উদ্বোধনী সংখ্যা ১ : স্মার্ট বাংলাদেশের পথে যাত্রা
উন্নয়নশীল উন্নয়ন পরিকল্পনা
টেকসই উন্নয়নের জন্য উন্নয়নশীল পরিকল্পনার প্রভাবক ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তা থেকে যেমন কাজের উৎপত্তি, বৃক্ষের পরিচয় যেমন তার ফলে- তেমনি পরিকল্পনার উদ্দেশ্য বিধেয়র মধ্যে অর্থবহ উন্নয়নে সদিচ্ছার সংশ্লেষ থাকলেই বলা যাবে সে উন্নয়নে সুফল মিলবেই। সে নিরীখে এভাবে যদি আমরা ভাবি, একটি জাতির দূরদর্শী পরিকল্পনায় ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা থাকলে উপযুক্ত উপাদনের অভাব হেতু সেখানে যদি কোনো বিচ্যুতি ঘটে, তাহলে উন্নয়ন ভিন্নমুখী হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকে আসি বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, এটি কৃষিনির্ভর দেশ, ফল-ফসলের দেশ। এ দেশের আমজনতা শান্ত, এবং যখন প্রয়োজন তখন তারা সংগ্রাম করে নইলে তারা সবসময় শান্তিপ্রিয়, সেই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছিলেন, তারা বিষয়টিকে বুঝেছিলেন, বুঝেছিলেন বলেই তারা প্রথমেই সংবিধান প্রণয়নে মন দেন। কারণ তারা অবগত ছিলেন ২৪ বছরে পাকিস্তানে শাসনতন্ত্র তৈরি করার বিতর্ক নিয়েই শেষ পর্যন্ত তাদের সংসার টেকেনি।
সুতরাং প্রথমেই শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব সহকারে সন্নিবেশ করা হলো। যদি ওই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থেকে পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় পরিচালনা, পরিকল্পনাগুলো সেভাবে চলত তাহলে বাংলাদেশ আরও অগ্রসর হতে পারত। বঙ্গবন্ধু সে সময় সবুজ বিপ্লবের কথা বলেছিলেন; কিন্তু বাংলাদেশ সে পথে হাঁটেনি। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেয়া হলো, তার যে উদ্দেশ্য-বিধেয় সেখানে খুব স্পষ্ট ছিল যে এ দেশ এবং অর্থনীতি কোনদিকে যাবে; কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনে যারা ছিলেন তারা কিন্তু বিষয়টিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে গেছেন। কারণ তারা সবাই ছিলেন রাশিয়া বা সেখান থেকে পড়াশোনা করা লোক, তারা দেশকে সমাজতন্ত্র বা এরকম একটা পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে চাইলেন, সেটা অন্যদিকে চলে যায়। পরে প্রধান যে সমস্যাটা দৃশ্যমান হয়েছে একটি নদীমাতৃক দেশ, কৃষিপ্রধান দেশ তার থাকবে নদী, সে অববাহিকায় গড়ে উঠবে বন্দর, নগর, শহর, স্রোতশীল নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, নদীর মাছ খেয়ে তার পুষ্টির জোগাড় হবে, সে নদীর পানি দিয়েই দুধারে ফসল উৎপাদন করবে; কিন্তু আশির দশকে এসে যে সরকার এলো তার মাথায় ‘অবৈধ সরকার’ এর বদনাম ঘোচাবার বুদ্ধি। তৎকালীন সময়ের নীতিনির্ধারকরা বললেন আপনি বরং বিদেশ থেকে সাহায্য নেয়া শুরু করেন। দেশের সম্পদ দেশে রেখে এর মাধ্যমে অবকাঠামো গড়ে তুলে আপনি পারবেন না। এতে আপনার অবৈধতার বদনাম যাবে না, এবং আপনি উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারবেন না। তখন তিনি বৈদেশিক সাহায্যের দিকে হাত বাড়ালেন এবং হাত এমনভাবে বাড়ালেন যে তখনকার সময়ে সে এক দশকে বাংলাদেশের এডিপির ১০২ শতাংশ বিদেশি সাহায্যের দ্বারা বাস্তবায়িত হতো।
ফলে সে সময় অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে, এনবিআর আর কর বিভাগকে মানুষের উপার্জনের উৎসের কাছে নিয়ে গিয়ে তাদের কাছ থেকে কর আহরণ আয় করতে হবে এ দিকে মোটেই যাওয়া হলো না। এদিকে বিদেশি সাহায্য দেয়া-নেয়ার নাম করে বিদেশি সাহায্যদাতাদের প্রধান দেশগুলো থেকে বলা হলো ঠিক আছে লোন এমনকি গ্রান্টও দেয়া হবে, তবে তা দিয়ে রাস্তা তৈরি হবে, সেতু নির্মিত হবে, এসব অবকাঠামো তৈরিতে কৃষিজমি ব্যবহৃত হবে, খাল বিল ভরাট হবে। প্রচুর রাস্তা তৈরি হলো। রাস্তা তৈরি করার মানে হচ্ছে ওই নদীর পানিপ্রবাহ, খাল-বিলের পানিপ্রবাহ এগুলো সব বাধাপ্রাপ্ত হলো। ফলে দেখা গেল নদীগুলো আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং নদীগুলো সংস্কার হচ্ছে না। ফলে হঠাৎ বৃষ্টি এসে বন্যা হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জলবায়ুর তারতম্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে বেশি বেশি সড়ক বানানোর জন্য। সবাই ওই সড়কের দিকেই ধাবিত হলো, মানুষ আর নৌপথে চলাচল করতে চায় না। ফলে নদীর প্রতি আগ্রহ, আকর্ষণ ও নদীর নাব্য রক্ষার দায়িত্বে গাফিলতি চলে এলো। সড়ক পথ তৈরিতে বিদেশিরা যে সাহায্য দিয়েছিল, তারা চেয়েছিল যে এমন একটা সড়ক প্রধান দেশ হোক যেখানে প্রচুর গাড়ি ব্যবহার হবে। গাড়ির রপ্তানিকারক ডোনাররা চান মানুষ গাড়ি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকবে; কিন্তু গাড়িতে চড়ার অর্থনীতিতে তার যে নিজস্ব শক্তি সেটা অর্জনের জন্য তার মন মাথা ঘুরে গেল। মানে প্রচুর রাস্তা তৈরি হলো এবং কৃষিজমি নষ্ট হলো। নদী, খাল-বিলের পানি প্রবাহ নষ্ট হলো। এবং গ্রামের মানুষ খুব সহজে শহরে আসার দিকে ধাবিত হলো। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হয়েছে এবং গ্রামের উন্নতির দিকে মন দেয়ার দরকার নেই। অফিসারদের ফ্যামিলি মহানগরে থাকে, মফস্বলের শহরে তাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে না, চিকিৎসা নেয় না। পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়নে যে বিভ্রাট ভর করল, নীতি নির্ধারকের মাথায় তা হলো নদীমাতৃক দেশে, কৃষিমাত্রিক দেশে নদীর প্রতি খেয়াল রাখার প্রয়োজনীয়তা উবে গেল।
নদীমাতৃক যাতায়াত, যোগাযোগ ব্যবস্থায় শান্ত সুনিবিড়ে স্বাস্থ্যসম্মত সবকিছু করা সম্ভব ছিল। এখন সড়কে দামি জ্বালানি ব্যয় হয় এবং অহরহ দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ে বেশুমার। গাড়ির একচেটিয়া এক ব্যবসায়ী যখন নিষ্ফল উপদেশ বিলান ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’ তখন নদীর কান্না কি কেউ শুনতে পায়? শত শত সেতু যখন উদ্বোধন হয় তখন ছোটবড় নদীগুলোর কপাল পুড়ে, নদী শুকিয়ে যায় নাব্য তো হারায়ই। নদীগুলোর নাব্য রাখতে সেতু না বানিয়ে আধুনিক ও অধিক সংখ্যায় ফেরি দিলে পরিবেশ বাঁচে, জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হয়। পরিকল্পনা প্রণয়নকারী নীতি নির্ধারকরা হিসাব কষে দেখতে পারেন, সড়ক-সেতুপথ এর চাইতে নদীপথ ব্যবহারের ইন্টার্নাল রেট অব রিটার্ন অবশ্যই বেশি। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক ফাপড়ের মধ্যে পড়ে যায় আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানি উজানে সরানোর মতলবে ফারাক্কায় আটকানো পানির হিস্যা চাওয়া-পাওয়ার বেলায়। পুরো পাকিস্তান আমলে বিশ্বব্যাংকের লোন নিয়ে ভারত যে ফারাক্কা বাঁধটা বেঁধেছিল, সে ফারাক্কা বাঁধ কিন্তু তারা পাকিস্তান আমলে কার্যকর করতে পারেনি। কারণ কৌশলগতভাবে পাকিস্তান তাদের সিন্ধু নদীতে বাঁধ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এ ধরনের কথা বলাতে এর ভেতর দিয়ে পাকিস্তান কিন্তু ভারতের গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার ব্যাপারটি আটকে রেখেছিল। এটা কিন্তু এরকম ছিল না যে ভারত ফারাক্কায় পানি আটকে দিলে বেচারা পূর্ব পাকিস্তান শুকিয়ে যাবে, কষ্ট হবে এ কথা ভাবার চেয়ে পাকিস্তান ভেবেছিল ভারতকে যেভাবে হোক একটু আটকালে তাদের উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে নেগোশিয়েট করতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঙ্গার পানি বণ্টন প্রশ্নে বেশ নাজুক অবস্থায় উপনীত হয়। ১৯৭২ সালে এক সপ্তাহের জন্য ভারত পরীক্ষামূলক ফারাক্কা বাঁধ চালু করলেও সে চালু আর বন্ধ হয়নি, ১৯৯৬ সালের আগে পানি ভাগাভাগির কূল-কিনারা হয়নি, যখন ভাগাভাগি হলো তখন বাংলাদেশের নদী আববাহিকা ভাগ্যাহত এবং ফারাক্কার উজানে দেয়ার মতো পানি প্রবাহ নেই বললে চলে। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানী ফারাক্কা অভিমুখী লংমার্চ করেন। এটিই ছিল বাংলাদেশ থেকে প্রথম এবং শেষ রাজনৈতিক প্রতিবাদ।
ভারতের ফারাক্কায় এবং তিস্তা নদীর পানি উজানে আটকানোর ফলে ভাটিতে নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ মরুভূমির মতো পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের প্রমত্তা পদ্মা নদীতে শুকনা মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় নাব্য হারিয়ে যায়, যাতায়াত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট হয় এবং এমনকি পদ্মা ও তিস্তার শাখা নদীগুলো (যা বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৬৫ শতাংশ অঞ্চল এর অববাহিকা) পানিশূন্য হয়ে ভরাট হয়ে বর্ষা মৌসুমে অস্বাভাবিক পানি প্রবাহের কারণে এতদাঞ্চলের জীব বৈচিত্র্যের জন্য হুমকি ও অমানবিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। জিকে ও তিস্তা ইরিগেশন প্রজেক্টের আওতায় পানি ব্যবস্থাপনার যে ব্যবস্থা ছিল, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি করেও এবং তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকায় শুষ্ক মৌসুমে হিসাবের পানিও মেলে না আর ভরা বর্ষায় অস্বাভাবিক পানি প্রবাহে ভেসে যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের কথা মাঝে মধ্যে শোনা যায় কিন্তু এগুলো আসলে কার্যকর করা যায় না। ফলে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ক্রমেই দেউলিয়া হতে চলেছে। মধুমতি বা অন্যান্য নদীর মিষ্টি পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের লোনা পানি আরও ওপরে এসে পুরো সুন্দরবনসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে। ভারতের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অনুমতি না মিললেও বাংলাদেশের সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে।
সুন্দরবন কিন্তু অনেক ছোট হয়ে গেছে, সুন্দরবনের ওপর একটি বই আমি সম্পাদনা করেছি। সেখানে দেখেছি এক-তৃতীয়াংশ ভারতের ভাগে পড়া সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বরং বেড়েছে আর বাংলাদেশের ভাগে যে দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে সেখানে গত কয়েক দশকে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে। ফারাক্কার প্রভাবে প্রাকৃতিক রক্ষা ঢাল সুন্দরবনের বিপর্যয়, পশ্চিম বঙ্গের নৌপথ ও বন্দর বিনষ্ট এমন কি আসাম ও বিহারে অকাল ও অস্বাভাবিক বন্যার কারণ সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কা যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারক ভূরাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখা দেয়, তখন আন্তর্জাতিক নদীর গঙ্গার পানি বণ্টনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ ও নেগোশিয়েশনের সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যায়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দ্বারা বাংলাদেশের পুরো পরিবেশ পরিস্থিতিতে গঙ্গা তিস্তার খারাপ প্রভাব নিয়ে প্রতিবাদ স্তিমিত হলেও এখন খোদ ভারতের আসাম, বিহার এবং অন্যান্য রাজ্য ও অঞ্চল থেকেও ফারাক্কা ভেঙে দেয়ার দাবি উঠেছে। কারণ ফারাক্কার ওখানে পলি জমে। এ প্রসঙ্গে যেটা বলার চেষ্টা যে দূরদর্শী পরিকল্পনার অবর্তমানে প্রকৃতিকে প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের তরফে কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সমস্যার প্রতি করনীয় ভূমিকা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সুষ্ঠু ও দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে। এসব কারণে প্রকৃতির সঙ্গে মিল রেখে যদি বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা না নিতে পারে বা বিলম্ব করে তার খেশারত দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে না হলেও কিংবা এখন এটা স্বাভাবিক মনে হবে যে, যেহেতু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি কোথাও যাওয়ার অবকাঠামো গড়ে উঠছে, আপাতত সবকিছু ঠিক মনে হচ্ছে; কিন্তু আখেরে গিয়ে বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতি ও অর্থনীতির স্বয়ম্ভরতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও তার কার্যকারিতা হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন খুব স্পেসিফিকভাবে বলা যায় এই যে প্রচুর সেতু বানানো হচ্ছে, সেতু কোথায় বানানো হয়? নদীর ওপর। নদীর ওপর সেতু বানানো হয়, কীভাবে বানানো হয়, যেভাবেই হোক দেখা যাচ্ছে যে ওখানে নদীর পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এই যে ছোট-বড় নদী এসবের পানি প্রবাহের পথ কিন্তু থেমে যাচ্ছে। এবং সেতুর ওপর দিয়ে সহজে পার হওয়ার জন্য মানুষ কিন্তু নিচের নদী বা খালটার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ছে।
অমনোযোগী হয়ে যাওয়াতে সেগুলো আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি এখানে এরকম হতো, সেতু না থেকে যদি পর্যাপ্ত ফেরি থাকত, দ্রুত ও নির্বিঘ্নে পারাপারের ব্যবস্থা থাকত তাহলে কীভাবে নৌপথ নাব্য থাকতে পারে, সেভাবে নদীর ওপর নজর বাড়ত; কিন্তু সেতু বানানোতে একদিকে যেমন পানি প্রবাহে প্রভাব পড়ছে, আরেকদিকে খাল-বিল, মৎস্যের আধার, সেচের আধার এসব কিছুর প্রতি রাষ্ট্রের মনোযোগ কমে যাচ্ছে। সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য বাংলাদেশে সরকার কর্তক ধার কর্জ করে হলেও প্রচুর সেতু বানানো হচ্ছে–এসব সেতু বানাতে বিদেশিরা টাকা দিচ্ছে যাতে তাড়াতাড়ি সেতু হয়, সে টাকা বেহাত হয়ে পাচার হয়ে বিদেশে যাচ্ছে, আগে চট্টগ্রামে যেতে মেঘনা গোমতিতে দুটি ফেরি ছিল, জাপানিরা রীতিমতো অনুদানের টাকায় মেঘনা গোমতি সেতু বানিয়ে দিল। খুব ভালো কথা কুমিল্লা চট্টগ্রাম যাতায়াতে সুবিধা বাড়ল; কিন্তু সেতু বানানোর পর পরিবেশবান্ধব নৌপথ নদী ও রেল যোগাযোগের প্রতি অমনোযোগিতা বেড়ে গেল। মেঘনার উজানে সুরমা, কুশিয়ারা নাব্য হারিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসব নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে সিলেটে সাম্প্রতিককালে বড় বড় বন্যা হয়, এগুলো হতে থাকবে এবং আরও সমস্যা হবে। আরও একটা উদাহরণ দেই, খুব বাস্তব উদাহরণ, আমি প্লানিং কমিশনে সদস্য ভৌত অবকাঠামো হিসেবে যোগ দেয়ার এক মাসের মাথায় একটা প্রকল্প এলো, হাতিরঝিল প্রকল্প। সেখানে বলা হলো রামপুরা থেকে সোনারগাঁও হোটেলের লিংক রোড পর্যন্ত একটা বড় ফ্লাইওভার হবে। সোনারগাঁও হোটেলের ওখান থেকে ফ্লাইওভারে উঠে সবাই সহজে সরাসরি রামপুরা যাতায়াত করতে পারবে, এতে মগবাজারসহ তৎসংলগ্ন এলাকায় ট্রাফিক জ্যাম কমবে; কিন্তু আমরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্ন রাখলাম যে ঝিলের ওপর দিয়ে ফ্লাইওভার হলে তার নিচে ঝিলের পচা গলা পানির কি হবে, তারা বলল সেটা ওভাবে থাকবে। অর্থাৎ, ওপর দিয়ে যখনই ফ্লাইওভার বানাব, তখন নিচের পানি নষ্ট হয়ে গেল না কি হলো ওর প্রতি কারও কোনো নজর থাকবে না।
ফলে মরে যাবে ঝিল। ধানমন্ডি লেক এর সঙ্গে হাতিরঝিলের এক সময়কার সংযোগ, হাতিরপুলের খাল, ধোলাই খাল এমনি আরও কত পানির আধার হারিয়ে গেছে। তৎকালীন যিনি উপদেষ্টা ছিলেন যিনি পূর্ত মন্ত্রণালয় বা ভৌত অবকাঠামো এসব বিষয় দেখতেন মরহুম আনোয়ারুল ইকবাল তিনিসহ আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বললাম, না তা হবে না, পরিবেশবাদীদের কথা আমাদের ঢাকা শহরে একটা পানির আধার থাকতে হবে, আমাদের এ খাল রীতিমতো ধানমন্ডির ওই লেকের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এটা গুলশান, বনানী, বেগুনবাড়ী হয়ে ওই পাড়ে বালু নদীতে পড়েছে, এভাবে মোগল আমল, ব্রিটিশ আমলে খাল ছিল। আশির দশকে সরকার স্টর্ম ওয়াটার প্রজেক্ট নিয়ে ধানমন্ডির সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে পান্থপথের ওপর দিয়ে যে রাস্তা বানিয়েছে, হাতিরঝিলের পাশের হাতিরপুলের খালও বন্ধ হয়ে গেল। ধোলাইখালের ওপর দিয়ে রাস্তা হয়ে গেল। ওই নদী এবং খালগুলোর ওপর দিয়ে প্রচুর রাস্তা বানানো হলো, অর্থাৎ খালগুলোকে শেষ করে দেয়া হলো। একটা শহরে যতটা পরিমাণ পানির আধার থাকতে হয় ঢাকা শহরে সে ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। আমরা হাতিরঝিলের ব্যাপারে বললাম যে, এ পানির যে আধার রাখতে সেখানে প্রয়োজন হলে আরও খনন কর। এখানে মগবাজারসহ অন্য এলাকা থেকে যত ড্রেন আছে, সেগুলো বন্ধ করে দিন। এগুলো বন্ধ করে পুরো একটা পানির আধার বানান। সেই মাটি দিয়ে চারদিক দিয়ে সার্কুলার রোড বানিয়ে দিন, ওয়াকওয়ে ও গাছের বেষ্টনী বানিয়ে দিন, তাহলে মানুষ এখানে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারব, পানিটাও ভালো থাকবে, টল টলে পানির লেকে হালকা নৌযানে মানুষ যাতায়াত করতে পারবে। লেক থাকবে এবং আস্তে আস্তে এটি গুলশান ২ পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হবে। মাত্র ২০/২৫ দিনে বুয়েটের ইঞ্জিয়াররা আমাদের ভাবনা মতো সুন্দর ডিজাইন নিয়ে এলেন। তাদের সৃজনশীলতা ও নিষ্ঠাকে এখনো সানন্দ্যে অভিবাদন জানাই। লেক ও এর সকল পাড়ে জমির মালিকানা-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে মাত্র ৩ মাসের মাথায় হাতিরঝিল প্রকল্প একনেকে পাস হয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে, নিরপেক্ষ সরকারের সময়েই প্রকল্পের ৮০ ভাগ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল।
পরিকল্পনা মতো কিছু কাজ এখনো বাকি থাকলেও এটি উদ্বোধন করে সবাই এখন এটির সুফল উপভোগ করছে। ওখানে কিন্তু পরিকল্পনা নেয়া আছে, এটি গুলশান-২ পর্যন্ত যাবে, গুলশান থেকে মানুষ নৌপথে মগবাজারে এসে নামবে। এতে ওপরের রাস্তার ট্রাফিক অনেকটা কমে যাবে। আরেকটা হচ্ছে রামপুরা, মগবাজার যাওয়ার বহুমুখী পথ সৃষ্টি হবে, সে সুযোগ আমরা এখনই লক্ষ্য করছি দেখতে পাচ্ছি কি সুন্দর হয়েছে। তার ভেতরে আরেকটা পরিকল্পনা ছিল, ওখানে নিবিড় অথচ আলাদা একটা অভয়ারণ্য তৈরি হবে। ঢাকা শহরের পাখিরা নীরবে আর নিরিবিলিতে থাকতে পারবে। সে বনটাও শুরু করা হয়েছে। সেখানে গাছ লাগানো হয়েছে। শুধু দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার কারণে যদি সে সময় ঝিলের ওপর দিয়ে একটা ফ্লাইওভার করে দেয়া হতো, একটা ফ্লাইওভার হয়তো হতো; কিন্তু এখন চারদিকে যে নান্দনিক পরিবেশ এগুলো হতো না। ঢাকা শহরের চারপাশে নৌপথ নির্মাণের জন্য যে প্রকল্প নেয়া হয়েছিল, ভূমি দস্যুতার কারণে তা কেন বাস্তবায়ন করা যায়নি, কারণ অনুস্ন্ধান হওয়া প্রয়োজন। উন্নয়নশীল উন্নয়নের প্রতি সকলের সচেতন দৃষ্টি দরকার। এ নিরীখে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতার ৫ দশক পরেও এখনো স্থির প্রাজ্ঞ হতে হবে এমন প্রকল্প নেব তা যেন পরিবেশকে বিপন্ন না করে বরং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক হয়। মানুষের সাধারণ যে অবস্থান সে অবস্থান যেন বজায় থাকে, এবং তাতে যেন মাছ, ভাত খেয়ে বা কৃষির যেন ব্যবস্থা হয়। যেমন বলা হচ্ছে কোনো জমি আবাদের বাইরে রাখা হবে না। একই সঙ্গে শুধু জমি বাদ রাখা না, এক জমিতে তিন ফসলও করতে হচ্ছে। তাই যদি না করা যেত, তাহলে ১৯৭২ সালের তুলনায় ২০২২ সালে জনসংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেড়ে যাওয়ার পরও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারতাম না। এখানেও মানুষের এ খাদ্যে চাহিদার জন্য কৃষিকে শক্তিশালী করবার জন্য আমরা আবার অনেক কীটনাশক ব্যবহার করছি। আমাদের এগুলো ব্যবহার করা লাগত না যদি আমাদের আবাদি জমিগুলো আগের মতো ঠিক অবস্থায় থাকত।
যদি সেখানে প্রাকৃতিক সেচ ব্যবস্থা থেকে পানি পাওয়া যেত। সেখানে যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় থাকত, তাহলে হয়তো আমাদের এতটা কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল হতে হতো না। কীটনাশক ব্যবহারে জনস্বার্থকে হুমকির মধ্যে ফেলার আশঙ্কা বাড়বে। প্রচুর সড়ক তৈরি করাতে আমাদের সড়কে জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়, এবং মূল্যবান সে জ্বালানির সরবরাহে বিশ্ববাজার যখন বিমুখ হয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের এক ধরনের মহা সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে। এগুলো এত লাগত না, যদি আমরা নৌপথটা ভালো রাখতে পারতাম। তাহলে বিকল্প হিসেবে সড়কের ওপর নির্ভরতা কমানো যেত। কারণ যত সড়ক হবে তত গাড়ির ব্যবহার বাড়বে, মোটরসাইকেল বাড়বে, কতকিছু বাড়বে। প্রতিদিন যদি হিসাব করি, সড়কে গড়ে ৩০-৫০ জন মানুষ হতাহত হচ্ছে। এ ক্ষতির সঙ্গে জ্বালানির যে জীবাশ্ম সেটার ফলে বাতাসে যে সীসা তৈরি হচ্ছে এবং আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তার চেয়ে বড় কথা আমাদের চাহিদা মেটানোর জন্য জল বিদ্যুতের ওপর যে নির্ভরশীলতা থাকা উচিত ছিল, প্রাকৃতিকভাবে নবায়নযোগ্য যে জ্বালানিতে যাওয়া উচিত ছিল, সেখানে শিল্পায়নের জন্য এখন বিদ্যুৎ বেশি দরকার হয়ে পড়ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে আবার কয়লা বিদ্যুতের দিকে যেতে হচ্ছে। কয়লা বিদ্যুৎ আবার আলাদাভাবে পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। আর তার চেয়ে বড় কথা সে বিদ্যুতের কেন্দ্র বানাতে হচ্ছে প্রাকৃতিক সুরক্ষা সুন্দরবনের কাছে। সুন্দরবনের কাছে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার প্রতিফল হচ্ছে সুন্দরবন ধ্বংস হওয়া। অথচ এই সুন্দর বন আমাদের এমন প্রাকৃতিক সুরক্ষা যা পুরো উপকূল অঞ্চলটাকে ঝড়, ঝাপ্টা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। সে সুন্দরবন একদিকে ফারাক্কা বাঁধের কারণে লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ঠিক একই সঙ্গে এ জাতীয় শিল্পায়ন হলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়বে।
এগুলো সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যাবে না, এখন যারা এটার সপক্ষে কথা বলেছেন তারা তো বেঁচে থাকবেন না যখন পরিবেশের ক্ষতি শুরু হয়ে যাবে। ফারাক্কার প্রভাবক ভূমিকা যারা নিজেদের স্বার্থে একদিন উপেক্ষা করেছিলেন তারা তো এখন নেই। সুতরাং সব পরিকল্পনায় থাকতে হবে সুদূরপ্রসারীসুদৃষ্টি। সে পরিকল্পনায় মূর্ত হতে হবে নিজের ইন্ডিজেনাস সক্ষমতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য যেন সংরক্ষিত হয়, এগুলো যেন বজায় থাকে। জাপানের উদাহরণ দিয়ে শেষ করি। জাপান অত্যন্ত আধুনিক রাষ্ট্র, প্রযুক্তিতে খুবই উন্নত তারপরও তারা সে পুরোনো ট্রেন, পুরোনো বাসস্ট্যান্ড, পুরোনো পদ্ধতি গত ৫০-৬০ বছরে পরিবর্তন করেনি। এখন আমরা উড়াল সেতু বানাচ্ছি, এর পরিবর্তে উচিত ছিল সনাতন যে রাস্তা আছে সে রাস্তাকে কীভাবে ঠিক ঠাক করে ব্যবহার করা যায় তা দেখা কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এবং এসব কাজ দিতে গিয়ে ভূরাজনৈতিক নানা গ্যাঁড়াকলে পড়ার বিষয়টির সুদূর প্রসারী ফলাফল পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। জনগণকে ট্রাফিক আইন-কানুন মেনে চলা শিখিয়ে, কীভাবে রাস্তা বড় করা যায় সেদিকে না যেয়ে ওপরে একটা বড় ফ্লাইওভার বানাতে গিয়ে নিচের রাস্তাটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর ওপরে ওই রাস্তার ফলে যে নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে তাতে পরিবহন খরচ তো বাড়বেই। সাধারণ মানুষ তো তাতে উঠতে পারবে না, অথবা সমাজে এমন একটা আয় বৈষম্য তৈরি হয়েছে তাতে কিছু লোক হয়তো উঠতে সক্ষম হবে, সেইসব লোকের জন্য পুরো লোকের সাশ্রয়ী মূল্যে যাতায়াতের সুযোগ কেন বেহাত হবে?
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এবং প্লানিং কমিশনের সাবেক সদস্য।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে