ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেও বাংলাদেশ কেন খাদ্য অনিরাপদ দেশ?
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানি বরার্ট ম্যালথাস তার বিখ্যাত জনসংখ্যা তত্ত্বে বলেছেন, ‘একটি দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে।’ অর্থাৎ ১, ২, ৪, ৮, ১৬ এভাবে লাফিয়ে। আর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে- ১, ২, ৩, ৪, ৫ এভাবে ক্রামান্বয়ে। জনসংখ্যার মতো শিল্প উৎপাদনও বাড়ে জ্যামিতিক হারে। তাই কোনো দেশের কার্যকর ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবার আগে শিল্প উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। শিল্প উৎপাদনের একটি দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে জনগণের খাদ্য চাহিদা আমদানির মাধ্যমেও মেটানো যাবে। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী এখনো সমাদৃত; কিন্তু বাংলাদেশের মতো কোনো কোনো অপার সম্ভাবনাময় দেশ প্রমাণ করেছে যে, সবার ক্ষেত্রে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব সঠিক নয়। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছে, সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী কৃষক সুযোগ পেলে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে পারে।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ধান উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন। সেই সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। গত ৫৩ বছরে দেশের অনেক আবাদি জমি চাষের বাইরে চলে গেছে নানা কারণে, বিশেষ করে বাড়ি-ঘর নির্মাণ ও অবকাঠামো তৈরির জন্য। বর্তমানে দেশে জমির পরিমাণ হচ্ছে ১ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার হেক্টর। মাথাপিছু জমির পরিমাণ মাত্র শূন্য দশমিক ০৯ হেক্টর। দেশের মোট জমির ৭৬ শতাংশ বা ১ কোটি ১২ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমি অবক্ষয়ের শিকারে পরিণত হয়েছে। ১ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার হেক্টর বা মোট জমির ৭৯ শতাংশ জমিতে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক জৈব সারের অভাব রয়েছে। তা সত্ত্বেও বর্তমানে ধানের উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ বর্ণিত সময়ে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আড়াই গুণ আর খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ।
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবেই কৃষিপ্রধান দেশ। এখানকার মানুষের অতীতকাল থেকেই কৃষির মাধ্যমে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পাকিস্তান আমলে এই অঞ্চলের মানুষের ৮০ শতাংশই গ্রামে বাস করত। অর্থনীতির সিংহভাগজুড়েই ছিল কৃষি। জাতীয় অর্থনীতির ৮৫ শতাংশের মতো আসত গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থা থেকে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আমাদের দেশের কৃষকদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নেই। তারা উত্তরাধিকার সূত্রে কৃষিজীবী। এক সময় আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থার কথা বলতে গেলেই দুটি শীর্ণ গরু। একটি কাঠের লাঙল, একটি শীর্ষ জোয়াল এবং ততধিক শীর্ণ একজন কৃষকের ছবি আমাদের সামনে ভেসে উঠতো। সেই শীর্ণকায় কৃষকই আবহমান কাল থেকে আমাদের জন্য খাদ্যের জোগান দিয়ে চলেছেন। এখন গ্রামের কৃষি ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সেই মান্ধাতার আমলের শীর্ণ কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে এখন কৃষকরা ক্রমেই যান্ত্রিক চাষাবাদের দিকে ধাবিত হয়েছেন। কৃষি যান্ত্রিকায়নের ফলে কৃষকের পরিশ্রম যেমন কমেছে, তেমনি উৎপাদন বেড়েছে।
বর্তমানে গ্রাম থেকে মানুষের শহরমুখী অভিবাসন বেড়েছে। বর্তমানে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশই শহরে বাস করে। আর জাতীয় অর্থনীতিতে শহরের অবদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ শতাংশের মতো। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের নিরন্তর পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। আগে গ্রামে যে সব বিত্তবান পরিবার বাস করত, এখন তাদের অনেকেই নিঃস্ব হয়ে জমি জমা বিক্রি করছেন। আর সেই জমি ক্রয় করছেন এমন সব মানুষ, যারা আগে ছিল বিত্তহীন। কিছু দিন আগে আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সকালবেলা আমি জমি দেখার জন্য মাঠে যাই। সেখানে একজন বয়স্ক ব্যক্তি আমাকে সালাম দেন। তিনি বলেন, মামা আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি কিছু বলার আগেই নিজ থেকে তিনি বলেন, আমি আপনাদের বাড়িতে ‘রাখাল’ ছিলাম। আমি তখন তাকে চিনতে পারি। তিনি আরও বলছেন, আমরা ছেলে আপনাদের এই জমি ক্রয় করেছে। তিনি আরও জানালেন, আমার ছেলে বিদেশে গিয়ে বেশ কয়েক বছর ছিল। ভালো টাকা ইনকাম করেছে। আমি তাকে আশীর্বাদ করলাম। এভাবেই গ্রামীণ অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার গ্রামকে শহরে রূপান্তর করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকালে; কিন্তু তার আগেই বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রাম শহরের সুবিধায় আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ শহরে যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, গ্রামে এখন সেসব সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। একটি জনপদকে উন্নত এবং কর্মচঞ্চল করতে হলে পাকা সড়ক এবং বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হলেই চলে। আর কিছু তেমন একটা দরকার হয় না। এখন গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই ফ্রিজ, টেলিভিশন দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামের মানুষ এখন শহরের মতোই বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করছে। বাংলাদেশ এখন কার্যত শহরায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তা জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশি। বাংলাদেশ এখন খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হবার কথা; কিন্তু তা হচ্ছে না। বরং বাংলাদেশ খাদ্য অনিরাপদ দেশে পরিণত হতে চলেছে।
ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন (এফএও) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে,বাংলাদেশ এ বছর রেকর্ড পরিমাণ দানাদার খাদ্য উৎপাদন করা সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পতিত হতে পারে। অনেকেই অজ্ঞতাবশত খাদ্য নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য শব্দ দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। আসলে এই দুটি শব্দের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। নিরাপদ খাদ্য অর্থ হচ্ছে এমন খাদ্য, যা মানব দেহের জন্য নিরাপদ। মানব দেহের জন্য কোনো রকম ক্ষতি বা সমস্যার সৃষ্টি করলে সেটা অনিরাপদ খাদ্য। আর খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছে সবার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা। কাজেই খাদ্য নিরাপত্তা এবং নিরাপদ খাদ্য শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহার করা মোটেও ঠিক নয়। এফএও বলেছে, বাংলাদেশ চলতি মৌসুমে বিপুল পরিমাণ দানাদার খাদ্য উৎপাদন করলেও তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকবে সোয়া কোটি মানুষ। সংস্থাটি আরও বলছে, বাংলাদেশ চলতি বছর আগের বছরের তুলনায় ৭ লাখ ৯৩ হাজার টন বেশি খাদ্য আমদানি করবে। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ ৩ কোটি ১০ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদিত হতে পারে। সংস্থাটি মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে পরিচালিত জরিপে প্রমাণ পেয়েছে যে, এ বছর বাংলাদেশের ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ চরম খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগতে পারে। এই খাদ্য নিরাপত্তা অবস্থার সৃষ্টি হবে মূলত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবার কারণে। বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যের উপস্থিতি থাকলেও মানুষ সেই খাদ্যপণ্য ক্রয় করতে পারবে না উচ্চমূল্যের কারণে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাজারে খাদ্যপণ্যের উপস্থিতি থাকলেও তা ক্রয় করতে না পারলে দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। বাজারে খাদ্য পণ্যের অভাব থাকলেই শুধু দুর্ভিক্ষ হয় না। ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলেও দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলায় সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয় ১৯৪৩ সালে এবং ১৯৭৪ সালে। ব্রিটিশ সরকারের একজন সচিব আবুল কালাম আজাদ তার গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলেন, ১৯৭৩ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয়, তার পেছনে খাদ্যাভাব যতটা না দায়ী ছিল তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। সেই সময় বাজারে মাত্র কয়েক সপ্তাহের খাদ্য পণ্যের অভাব ছিল। সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। ইংরেজ সৈন্যরা কলকাতায় এসে উপস্থিত হয়। সেই সৈন্যদের জন্য বাড়তি খাদ্য ক্রয় করতে হচ্ছিল সরকারের। এতে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ আতঙ্কিত হয়ে যার সামান্য খাদ্য প্রয়োজন, সেও বিপুল পরিমাণ খাদ্য ক্রয় করতে শুরু করে। পুরো বাংলার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে খাদ্য সংকটকে বাড়িয়ে দেয়। খাদ্যাভাবে লাখ লাখ মানুষ মারা যেতে থাকে।
১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে তার পেছনে খাদ্যে অভাব যত না দায়ী ছিল, তার চেয়ে বেশি দায়ী ছিল খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়া। এক শ্রেণির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা খাদ্যপণ্য বাজার থেকে উধাও করে দেয়। মজুরদারি বেড়ে যায় প্রচণ্ডভাবে। ফলে মানুষ না খেয়ে মারা যেতে থাকে। নেতৃস্থানীয় পর্যায় থেকে কেউ কেউ গত মার্চ মাসে বলেছিলেন, দেশে দুর্ভিক্ষ ঘটানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের এই বক্তব্য কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। দেশে বর্তমান কোনো খাদ্য ঘাটতি নেই ঠিকই; কিন্তু খাদ্য সরবরাহ এবং জনগণের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারে সমস্যা রয়েছে। সরকারি উদ্যোগে বাজারে ক্রিয়াশীল বিজনেস সিন্ডিকেট ভেঙে দেবার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে। কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান। তাই সময় থাকতে সতর্ক হতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে