Views Bangladesh Logo

শেষ পর্ব

দেশে বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে একটা ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে

Mamunur Rashid

মামুনুর রশীদ এর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার

নাট্যজন মামুনুর রশীদ একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মঞ্চ আন্দোলনের প্রধান পথিকৃৎ। টেলিভিশনের জন্যও অসংখ্য নাটক রচনা ও পরিচালনা করেছেন। পাশাপাশি অভিনয় করেছেন অসংখ্য টেলিভিশন নাটকে। নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেও স্বৈরশাসনের প্রতিবাদস্বরূপ তিনি পুরস্কারটি প্রত্যাখ্যান করেন। সম্প্রতি তিনি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, শিল্পী-সাহিত্যিকদের অপমান ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ন্যারেটিভ নিয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর মুখোমুখি হয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব।

ভিউজ বাংলাদেশ: মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের যথাযথ চেতনা এখনো সমাজে প্রতিফলন ঘটেনি। এর কারণ কী?

মামুনুর রশীদ: এটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ব্যর্থতা। দেখুন, মুক্তিযুদ্ধটা কোথায় টিকে আছে? আমি বলব, মুক্তিযুদ্ধটা যথার্থভাবে টিকে আছে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে। যতগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আন্দোলন হয়েছে, তার অগ্রভাবে দেখবেন সবসময় শিল্পী-সাহিত্যিকরা আছেন। পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট বলতে যাদের বোঝায়, তারা কতটা আছে? হ্যাঁ, গত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক বিভিন্ন পুরস্কার দিয়েছেন, ভালো কথা। বিএনপি সরকারের মধ্যেও প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা আছেন, তার প্রতিষ্ঠাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তারাও যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সঠিকভাবে ভূমিকা পালন করেছে তা নয়। পারেনি কারণ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী একটা শক্তি সবসময় অবস্থান করত, সেটা একটা ব্যাপার।

মধ্যবিত্তের চেতনার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ আছে। জনমানুষের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ আছে; কিন্তু ১টার পর একটা প্রজন্ম তো আসতে থাকে। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদল একভাবে উপস্থিত করে আরেক দল আরেকভাবে উপস্থিত করে। এতে শিশু-কিশোর-যুবকরা বিভ্রান্ত হয়। বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে কিন্তু কোন চেতনা বিকশিত হয় না। চেতনায় কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব থাকে। কত আগে অ্যারিস্টটল, প্লেটো যেসব কথা বলেছেন, আমরা সেগুলো বিশ্বাস করি কেন? কার্ল মার্কসের কথা বিশ্বাস করি কেন? একটাই কারণ, ওই তত্ত্বের মধ্যে কিন্তু কোনো বিভ্রান্তি নেই। আপনি ওটা বিশ্বাস করেন বা না করেন, গ্রহণ করেন বা না করেন তা আপনার ব্যাপার।

ভিউজ বাংলাদেশ: গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। সেইসঙ্গে আওয়ামী লীগেরও পতন দেখেছি অনেকাংশে। এই পতনের পরে মানুষের প্রত্যাশা ছিল বাকস্বাধীনতা ফিরে আসবে; কিন্তু আমরা বাকস্বাধীনতা ফিরে আনতে পেরেছি বলে মনে করেন?

মামুনুর রশীদ: এইখানে একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। মব জাস্টিস। মব লিঞ্চিং এই মব জাস্টিসের ফলে যেটা হয়েছে, সেটাতে মানুষ ভয় পেয়ে গেছে। প্রতিটি মানুষই ভয় পায় যে, সঠিক কথা বললে আমি মব জাস্টিসের শিকার হব কি না। আর বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে তো একটা ভীতি সৃষ্টি করছে। একটা ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এটাও কিন্তু ঠিক। আমি মনে করি এটাকে সাহস দিয়ে অতিক্রম করা যায়। যেমন শিল্পকলা একাডেমি আমাকে করতে দেবে না, আমি করলাম না। দুবার নাটক করলাম। তো কি হলো, কিছুইতো হয়নি। কারণ যারা এগুলো করে অন্যের স্বাধীনতা হরণ করে, মব লিঞ্চিং করে তারাও কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের মধ্যেও ভয় আছে। কারণ এগুলো বুমেরাং। কাজেই তারা সেগুলো করবে না; কিন্তু আমি কেন আমার সাহস হারাব?


ভিউজ বাংলাদেশ: স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমরা দেখেছি বাংলাদেশে আবার নতুন করে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনৈতিক উত্থান হতে। এই রাজনৈতিক উত্থান বাংলাদেশকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে?

মামুনুর রশীদ: আমার কাছে মনে হয় এটা সাময়িক, এটা খুব সুদূর প্রসারী হবে না। কারণ তারা একটার পর একটা কথা বলেছে। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, সংবিধান পরিবর্তন, রাষ্ট্রপতির অপসারণ- এসব কথা হয়েছে কিন্তু কোনো কথাই তেমনভাবে টিকেনি। আরেকটা হলো সংবিধান পরিবর্তন। সংবিধান পরিবর্তন কি কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করতে পারে? নাকি পার্লামেন্ট লাগে, সেখানে নির্বাচিত সাংসদ লাগে, নির্বাচিত সাংসদ ছাড়া এটা হবে? হবে না। এসব এক্সারসাইজ যারা করছেন, তারা সবাই প্রবাসী। প্রবাস থেকে বুদ্ধি নিয়ে এসে বাংলাদেশে...।

আমাদের দেশে কমিউনিস্টদের যে সংকটটা হয়েছে, সেটা হচ্ছে স্থানীক বিবেচনা। আমি বাংলাদেশে যে মার্কসবাদের প্রয়োগ করবো স্থানীক বিবেচনাটা কি? স্থানীক বিবেচনা ছাড়া কত সেক্রিফাইজ, কত আত্মত্যাগ আমাদের কম্যুনিস্টদের। এতবড় আত্মত্যাগ আর কেউ করেনি; কিন্তু তারপরও আজকে দলটা প্রায় বালুচরে মিশে যাচ্ছে। তার কারণটা হচ্ছে-এই দেশ এই জাতি এবং এর মানচিত্রটার মধ্যে যারা বসবাস করে তাদের যে মানসগুগল এগুলো তারা বুঝতে ভুল করেছে। কাজেই এখন যদি কেউ চিন্তা করে যে আবার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসকে মুছে ফেলে নতুন করে কিছু করবে, হতে পারে একটা উত্তেজনার বসে এসব কথা বলছে কিন্তু সুদূরপ্রসারীভাবে এটা টিকবে না।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার কি মনে হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জামায়াতকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে, অন্য দলকে এই অবস্থান থেকে বঞ্চিত করছে?

মামুনুর রশীদ: অবশ্যই। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, সব মেজর পজিশনে তাদেরকে বসানো হয়েছ-এটা খুব দৃশ্যমান। তারা মনে করে থাকে যে, এগুলো কেউ বুঝতে পারছে না এটা ঠিক নয়। এটা খুবই দৃশ্যমান, আমরা দেখতে পাচ্ছি এগুলো হচ্ছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে দুটি দেশপ্রেমিক দল আছে একটি হলো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আরেকটি হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এ বিষয়কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মামুনুর রশীদ: এটা উনি ভুল করেছেন। এটা ১৯৭১ সাল না। একাত্তরেও একই কথা বলেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং জামায়াত ইসলাম; কিন্তু এখনকার সেনাবাহিনী কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী না। এটা বাংলাদেশে সেনাবাহিনী এবং এখানে যারা ক্যাডেট হিসেবে ঢুকেছে, বাংলাদেশে মিলিটারি একাডেমি থেকে ঢুকেছে, তারা বাংলাদেশের আইন কানুন, মবস, এক্সারসাইজ, বাংলাদেশের ইতিহাস, তার উত্থান-পতন এর মধ্য দিয়ে এসেছে। কাজেই অবশ্যই তারা দেশপ্রেমিক; কিন্তু জামায়াতে ইসলাম যে ধরনের দেশপ্রেমিক অবশ্যই সেরকম দেশপ্রেমিক তারা নন। এটা আমার বিশ্বাস।

ভিউজ বাংলাদেশ: আমরা দেখেছি, ৫ আগস্টের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার বাড়িটি, যেটি ছিল জাদুঘর। সেখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্যা স্মৃতিবিজড়িত দলিল, ভাস্কর্য পুড়িয়ে ফেলা হলো যেটা ’৭১ সালে পাকিস্তান পোড়ায়নি। অন্তর্বতীকালীন সরকারকে বিষয়টি নিয়ে একটি টুঁ শব্দও করতে দেখিনি। এই না করার কারণ কি?

মামুনুর রশীদ: আমি ব্যক্তিগতভাবে বিক্ষুদ্ধ হয়েছি। ১৫ আগস্টের পত্রিকায় আমার লেখা কলামে আমি এটা লিখেছিও। ৫ আগস্টের দশদিন পর ১৫ আগস্ট সেই সাংঘাতিক সময় তখনও আমি লিখেছি। কতগুলো বিষয় থাকে যেমন আজকে যে ঢাকা শহরের সাক্ষরটা কি? সংসদ, জিরো পয়েন্ট, শহীদ মিনার, লালবাগ কেল্লা। তো ১৯৭১ সালের মার্চে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মারক কিন্তু ৩২ নম্বর। ৩২ নাম্বারে আমরা দেখেছি প্রতিদিনি হাজার হাজার মানুষ গিয়ে সামনে দাঁড়াতো। আর বঙ্গবন্ধু একটা হাতমাইক দিয়ে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরে ওপর থেকে নির্দেশ দিতেন। উনি যেটা নির্দেশ দিতেন সেটা হতো তখন বাংলাদেশের আইন। সেই লোকটির সেই স্মৃতি... স্মৃতি কিন্তু কোন ব্যক্তির কাছে আর থাকে না। যে বাড়িতে উনি নিহত হয়েছেন যেখান থেকে উনি মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনাবলি আসতো সেগুলো তো জনগণের সম্পত্তি।

পরে ঠিক আছে উনাকে নিয়ে অনেক অতিরঞ্জিত হয়েছে, সেটাতো উনি করেননি। উনিতো মৃত। উনার দল উনার কন্যা তারা যদি করে থাকে, তার দায়ভার উনি নিবেন কেন? আর ৩২ নাম্বার বাড়ি কিন্তু এখন জনগণের সম্পদ। মিউজিয়াম তো জনগণের সম্পদ। বিভিন্ন জায়গায় মিউজিয়াম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এটাও অন্যায়। প্রত্যাশা করেছিলাম, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ব্যাপারে একটা বক্তব্য দেবে বা কিছু একটা করবে; কিন্তু তিনি বক্তব্য দেননি। আমি ক্ষুব্ধ হয়েছি।

ভিউজ বাংলাদেশ: ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে নতুন একটি ন্যারেটিভ শুরু হয়েছে সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধবিরোধিতা। এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধীতার পেছনে প্রধানতম যে সংকট, এই সংকটের জন্য পলাতক প্রধানমন্ত্রী কতটা দায়ী?

মামুনুর রশীদ: উনিও দায়ী। কারণ হলো শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের ধ্বস নেমেছে উনার সময়। নিয়োগ বাণিজ্য, শিক্ষকদের নিয়োগ বাণিজ্য। দুর্নীতির একটা আখড়া হয়ে গিয়েছিল শিক্ষা। সেগুলোকে উনি কিন্তু কঠোর হস্থে দমন করেননি। দমন করা উচিত ছিল। শিক্ষাটা যদি ঠিক থাকত, তাহলে কিন্তু এতকিছু হতো না। শিক্ষাটা যখন নাকি ধ্বস নেমে গেল, তখনি কিন্তু এসব ঘটনাগুলো তৈরি হয়েছে।

আমি তখন বারবারই বলতাম যে, বঙ্গবন্ধুর কথা গণমাধ্যমে যখন একটা সেকেন্ডও প্রচারিত হতো না তখন ছিলেন তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয়; কিন্তু যখন মিডিয়াতে ৭২ সালের পর থেকে উনাকে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখানো হতো তখন কিন্তু উনার জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করল। এবারও তাই হয়েছে। এত বেশি নামকরণ এত বেশি উনাকে নিয়ে মিডিয়াতে দেখানোর ফলে উল্টো একটা অ্যাফেক্ট পড়েছে। এটার জন্য তো উনি দায়ী। উনার দল দায়ী। এই দায়তো অস্বীকার করা যাবে না।

ভিউজ বাংলাদেশ: স্বাধীনতার-সুবর্ণজয়ন্তীতে শুধু বঙ্গবন্ধুকে বিশেষ করে স্মরণ করা হয়েছে। জাতীয় চার নেতার কথা বলতে পারি, সেক্টর কমান্ডারদের কথা বলতে পারি, যারা যুদ্ধ করেছিলেন তাদের সেইভাবে এই অনুষ্ঠানে স্মরণ করা হয়নি। এই না করার জন্য আওয়ামী লীগকে কীভাবে দোষারোপ করতে করব?

মামুনুর রশীদ: খুব অন্যায় এবং সেটাও তোষণ। প্রধানমন্ত্রীকে তোষণের জন্য কেউ কিছু বলেনি। মাত্র কিছুদিন আগেই তাজউদ্দীন আহমেদের শতবর্ষ হয়ে গেলে, তার সমাধিতে একটা ফুল দিতেও কেউ যায়নি। তাজউদ্দীন তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সৈনিক। আমি ভারতীয় কমান্ডার বা বিভিন্ন বিদেশি অনেক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা বলছে যে ‘ইউ হ্যাভ প্রপাউন্ড দিস পারসন ইউর তাজউদ্দীন আহমেদ ম্যান অব ইন্টিগিরিটি’। বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি জুটি হয়েছিল রাজনীতিতে। একটি মাওলানা ভাসানী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরেকটা হলো বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দীন আহমেদ। আর নেতাদের কথা আমি এভাবে বলব না। এই যে হয়েছিল, এই হওয়াতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনেক দূর চলে গেছে। কেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে মাওলানা ভাসানীকে বাদ দেবেন?

১৯৫৭ সালে যে লোকটা কাগমারী সম্মেলনে বলে দিয়েছিলেন, আসসালামু আলাইকুম, ওয়ালাইকুম আসসালাম। তোমাদের সঙ্গে আমাদের আর দেখা হবে না। তারপরে তার যে ভূমিকা মানে প্রপিট অব ভায়োল্যান্স এবং মজলুম জননেতা হিসেবে তার যে ভূমিকা এ দেশে, কত কৃষক সভা কত কৃষক সম্মেলন করেছেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রশ্ন রেখেছেন- তাকে বাদ দেবেন কেন? ফজলুল হককে বাদ দেবেন কেন? ঠিক আছে অনেক আপোষকামিতা থাকতে পারে; কিন্তু সে তো এই বাংলার একটি গৌরব। কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র এবং সে সময়ে মুসলমানদের জন্য তার যে ভূমিকা। শ্যামা হক মন্ত্রিপরিষদের তার যে ভূমিকা সেটাতো বাদ দেওয়া যাবে না। কেন তাকে বাদ দিলেন? এরকম অসংখ্য লোকের অবদানকে আমরা অস্বীকার করেছি।

কমিউনিস্ট মুভমেন্ট-মনি সিংকে বাদ দেয়া যাবে? মনি সিংহের যে অবদান এবং মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির যে অবদান-১৯৩০-এর দশক থেকে যে ত্যাগী একটা রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি, সেটা কি আমরা বাদ দিতে পারব? পারব না। হ্যাঁ, তাদের রাজনীতিতে ভুল থাকতে পারে যখন আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং জাতীয়তাবাদ দুটি প্রশ্ন। একসময় ভিয়েতনাম নিয়ে ওনারা যতটা চিন্তিত হলেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন হলেন না- এগুলো তো আছে। এগুলো হওয়ার পরেই এটা হয়েছে।

ভিউজ বাংলাদেশ: মুসলিম লীগের পতন হয়েছে, আওয়ামী লীগের পতন দারপ্রান্তে বলা হচ্ছে। তাহলে আওয়ামী লীগ কি মুসলিম লীগ পতনের দ্বারপান্তে যাচ্ছে নাকি ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে?

মামুনুর রশীদ: অবশ্যই ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা আছে কিন্তু সেটা সময়-শর্ত সাপেক্ষ। শর্তটা হচ্ছে যে, তাকে তার পরিবারকে ত্যাগ করতে হবে। ছাত্রলীগ যে প্রতিষ্ঠানটির জন্য সবচেয়ে বেশি সে অভিযুক্ত হয়েছে, সে প্রতিষ্ঠানকেও তাকে ত্যাগ করা অথবা আদৌ এটাকে শুদ্ধ করা সম্ভব কী না আমি এ ব্যাপারে একেবারেই সন্দিহান। এগুলো ত্যাগ করে নতুনভাবে যদি শুরু করতে পারে, তাহলে তার সম্ভাবনা আছে; কিন্তু সেটা কতটা সম্ভব, সেটা বলা মুশকিল।

ভিউজ বাংলাদেশ: ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে যত ধরনের পট পরিবর্তন হয়েছে, তার বড় একটি অংশ পট পরিবর্তন হয়েছে সংস্কৃতি জগতে। বলা হচ্ছে সংস্কৃতি এখন ক্ষয়িষ্ণু পর্যায়ে। সেখান থেকে সংস্কৃতি কি আবার জাগরণ সম্ভব? নতুন করে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্ভব?

মামুনুর রশীদ: এটা একটা খুব প্রয়োজন ছিল আগেও করার, তার জন্য আমরাও দায়ী। আমরা যারা সংস্কৃতিকর্মী, সংস্কৃতিকে নানানভাবে নেতৃত্ব দিয়েছি তার জন্য আমি নিজেকেও দায়ী মনে করি। আমরা একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। সাংস্কৃতিক আন্দোলন বলতে স্থুল অর্থে গান, নাটক, নৃত্যকলা তা না। মানুষের ভেতর থেকে তাকে পরিবর্তন করার যে প্রচেষ্টা এটা আমরা করতে পারিনি। আমরা নাটক করেছি কিন্তু নাটকের যে ব্যাখ্যা, কাব্যের যে ব্যাখ্যা এবং আমাদের যে কাব্য উপন্যাস গল্প আছে সেটার ব্যাখ্যা ভালোভাবে পারিনি। যেমন ধরুন হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে নাকি উল্টাপাল্টা কথা বলা হচ্ছে। পড়িনি, শুনেছি। শামসুর রহমানকেও বিতর্কিত করে তুলল। এই বিতর্কিত করার আগে আমাদের কিন্তু পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। যেমন আল মাহমুদের মতো এত বড় একটা কবি, তিনি নানা কারণে বিতর্কিত হলেন। আল মাহমুদের পক্ষে কিন্তু আমাদের দাঁড়ানো উচিত ছিল। এত বড় একটা কবি, আমাদের সম্পদ-গৌরব, তাকে কিন্তু আমাদের রক্ষা করা দরকার। এত ডায়লগ হয় লেখকদের নিয়ে, লেখকদের লেখা নিয়ে, চলচ্চিত্রকার-নাট্যকারদের নিয়ে, সেটা আমাদের এখানে খুব কম। কাজেই মানুষকে তার ভেতর থেকে পরিবর্তন করার যে প্রক্রিয়া, এটা রাজনৈতিক দল বাইরের সারফেস থেকে করার চেষ্টা করে, সংস্কৃতির ভেতর থেকে এটা কিন্তু করেনি।

যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথমদিকে লেখকরা যে ভূমিকা রেখেছে, ম্যাক্সিম গোর্কি অথবা তারও আগে টলস্তয়, দস্তয়ভেস্কি রেখেছিলেন। আরও অনেক লেখক সাহিত্যিক কবি তারা যে ভূমিকা রেখেছিলেন, সেটার জোরেই কিন্তু বহু বছর পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতিটা তাদের দেশে চালু ছিল। সেই কারণে প্রগতি প্রকাশনীর মতো প্রকাশনা ছিল তাদের। তাদের চলচ্চিত্র ছিল, সংগীতের স্কোয়াড় ছিল এগুলো ছিল বলে কিন্তু তারা অনেকদিন এই প্রগতিশীল রাজনীতিকে নিজের দেশে না সারা বিশ্বেও ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলে। সেই জায়গায় আমাদের ঘাটতি আছে, এটা অস্বীকারের উপায় নেই। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজনীতির সমর্থনও প্রয়োজন। সেই সমর্থন কোন রাজনৈতিক দল দেয়নি। আমরা যখন মুক্তনাটক দল করি শত শত গ্রামে গ্রামে গিয়ে, কাহিনি সংগ্রহ করে মানুষকে দিয়ে অভিনয় করাই তখন অনেক রাজনৈতিক দলের সাহায্য চেয়েছি আমরা, পাইনি ইনক্লুডিং কমিউনিস্ট পার্টি। এটা যদি পেতাম তাহলে গ্রামে একটা কালচারাল বেইজ গড়ে উঠতো। তো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন মানে নাচ গান, নাটক এই; কিন্তু এর অভ্যন্তরে এর মোটিভ আবিষ্কার করা, রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন জায়গায় সমালোচকের ভূমিকায় অবর্তীণ হওয়া যে, এই নাটকটা তো ঠিক হয়নি, এই চরিত্রটা ঠিক হয়নি- তারা বলবে, একটা বিতর্ক তৈরি হওয়া আমরা শুনি বা না শুনি। বিতর্ক তৈরি হওয়া এটা খুবই প্রয়োজন।

ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশের স্বাধীনতার নব্বই দশকের পর বাংলাদেশে নতুন করে মুভমেন্ট শুরু হয়েছে। মুভমেন্টটি হলো-গ্রামীণ বাংলার যে লোকোৎসবগুলো, সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অপসংস্কৃতির ধারা চালু। পরে সরকারের কাছে আপনার বিশেষ কোনো প্রত্যাশা আছে?

মামুনুর রশীদ: প্রথমেতো সরকারকে যেটা করতে হবে, সেটা হলো তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আজকে আমাদের দেশে একটা লোক নেই যে পারফেক্টলি ভায়োলিন বাজাতে পারে। বাঁশি হারিয়ে যাচ্ছে, তার সানাই হারিয়ে গেছে এরকম অনেক কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। জার্মানিতে একবার আমি একটা কোর্স করতে গিয়েছিলাম। সেখানে বলেছিল যে দেখো-আমাদের দেশে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিককে আমরা রক্ষা করি। জাপানিরা তাদের ঐতিহ্যগত পারফর্মিং আর্টগুলো তারা কিন্তু রক্ষা করেছে। তাদের মডার্ন থিয়েটারকে তারা রক্ষা করে। সেখানে তারা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। আবার ওই সময়কার তাদের যে গুরু, তাদেরকে রক্ষা করেছে। এতে তাদের আজকের এটিচিউডটা হচ্ছে- পুরোনো সংস্কৃতিকে আমরা একটু রক্ষা করি। এই রক্ষা করার কাজটা সরকার করতে পারতো। আবার সরকার তার কথাও বলতে পারে, প্রপাগান্ডা নয়। এখন সরকার মনে করে এগুলো প্রপাগান্ডার জন্য, সেটা না। মানুষের যে পরিবর্তন, ভেতর থেকে যে পরিবর্তন, মানুষের সংস্কৃতির যে আকাঙ্ক্ষা, তার স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষা এগুলো তৈরি করতে হবে। স্কুল কলেজে সর্বত্র ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে।
(শেষ)


আরও পড়ুন

পর্ব ১
মূলধারার সংস্কৃতিচর্চা থেকে আমাদের সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে

দ্বিতীয় পর্ব
আমরা তো চাই দেশটি রাষ্ট্রহীন না হোক


শেষ পর্ব
দেশে বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে একটা ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ