ইউরোপ ও আমেরিকান প্রবাসীদের ঈদুল ফিতর
ঈদ এমন এক নির্মল আনন্দের আয়োজন, যেখানে মানুষ আত্মশুদ্ধির আনন্দে পরস্পরের মেলবন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং আনন্দ সমভাগাভাগি করে। মাহে রমজানের রোজার মাধ্যমে নিজেদের অতীত জীবনের সব পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার অনুভূতি ধারণ করেই পরিপূর্ণতা লাভ করে ঈদের খুশি।
ঈদুল ফিতর মুসলিম উম্মাহর কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঈদুল ফিতরের দিন মুসলমানদের জাতীয় জীবনে সাম্য-মৈত্রীর যে বাস্তব নিদর্শন প্রকাশিত হয়, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঐক্যের মধ্যেই সুনিশ্চিত শান্তি সুধা বিদ্যমান। ইসলাম ত্যাগ ও তিতিক্ষার এবং ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, ঈদুল ফিতর মুসলমানদের অন্তরে সেই শিক্ষার চেতনাকে নতুন করে জাগিয়ে তোলে। দীন-দরিদ্র, এতিম, নিঃস্ব ও ছিন্নমূল মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার যে বাস্তব প্রশিক্ষণ মুমিন রমাদান মাসে অর্জন করেছে, তার সোনালি ফসল দর্শনের দিন হচ্ছে ঈদুল ফিতরের দিন। ঈদের এই দিনে পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত ও দৃঢ় করার এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শক্তিশালী করার আকুল আবেদন আসে চতুর্দিক থেকে।
পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণের দীর্ঘজীবী উম্মতদের সঙ্গে নেকীর প্রতিযোগিতায় আমরা যাতে পরাজিত না হই, সেজন্য আল্লাহ তায়ালা রামাদানে ‘লাইলাতুল কদর’ দান করে যে মহাসুযোগ প্রদান করেছেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতর সামাজিক আদব-কায়দা ও শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষা দেয়। মানব স্রষ্টা আল্লাহর আইন পার্থিব জীবনে মেনে চললে ইহকালের মতো পরকালেও এরূপ আনন্দময় জীবন ও প্রশান্তি লাভ করা যাবে, তার বাস্তব জ্ঞান দান করে ঈদুল ফিতর। রমজানের স্পর্শ পেয়েও মানুষের যে অংশ পুরোপুরি কলুষমুক্ত হয়নি, ঈদুল ফিতর সেই অংশের কলুষতা মুক্ত করে সমাজকে সজীব করে তোলে। ঈদুল ফিতর মানুষকে বিনয়ী, নম্র ও হৃদয়বান করে তোলে। যেন ঈদের প্রভাব থেকেই মানুষ অপরের সুখে সুখী হবার তাগিদ অন্তরও অনুভব করে। ছোটদের প্রতি স্নেহ-মমতা এবং বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তির প্রাণপ্রবাহে তাদের হৃদয় মন ভরে যায়। স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন সৃষ্টির সঙ্গেও সদ্ব্যবহার করতে পারে, যেন সৃষ্টিকে ভালোবেসে সন্তুষ্ট করতে পারে।
বস্তুত নিছক এক দিনের হইচই ও মাতামাতির মধ্যেই ঈদের সার্থকতা নিহিত নয়; বরং প্রত্যেক ব্যাপারে পরিচ্ছন্ন মন ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়াতেই ঈদ উৎসবের সার্থকতা ও সফলতা। ঈদুল ফিতরের প্রকৃত তাৎপর্য হলো ব্যক্তিজীবনের নানাবিধ কুপ্রবৃত্তি বা নফস নিয়তের দমনের সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রকার দান ও দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো রমজানে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার দ্বারা মানুষ যে শিক্ষা লাভ করেছে, দান-খয়রাত হচ্ছে তার প্রায়োগিক প্রমাণ। কাজেই ঈদুল ফিতরে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার পাশাপাশি অন্যান্য দান, সাদাকাহ এবং আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সমূহ কুপ্রবৃত্তির উৎসারণ করার সাধনার মধ্যেই সিয়াম পালনের সফলতা। আর এরই সার্থকতার প্রমাণ হচ্ছে ঈদুল ফিতর।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন সভ্যতার শীর্ষে অবস্থানকারী একটি দেশ। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ দেশটি একটি চমৎকার বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। অসংখ্য অগণিত প্রবাসীর পদস্পর্শে এ মাটি তার সূর্যসন্তানদের সৃষ্টি করেছে। যারা ব্রিটেনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাখছেন অসাধারণ ভূমিকা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ দেশে বাস করছেন অসংখ্য বাংলাদেশি। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে এ দেশে বাস করছেন অসংখ্য বাংলাদেশি। যাদের বেশির ভাগই মুসলমান। যুক্তরাজ্যে ত্রিশ লাখেও বেশি মুসলমান বাস করলেও তাদের জন্য দুটি ঈদে কোনো সরকারি ছুটি বরাদ্দ নেই। যেখানে অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন দিবসগুলোতে ছুটি রাখা হয় সেখানে মুসলমানদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ আমাদের নতুন প্রজন্মকে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে।
এমতাবস্থায় যে সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের শিশুরা বড় হচ্ছে, তা তাদের অন্তরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঈদের দিন মুসলমানদের কাছে আনন্দ হিসেবে যেখানে সন্তানরা তাদের মা-বাবাকে কাছে পাওয়ার কথা, সেখানে ঈদের দিনও তাদেরকে কাজের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। মুসলমানদের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিনেও তাদের জন্য নেই কোনো ছুটি, যা সত্যিকার অর্থেই একটি ধর্মবিশ্বাসের প্রতি প্রচণ্ড আঘাত। তবে ব্রিটেনে ঈদের দিনটি সরকারি ছুটির তালিকায় না থাকলেও বাঙালি অধ্যুষিত এলাকার স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষকরা দিনটিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে ছেলেমেয়েদের ছুটি দিয়ে থাকেন। সারা দেশেই ঈদের দিনের এই অনানুষ্ঠানিক ছুটি ভোগের সুযোগ পান সেখানে বসবাসরত প্রবাসী মুসলিমরা। এটাই বা কম কিসের। শুধু ব্রিটেনেই প্রবাসীদের এমন অবস্থা হয় বা হচ্ছে, তা কিন্তু নয়! ইউরোপ-আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও আরও খারাপ অবস্থায় ঈদ যাপন করছেন বাংলাদেশি প্রবাসীরা।
তারপরও বিশ্বের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের রমজান মাসের রোজার ভুলত্রুটি দূর করার জন্য ঈদের দিন অভাবী বা দুস্থদের কাছে অর্থ প্রদান করা হয়, যেটিকে ফিতরা বলা হয়ে থাকে। এটি প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। আমাদের মধ্যে কেউ যখন মনের খায়েশ মেটাতে ব্যস্ত, তখন একমুঠো খাবার জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন কেউ কেউ। আমরা তাদের সারা বছরের বস্ত্রের সংকুলান হয়তো করতে পারব না; কিন্তু ঈদ উপলক্ষ করে সামর্থ্য অনুযায়ী অন্তত একজন অসহায় শিশুর পাশে দাঁড়াতে তো পারি। আমাদের নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশীদের মধ্যেও থাকতে পারে, এমন অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও মানুষ। তাদের কথাও ভেবে দেখতে হবে। আমাদের একটু সুদৃষ্টি অসংখ্য অসহায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারে। তাই মুসলমানদের জীবনে ঈদের তাৎপর্য অনেক। ঈদুল ফিতরের দিনে দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত।
ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানব সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। ঈদ মুসলমানদের জন্য শুধু একটি ধর্মীয় উৎসবই নয়, সম্প্রীতি-সৌভ্রাতৃত্ব শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষও এই উৎসবের মাধ্যমে প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের আরও কাছাকাছি আসে। শুধু মুসলমান নয়, অন্যান্য ধর্মের মানুষের সঙ্গেও আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। পবিত্র রমজান আমাদের চিত্তশুদ্ধির যে শিক্ষা দিয়েছে, ঈদুল ফিতর হচ্ছে সেই শিক্ষা কাজে লাগানোর দিন। আজ একটি দিনের জন্য হলেও ধনী-গরিব সবাই দাঁড়াবে এক কাতারে। ভুলে যেতে হবে সব বৈষম্য, সব ভেদাভেদ। হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হবে। শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে সারা বিশ্বে মুসলমানদের মর্যাদা ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে।
ইসলাম যে প্রকৃত অর্থেই শান্তির ধর্ম, সেটি প্রমাণ করতে হবে। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক ঈদের সওগাত। আলিঙ্গনের ভেতর দিয়ে সবাই ভুলে যাক হিংসা-বিদ্বেষ। আমাদের ঘরে ঘরে ফিরে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ। ঈদুল ফিতরের প্রতিটি অনুশাসনে ইবাদতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তা ছাড়া এ দিন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনের তাগিদ এবং মানবতার বিজয় বার্তা। প্রকৃতপক্ষে ঈদ ধনী-দরিদ্র, সুখী-অসুখী, আবালবৃদ্ধবনিতা সব মানুষের জন্য কোনো না কোনোভাবে নিয়ে আসে নির্মল আনন্দের আয়োজন। ঈদ ধর্মীয় বিধিবিধানের মাধ্যমে ধনী-গরিব সর্বস্তরের মানুষকে ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেয় এবং পরস্পরের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের শিক্ষা দেয়।
আমাদের একান্ত প্রার্থনা, জগতের সব মানুষের সুখ-শান্তি, কল্যাণ ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি। আগামী দিনগুলো সত্য, সুন্দর ও সৌন্দর্যমণ্ডিত হোক। হাসি-খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক! ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ পরিব্যাপ্তি লাভ করুক-এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে