বাংলাদেশের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা পাঠ্যক্রম
বাংলাদেশের শিক্ষা ও স্কুল ব্যবস্থা আক্ষরিক অর্থেই খুবই দুর্বল। এমনকি তা ভারত এবং চীনের শিক্ষাব্যবস্থার চেয়েও অনেক পিছিয়ে। এই আলাপ কেবল দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অন্ধকার সত্যের উন্মোচন নয়। খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সবাই যেন সচেতন হতে পারেন। নতুন পাঠ্যক্রম নিয়ে প্রত্যেক অভিভাবক, শিক্ষার্থী এমনকি বেশিরভাগ শিক্ষকই বেশ নাখোশ। এটা যে পুরোপুরি হতাশাজনক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নেতৃত্বে আসন্ন ভবিষ্যত প্রজন্ম গঠনে এ জাতি শেষ অবধি ব্যর্থ হতে চলেছে। ক্রমশ তা এক গভীর জাতীয় সংকটে পরিণত হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ নিয়ে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া তীব্রতর। কে এর দায় নেবে? কে এই বিনাশ বয়ে নিয়ে যাবে? কে-ইবা এ পরিস্থিতি সামলে নিতে এগিয়ে আসবে? এটা জাতির অতি সাধারণ ও মৌলিক জিজ্ঞাসা। জাতির জানা প্রয়োজন কিভাবে এবং সমাধানের পথ খুঁজতেও জাতি বড়ই মরিয়া। কেন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এতটা দূর্বল, কেন এতটা ক্রুর এবং সহজ কেন নয়। কেনইবা পশ্চিমা দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার মতো কার্যকর নয়। নয়া এই পাঠ্যক্রমে অভিভাবকদের অংশগ্রহণের সুযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যা কি না দেশের জন্য অশনিসংকেত।
পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়েছে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। অথচ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনো ইতিবাচক সুযোগের যোগ ঘটাতে পারিনি। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের আকাঙ্ক্ষা অধরাই রয়ে গেছে। আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য মানানসই শিক্ষাব্যবস্থা দিতে পারিনি। যে কারণে আমরা আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকেও পিছিয়ে রয়েছি। বাংলাদেশে আমরা বিলাসী গাড়ি কিনি, দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা গড়ে তুলি। কিন্তু এগুলো ‘ফেস পাউডার ডেভেলপমেন্ট’ বলেই গণ্য হয়। শিক্ষার উন্নয়নেই প্রকৃত উন্নয়ন লুকিয়ে। এটা সত্য যে প্রতিটি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বদাই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে। শিক্ষার অগ্রগতিতে সরকারের প্রচুর অর্থের প্রতিটি বরাদ্দ থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা অবৈধভাবে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন, এমন অভিযোগ ভুরি-ভুরি আছে। বাংলাদেশে প্রতিটি খাতেই ছড়িয়ে রয়েছে দুর্নীতি। এ দুর্নীতি থেকে আমাদের পবিত্র শিক্ষাখাতও মুক্ত নয়।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে পর্যালোচনা ও সংশোধনের এটাই সঠিক সময়। অর্থাৎ গঠন প্রক্রিয়া, বিষয়বস্তু নির্ধারণ এবং বাস্তবায়নে নজরদারির সময় হয়েছে। শিক্ষায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সঠিক নীতিমালা প্রস্তুত এবং তার বাস্তবায়ন অতিব জরুরি। দেশে শিক্ষায় অধিকারের বাস্তবায়নে সম্ভাব্য উন্নত পন্থার অন্বেষণ করতে পারে বাংলাদেশের রাষ্ট্র। মানবাধিকার বিষয়ক নীতিমালার সঙ্গে দেশের শিক্ষা প্রদানের প্রক্রিয়াকে আরো ফলপ্রসূ করে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে পরিকল্পনাগুলোর বিশ্লেষণ চলমান থাকতে পারে। অধিকার-ভিত্তিক পদ্ধতি যাতে অংশগ্রহণমূলক, দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, সমতা, বৈষম্যহীনতা, সর্বজনীনতা এবং অবিভাজ্যতার অংশগ্রহণ রয়েছে, তা বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যযোগ ঘটাতে পারে।
মৌলিক শিক্ষার সর্বজনীনীকরণ শতাব্দির গৃহীত উৎকৃষ্ট সফল নীতিগুলোর একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত। যদিও এখন পর্যন্ত লাখো মানুষ এ তালিকায় আসেনি এবং যারা স্কুলে যাচ্ছে তাদের অনেকেই সামান্য বিদ্যা অর্জন করছে। শিক্ষাব্যবস্থায় এখন ছেয়ে রয়েছে ‘লার্নিং ক্রাইসিস’। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে পুনর্গঠন কেন প্রথমদিকের সম্প্রসারিত ব্যবস্থাপনার তুলনায় যৎসামান্য সফলতা পেয়েছে তার নগন্যটুকুই এ অবধি বোধগম্য হয়েছে। শিক্ষা অর্জনে সংকটাবস্থার মূল উৎস এবং নির্ণায়ক সংশ্লিষ্ট বিতর্ক নিয়ে আলোচনা হয়। বইটি পরবর্তিতে ত্বাত্ত্বিক, গবেষণামূলক এবং তুলনামূলক দিক থেকে যা গ্রহণ করেছে তার সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা দেয় এবং এর ব্যপ্তি ও প্রকৃতি নিয়ে নিরীক্ষা চলে।
শিক্ষিত, মানসম্মত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, শিক্ষার্থীবান্ধব, বিষয়বস্তু-পাঠ্যক্রম-নিয়মানুবর্তিতা ও শ্রেণিক্ষের ব্যবস্থাপনা কৌশল সংক্রান্ত বিস্তৃত জ্ঞানসম্পন্ন এবং সেইসঙ্গে তরুণদের জীবনমানে পরিবর্তন আনায়নের আকাঙ্ক্ষা যাদের রয়েছে তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা হতে পারে তাদের সময়য়ানুবর্তিতা এবং নিয়মিত উপস্থিতি, শিক্ষাদানের লিখিত পরিকল্পনা প্রণয়ন, শ্রেণিকক্ষে স্থানীয় শিক্ষণীয় বিষয়বস্তুর সংগ্রহ, অপেক্ষাকৃত বাজে ফলাফল করছে এমন শিক্ষার্থীদের চিহ্নিতকরণ ও বাড়তি ব্যবস্থা গ্রহণ, মনোযোগের সঙ্গে কর্মীদের নিয়মিত সভায় অংশগ্রহণ, বিষয়বস্তু-ভিত্তিক সভায় উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ, চাকরি বিষয়ক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ এবং বিদ্যালয়ে কর্মদক্ষতার বিবরণী সংরক্ষণ ইত্যাদি। তা ছাড়া অনেক শিক্ষকের ফলপ্রসূ প্রশিক্ষণ নেই। তারা প্রয়োজনমাফিক সেবা প্রদানে সক্ষম নন।
সাম্প্রতিক পাঠ্যক্রমটি ভালো মানের। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সকল উপকারভোগী এ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নে প্রস্তুত কি না। এটা উন্মোচিত হয়েছে যে, এ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে কাজ করছে না এবং এতে আশা পূরণ হচ্ছে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর পরীক্ষামূলক ব্যবস্থাপনা, নতুন পথে হাঁটা এবং ভুলকে আলিঙ্গণ করা আকাঙ্ক্ষিত নয়। অন্যথা এসডিজি পরিকল্পনা লক্ষ্যে পৌঁছবে না। এ সময়টার মধ্যে জাতি ভোগান্তিতে পড়বে। এমনটা দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান ও সমতা প্রতিষ্ঠার জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে পরবর্তী নীতিমালা এবং কৌশল নির্ধারণী আলোচনা প্রভাবিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে সকলের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং সকলের অংশগ্রহণের যথার্থ পদ্ধতি নির্ধারণের জটিলতায় সমস্যার উদ্ভব ঘটছে। বিশেষ করে, এটি বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তর থেকে বিদ্যালয়ে আসা শিশুদের বহুবিধ স্তরের বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির শিকার হওয়া বিশ্লেষণ করে। সেইসঙ্গে বিদ্যালয়ে থাকাকালীন একটি শিশুর সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাড়তি বা কম সুবিধা প্রাপ্তির কথা বলে। এমন অভিজ্ঞতা মিলছে যে, বিকল্প জরুরি আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ ও আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারে প্রকল্পটির প্রয়োজন। এটা মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাঝে শক্তিশালী ও অর্থপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এটা ভাবা হয় যে, শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক যোগাযোগ ঘটলে সেরা প্রাতিষ্ঠানিক অর্জন মেলে। বিশ্বাস করা হয় যে, উদ্দেশ্য সাধনে অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী দৃষ্টিকোণে রসদের জোগানকে আরো সহজ করবে তরুণ ও অভিজ্ঞ পণ্ডিতদের মিশ্রণ। যদিও বিস্তৃত গবেষণায় ব্যক্তির জীবনঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে শিক্ষার মনোন্নয়ন নিশ্চিতকরণে যেকোনো প্রভাবক চিহ্নিত হলে তাৎক্ষণিকভাবে সে বিষয়ে আইনপ্রণেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জানান দেওয়ার পরামর্শ প্রদান করা হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা অনস্বীকার্য এবং জাতির মেরুদণ্ড। যদি সেখানে মানবসম্পদের বিপর্যয় ঘটে তবে তা অপূরণীয় হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও কম্পানি সেক্রেটারি, সিটি ব্যাংক লিমিটেড
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে