নির্বাচন কমিশনকে সংস্কারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে
সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে। আগের সরকার ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলেছিল। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছে। কোনো ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকতা বজায় ছিল না। জনসাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছিল না। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার পরিবর্তনের যে পদ্ধতি তা ধ্বংস করে দেয়া হয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়া বহাল থাকলে বিতাড়িত সরকারের এই পরিণতি হতো না।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সরকার পরিবর্তনের ব্যবস্থা নিশ্চিত থাকলে সরকার জনগণের চাওয়া-পাওয়া, ক্ষোভ বা অস্বস্তি এগুলো বুঝতে পারত। সেই অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা নিতে পারত। সরকার যেসব ভুল করেছিল তা সংশোধন করার সুযোগ পেত। অর্থাৎ সরকার গঠন এবং সরকারি কার্যক্রম পরিচালনায় জনগণের এক ধরনের অংশীদারিত্ব থাকত; কিন্তু সেটা না করে সরকার ক্ষমতার লোভে বা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে এমন একটি ব্যবস্থা কায়েম করে, যেখানে সরকার গঠনে জনমতের কোনো প্রতিফলন ছিল না। রাষ্ট্র ক্ষমতায় টিকে থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষার কারণে তারা সব যুক্তিবোধ হারিয়ে ফেলে। জনমতকে উপেক্ষা করার কারণেই তাদের এমন নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হলো।
আগের সরকারের কাছে কোনো ধরনের দাবি উত্থাপন করলেই সরকার অসহিঞ্চু ভাব প্রদর্শন করত। তারা যে কোনো উপায়ে বল প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করত। শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তাদের দাবির মধ্যে কিন্তু সরকার পতনের কোনো ইস্যু ছিল না; কিন্তু সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রীদের কেউ কেউ ছাত্রদের উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে তাদের অপমান উপহাস করতে থাকেন। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আর আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া পূরণের পরিবর্তে সরকার বল প্রয়োগ করতে থাকে। এতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এমনকি শিশু বাচ্চা পর্যন্ত নিহত হয়। ফলে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এক দফা আন্দোলনে পরিণত হয়। বিদায়ী সরকার সবসময় ভেবেছে শক্তি প্রয়োগ করেই সব আন্দোলন দমন করা যাবে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে আমরা পুলিশের হাতে শ্রমিক হত্যার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। শ্রমিকরা তাদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছিল। সেই সময় গুলি করে শ্রমিক হত্যা করা হয়েছে।
বিদায়ী সরকারের অধীনে যত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনোটিই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনও ছিল তাই। এই বছরগুলোতে সরকারের সমর্থনপুষ্ট একটি বিশেষ মহল অবাধে অর্থ পাচার করতে থাকে। কেউ কেউ ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে বের করে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন। মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বাজারে যে কোনো পণ্যের মূল্য নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়; কিন্তু এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের তরফ থেকে দৃশ্যমান এবং কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। বরং এমন কিছু উদ্যোগ বা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে যা সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেনি ঠিকই কিন্তু তাদের মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ জমতে থাকে। শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে এবং সরকার সেই আন্দোলন বল প্রয়োগের মাধ্যমে দমানোর চেষ্টা করে তখন শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষক, শ্রমিক, অভিভাবকরাও আন্দোলনে সমর্থন দেয়। তারা নানাভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সহায়তা করতে থাকে। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়েছে অতীতে আর কোনো স্বৈরাচারী সরকারের আমলে আন্দোলন দমনের নামে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটানো হয়নি। কোনো সরকার নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়ে এভাবে হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে পারে এটা ছিল অকল্পনীয়। তবে এই আন্দোলনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরকার যত নির্যাতন-হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে মানুষ ততই রাস্তায় নেমে এসেছে। মৃত্যু বা অন্য কোনো ভয় তাদের ঘরে ধরে রাখতে পারেনি। সন্তানের সঙ্গে মা আন্দোলনে নেমে এসেছে এমন নজিরও প্রত্যক্ষ করা গেছে।
শিক্ষার্থী আন্দোলনের প্রথম শর্ত পূরণ হয়েছে। যে সরকারকে মনে হয়েছিল কোনোভাবেই সরানো যাবে না সেই সরকারের প্রধান শুধু পদত্যাগ নয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পরিবর্তনের প্রথম শর্ত বা উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। এখন দ্বিতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা এবং পুরো ব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসতে হলে তাকে জনগণের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় আসতে হবে। যদি রাজনৈতিক সংস্কার সাধন করা না হয় তাহলে আগামীতে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবে তারাও একইরকম ঘটনা ঘটাতে চাইতে পারে। আমরা নিকট অতীতে বারবার প্রত্যক্ষ করেছি, যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হন তারা আর ক্ষমতা ছাড়তে চান না। তারা জনসমর্থনের কোনো তোয়াক্কা করেন না। তারা যে কোনোভাবেই হোক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চান। ফলে রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দেয়। আমাদের এমন একটি স্থায়ী রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যার মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার সুযোগ পায়। নির্বাচন ব্যবস্থাকে উপযুক্ত সংস্কার না করে যদি নির্বাচন দেয়া হয় তাহলে একই ধরনের লুটেরা গোষ্ঠী আবারও ক্ষমতায় আসতে পারে। আগের সরকার আমলে যারা চাঁদাবাজি এবং খুন খারাবির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা ভোল পাল্টে নতুন করে তৎপরতা শুরু করতে পারে। অথবা পুরোনোদের স্থলে অন্য কেউ এসব অপকর্ম করবে যারা নতুন সরকারের সমর্থক। রাজনৈতিক কালচার এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে কেউ আর কোনো ধরনের সমাজবিরোধী তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হতে সাহসী না হয়।
আগের সরকার দেশের সব শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করেছেন। প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে যোগ্যতার পরিবর্তে দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। যে কারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় মাস্তানদের লালন ক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। এভাবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে দলীয় আনুগত্য নয় যোগ্যতাই হবে নিয়োগ প্রাপ্তির একমাত্র মাপকাঠি। শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক দলীয়করণের কারণে শিক্ষার মান এখন ক্রমেই নিম্নমুখী হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের অনেক প্রত্যাশা। তারা চাপের মধ্যে থাকবেন এটা সত্যি কিন্তু উপযুক্ত সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকার কোনো সুযোগ তাদের নেই। এমন একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে কোনো ধরনের অন্যায়-অবিচার করে কেউ পার পাবে না। কিছু কিছু সংস্কার আছে, যা নির্বাচিত সরকার ছাড়া করা যাবে না; কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই সংস্কারের সূচনা করতে পারেন। কিছু সংস্কার আছে যা স্বল্পমেয়াদি এবং কিছু আছে দীর্ঘমেয়াদি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্বল্পমেয়াদি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে পারেন। আর দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের সূচনা বা হোমওয়ার্ক করে রাখতে পারেন, যাতে পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার এসে সেই সব সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে। যেমন উদাহরণ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশন একেবারেই শেষ হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করার কারণে তার গুরুত্ব হারিয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন আর নির্বাচন কমিশনের ওপর কোনো আস্থা রাখতে পারছে না। নির্বাচন কমিশনকে সংস্কারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এমন একটি নির্বাচন কমিশন গড়ে তুলতে হবে যা জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। দলীয় সরকারের আমলে তৈরি করা ভোটার তালিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এমন একটি ভোটার তালিকা তৈরি করতে হবে যা স্বচ্ছ, সঠিক এবং বিতর্কমুক্ত।
বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা যেমন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ইত্যাদিকে সংস্কারের মাধ্যমে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। সংবাদপত্রকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তারা যাতে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে সত্য প্রকাশ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। সাইবার অ্যাক্ট বাতিল অথবা এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে এই আইন দ্বারা কাউকে অহেতুক হয়রানি করা না যায়।
গত ১৬ বছরে যেসব বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, সম্পদ পাচার হয়েছে সেগুলোর তথ্য খুঁজে বের করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি বিক্রি করে তাদের ঋণ দায় সমন্বয় করা হবে। যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অর্থ পাচার করেছেন তাদের সবার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি তাদের অন্যান্য শাস্তিও দিতে হবে।
গত সরকার আমলে বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির সঙ্গে জাতীয় স্বার্থবিরোধী যেসব চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে। আগামীতে যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের সম্মতি ব্যতীত কোনো বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। যে কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম জনগণের অর্থে বাস্তবায়িত হয়, তাই সেই প্রকল্প সম্পর্কে জানা এবং মতামত দেবার অধিকার অবশ্যই জনগণের রয়েছে। জনগণের এই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। যে সম্পদ বিদেশে পাচার করা হয়েছে তা ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা অতীতে অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জ্ঞানচর্চা এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় এমন সব ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে যারা দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে মেধার ভিত্তিতে দায়-দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যে ধরনের নির্যাতনের ইতিহাস আছে তা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকদের এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন কোনোভাবেই তারা দলীয় অনুগত্যের কারণে কোনো অন্যায়কে সমর্থন না করেন। নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। যার যে দায়িত্ব তা সঠিকভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে