণ বাংলা ভাষার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে কোনো কালেই ভাষাটি শিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম হয়ে উঠতে পারবে না;
২) বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণকে কখনই এতটা ইংরেজি শেখানো যাবে না যে ইংরেজি দিয়ে সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এর অন্যতম কারণ, বাঙালি শিশু ইংরেজির ইনপুট পায় না, পায় প্রমিত বাংলা কিংবা আঞ্চলিক ভাষার ইনপুট। ইংরেজি যদিও ইংল্যান্ড-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায় জীবিত ভাষা, ইংরেজি ভাষায় যেহেতু বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগণের দখল নেই, সেহেতু এই ভাষায় সর্বজনীন এবং কার্যকর শিক্ষা প্রদান কার্যত অসম্ভব।
বাঙালি আপাতত একটি অভিবাসন-প্রবণ জাতি। বিচিত্র প্রয়োজনে সারা পৃথিবীতে বাঙালিরা ছড়িয়ে পড়ছে। জনসম্পদ রপ্তানি বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের অন্যতম উৎস। এই বিশেষ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলা এবং ইংরেজিতো বটেই, শিক্ষার্থীর প্রয়োজন ও প্রবণতা অনুযায়ী ইংরেজি ছাড়াও ভিন্ন একটি ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে। ইংরেজি-ভিত্তিক কৃত্রিম বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় বাংলাভিত্তিক স্বাভাবিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থা যে বাংলাদেশের জন্য অধিকতর কার্যকর, সাশ্রয়ী ও সর্বজনীন প্রমাণিত হবে, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
অপটিমালিটি তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের কাম্যতম বহুভাষী শিক্ষা
ধ্বনিতত্ত্বের অপটিমালিটি বা নির্বাচনবাদী তত্ত্বে ‘জেন (কারেট)’ (বাংলায় ‘সৃজন’) নামক একটি যন্ত্র বা ডিভাইস একই শব্দের বিভিন্ন প্রার্থী সৃষ্টি করে। বাস্তবে বা প্রকৃতিতে ‘কন (স্ট্রেইন্ট)’ (বাংলায় ‘সংবরণ’ বা ‘প্রতিবন্ধ’)-এর একটি বিশ্বজনীন তালিকা আছে। এই প্রতিবন্ধগুলোর মধ্যে কিছু আছে ‘মার্কড’ (বাংলায় ‘দূরতিক্রম্য’) কিছু আছে (মূলের প্রতি) ‘বিশ্বস্ত’ বা ‘ফেইথফুল’। ফনোলজির অন্য একটি যন্ত্র ‘এভাল (উয়েট/উয়েশন)’ (বাংলায় ‘মূল্যায়ন’ বা ‘যাচাই’) প্রথমত, বিশ্বস্ততা (ফেইথফুলনেস) এবং দ্বিতীয়ত, দূরতিক্রম্যতার (মার্কডনেস) নিরিখে প্রতিবন্ধগুলোকে যাচাই করে একটি ক্রমে সাজায়- সর্বাধিক বিশ্বস্ত এবং সর্বাধিক দূরতিক্রম্য প্রার্থীরা তালিকার প্রথমে অবস্থান করে। দূরতিক্রম্যতা এবং বিশ্বস্ততার প্রতিবন্ধকে যে প্রার্থী যত বেশি অমান্য করে, কাম্যতার প্রশ্নে সেই প্রার্থী তত বেশি পিছিয়ে পড়ে।
এই তত্ত্বটিকে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য কাম্যতম বহুভাষী শিক্ষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারি। একাধিক প্রতিবন্ধের কথা ভাবতে পারি আমরা। ধরা যাক, রাষ্ট্রভাষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিশ্বজনীন প্রতিবন্ধগুলো রয়েছে: প্রতিবন্ধ-১: সংখ্যাগরিষ্ঠের ব্যবহৃত ভাষা হতে হবে; প্রতিবন্ধ-২: সর্বজনীন সাক্ষরতা নিশ্চিত করতে হবে; প্রতিবন্ধ-৩: জীবিত ভাষা হবে; প্রতিবন্ধ-৪: সর্বজনবোধ্য হবে; প্রতিবন্ধ-৫: আন্তর্জাতিক ভাষা হবে; প্রতিবন্ধ-৬: ক্ষমতাসীনদের পছন্দের ভাষা হতে হবে; এবং ৭. ঔপনিবেশিক প্রভুর ভাষা হবে, ইত্যাদি। এর মধ্যে একাধিক প্রতিবন্ধ কমবেশি ‘পুনরুক্ত’ বা রিড্যান্ড্যান্ট মনে হতে পারে।
ওপরের সারণিতে গুরুত্বের বিচারে প্রতিবন্ধগুলোকে একটি ক্রমে সাজানো হয়েছে। আমরা দেখছি যে প্রমিত বাংলা কম গুরুত্বপূর্ণ বা তালিকার শেষের দিকের তিনটি প্রতিবন্ধ অমান্য করেছে, যখন কি না, অন্য প্রার্থীরা তালিকার প্রথম দিকের অর্থাৎ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একাধিক প্রতিবন্ধ অমান্য করেছে। এ কারণে অপটিমালিটি বা কাম্যতার তত্ত্বের আলোকে প্রমিত বাংলাই হবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হবার ক্ষেত্রে কাম্যতম প্রার্থী।
কী করিতে হইবে?
যে ভাষার ১) সামাজিক, ২) রাজনৈতিক, ৩) অর্থনৈতিক এবং ৪) আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আছে, সে ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করতে সাধারণত কেউই আপত্তি করে না। বাংলা ভাষার সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি আছে; কিন্তু অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নেই, অন্ততপক্ষে এখনো নেই। বাংলা ভাষা যদি খোদ বাংলাদেশেই শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত হতে হয়, তবে ভাষাটির ডি ফ্যাক্টো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকা প্রয়োজন। বাংলা শুধু নয়, যে কোনো ভাষা সর্বস্তরের ভাষা হতে গেলে এর ডি ফ্যাক্টো সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন অপরিহার্য। ভাষার দীর্ঘজীবনও এইসব স্বীকৃতির ওপরই নির্ভর করে। যে ভাষার একাধিক স্বীকৃতি নেই, সে ভাষার মৃত্যুর সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি।
রাজনীতি ও কূটনীতির ‘কড়ি (Hard) ও কোমল (Soft)’- এই দুটি দিক আছে। বাংলাদেশের কোমল কূটনীতির অন্যতম অর্জন হবে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বাংলা থেকে বিদেশি ভাষায় এবং বিদেশি ভাষা থেকে বাংলায় সাহিত্য-দর্শন-বিজ্ঞান-অর্থনীতিসহ বিচিত্র বিষয়ে বিচিত্র রচনার অনুবাদ এই কোমল কূটনীতির অন্যতম হাতিয়ার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুবাদের গুরুত্বের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তার একাধিক বক্তৃতায়। কোমল কূটনীতির অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে শান্তিনিকেতনে একটি বাংলাদেশ ভবন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, গ্যোটে ইনস্টিটিউট ও কনফুসিয়াস সেন্টারের অনুকরণে বিশ্বের বড় শহরগুলোতে বাংলাদেশ ভবন কিংবা ‘বঙ্গবন্ধু সেন্টার’ স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে বিদেশি এবং প্রবাসী বাঙালিদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষার চর্চা করবে এবং সম্ভব হলে বাংলা সাহিত্যকর্ম অন্যান্য ভাষায় এবং অন্যান্য ভাষার সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদে প্রবৃত্ত হবে। ফলে বাংলা ভাষার অসংখ্য শিক্ষক ও অনুবাদকেরও কর্মসংস্থান হবে।
জাতির ভাষা যদি জাতির উন্নয়নের সমতালে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকভাবে এগিয়ে না যায়, তবে এগিয়ে গিয়েও জাতি পিছিয়ে পড়বে। এই প্রসঙ্গে ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পিদ্যু একবার বলেছিলেন: ‘ফরাসি ভাষার উপর যদি আমরা জোর না দিই, তবে জাতি হিসেবে আমরা একেবারে ভেসে যাবো।’ ভাষা রাজনীতি ও ভাষা কূটনীতির এই বিশেষ সত্যটি অনুধাবন করেই চীন সরকার গত এক দশকে চীনা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে সারা পৃথিবীতে হাজারখানেক কনফুসিয়াস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, ভাষা হিসেবে বাংলাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ভাষাগুলোর সমপর্যায়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবার সময় এসেছে।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই করণীয় দুটি: প্রথমত, টোফেল বা আইইএলটিএসের মতো বাংলা ভাষারও একটি সর্বজনীন পরীক্ষা থাকা দরকার, বিদেশিদের জন্যতো বটেই, বাঙালিদের জন্যও। দ্বিতীয়ত, বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা (বেঙ্গলি অ্যাজ এ ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ) শিক্ষা দেবার জন্য ভাষা-শিক্ষক সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কানাডার কুইবেকের ফরাসি ভাষা আইন ১০১ অনুসারে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পদায়ন বা পদোন্নতির জন্য ফরাসি ভাষার পরীক্ষা পাশ করার বাধ্যবাধকতা আছে। ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কুইবেকে মাধ্যমিকের ডিগ্রি দেয়া হয় না। বাংলাভিত্তিক সর্বজনীন বহুভাষী শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলা ভাষার অপরিহার্যতা, সম্মান ও স্বীকৃতি বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। এই লক্ষ্যে এবং তৃতীয়ত, কুইবেকের অনুসরণে একটি বাংলা ভাষা প্রচার-প্রসার কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
উপসংহার
কোনো মানব ভাষার বিরুদ্ধে আমরা নই। ইংরেজি, উর্দু ইত্যাদি চমৎকার ভাষা। ১৯৫২ সালেও আমরা বাঙালিরা উর্দুর বিরুদ্ধে ছিলাম না; কিন্তু আমরা বাংলার পক্ষে ছিলাম, আছি, থাকবো। রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধুও বাংলার পক্ষে ছিলেন। ১৯৭০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির সভায় তার অমর বাণী: ‘যেদিন আমাদের হাতে ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকে সব কিছু বাংলায় হবে।’ ‘সব কিছু’ মানে, শিক্ষা, বিচার ও প্রশাসনের ভাষা হবে বাংলা, একমাত্র বাংলা- এক কথায় প্রজাতন্ত্রের রাষ্টভাষা বাংলা। সংবিধানেও তাই আছে। ‘বাপের কথা শুনতে হবে!’ যারা এর পক্ষে নন, তারা সংবিধানবিরোধী, ১৯৮৭ সালের বাংলা প্রচলন আইন অনুসারে ফৌজদারি অপরাধে অপরাধী এবং অবশেষে, কবি আবদুল হাকিমের (১৬২০-১৬৯০) ভাষায় ‘যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কিন্তু কোনো আবেগনির্ভর দাবি নয়। শ্রেফ নিজেদের মাতৃভাষা বলেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি আমরা করছি না। ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়!’ - এগুলো আবেগের কথা, সত্য কথা নয়। পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়নি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেছিল। তাদের এই চক্রান্ত যদি সফল হতো, তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে আমরা সংখ্যাগুরু বাংলাভাষীরা কম সুযোগ-সুবিধা কম পেতাম এবং আমরা পিছিয়ে যেতাম। বঙ্গবন্ধুসহ ভাষা আন্দোলনকারী এবং ভাষাশহীদেরা এই সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে অকুতোভয়ে জীবন দিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন।
আমরা এও জানি, ‘মাতৃভাষা’, ‘নেটিভ স্পিকার’ ইত্যাদি কুসংস্কার বা রূপকথা মাত্র। উত্তর ঔপনিবেশিক শোষণের একেকটি হাতিয়ার এগুলো। তথাকথিত মাতৃভাষা ইংরেজি হলেই যে কেউ ইংরেজি ভাষা ভালো পড়াবে- এটা কোনো যুক্তির কথা নয়। ল্যাটিন ভাষার সেরা ব্যাকরণ যারা লিখেছিলেন, তাদের অনেকেরই মাতৃভাষা ল্যাটিন ছিল না। ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত বৈয়াকরণ ওটো ইয়েসপারসনের মাতৃভাষাও ইংরেজি ছিল না। শুনেছি, চীনে ব্রিটিশ/আমেরিকান ইংরেজি শিক্ষক, অন্য ককেশিয়ান ইংরেজি শিক্ষক এবং রঙিন চর্মের ইংরেজি শিক্ষকের বেতন এক নয়। নেটিভ স্পিকারের কুসংস্কার চালু থাকলে ইংরেজ ও আমেরিকানদের ক্ষমতার ছড়ি ঘোরাতে এবং ভাষাশিক্ষকের চাকরি পেতে সুবিধা হয় বৈকি।
আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাই, কারণ প্রথমত, আমরা নিরুপায় এবং দ্বিতীয়ত, উজানে আমরা দেখেছি, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করাই কাম্যতম সিদ্ধান্ত। ইংরেজি যদি রাষ্ট্রভাষা হয়, তবে শিক্ষা, বিচার ও প্রশাসন সর্বাধিকসংখ্যক জনগণের কাছে সহজলভ্য হবে না। ইংরেজি দিয়ে শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিত করা যাবে না। প্রশ্ন হতে পারে: শতভাষা সাক্ষরতা কেন অপরিহার্য? শতভাগ সাক্ষরতা নিশ্চিত করা না গেলে বিচিত্র প্রতিভার স্ফ‚রণ হবে এবং দেশের সার্বিক এবং টেকসই উন্নয়ন ব্যহত হবে। জাতিকে যদি এক শতক ছায়া দিতে চাও, তবে বৃক্ষরোপণ করো। যদি জাতিকে সহস্রাধিক বৎসর ধরে ছায়া দিতে চাও, তবে ‘শিক্ষারোপণ’ করো, অর্থাৎ শিক্ষাবিস্তারে মনোযোগী হও।
আমাদের মনে রাখতে হবে, পুরাতন পাথরের যুগ, নতুন পাথরের যুগ, ধাতু যুগ, বারুদ যুগ শেষ হয়ে মানবজাতি আক্রমণ ও প্রতিরক্ষার নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে: তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। কমপিউটারের একটি বোতাম টিপে আপনি শত্রুর অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র অকেজো করে দিতে পারেন। এই যুগে শিক্ষাই অন্যতম প্রতিরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন। সৈনিকের সংখ্যা বাড়াতে হলে সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সুতরাং বাংলাকে বহুভাষী শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম করতে হবে এবং শিক্ষায় বাজেট বাড়াতে হবে।
শতভাগ সর্বজনীন ও কার্যকর শিক্ষা নিশ্চিতকরণ করা দেশ ও জাতির উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। এই লক্ষ্য অর্জনে বাংলা ভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প নেই। এর মানে এই নয় যে উত্তমর্ণ ইংরেজি ভাষার ক্ষমতা ও দাবিকে অস্বীকার করতে হবে। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা হিসেবে কার্যকরভাবে ইংরেজি শেখাতে হবে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় শেষ হবার আগেই। বাংলা ও ইংরেজিতে লিখতে ও পড়তে না জেনে, পুস্তক পাঠে আগ্রহী না হয়ে এবং নিজের সংস্কৃতি অনুশীলন না করে কেউ যেন উচ্চমাধ্যমিকের চৌকাঠ পার হতে না পারে। আমার দুঃখজনক অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের বেশির ভাগ স্নাতক-শিক্ষার্থীর এই যোগ্যতাগুলো নেই, যার মানে হচ্ছে, কোথাও একটা শুভঙ্করের ফাঁকি থেকে যাচ্ছে।
বাঙালি, বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার স্বার্থ অভিন্ন। শিক্ষাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার ব্যতীত বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের কার্যকর ও টেকসই উন্নতি যে অসম্ভব- এই সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রবন্ধের ইতি টানছি।
লেখক: ভাষাবিদ ও অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে