Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আর্থিক সংকট এত গভীর নয়

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪

নভেম্বর ১১, ২০২৪-এ রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বণিক বার্তা কর্তৃক আয়োজিত ‘বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শীর্ষক কর্মশালায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতের অবস্থা পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ। ঘুষ-দুর্নীতি, অর্থ পাচার, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, ঋণখেলাপি সবই আছে বাংলাদেশে। দেশে নেতিবাচক উপাদান বেশি থাকায় মেট্রোরেলের উন্নয়ন নজরে আসে না, নজরে আসে দুর্নীতির টাকায় নির্মিত আকাশচুম্বী ভবনের সমাহার; ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্য শোনা যায় না, শোনা যায় মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের দুর্নীতির টাকায় গড়ে ওঠা মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম’, আর কানাডার ‘বেগমপাড়া’। এতগুলো নেতিবাচক উপাদান থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থার চেয়ে বাংলাদেশ আর্থিক অবস্থা খারাপ- এমন তথ্য-উপাত্ত কোথাও উল্লেখ করা হয়েছে বলে শুনিনি। গভর্নর উক্ত কর্মশালায় আরও অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন, সেগুলো নিয়ে পরে পর্যালাচনা করা যাবে, আজ লেখায় থাকবে শুধু দেশের ‘আর্থিক অবস্থা’।

গভর্নর দলীয় সরকারের মুখপাত্রের মতো কথা বলেছেন। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে বিগত সরকারের অকাজের ফিরিস্তি বর্ণনা করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। এর প্রধান কারণ বিগত সরকারকে অকর্মক প্রমাণ করা গেলে নিজেদের কৃতিত্বের জাহির করা সহজতর হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সেনাশাসকরাও বিতাড়িত সরকারের অপকর্ম তুলে ধরে তাদের অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণকে জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করে থাকে; কিন্তু এই দায়িত্ব কখনো কোন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়েছেন বলে জানা নেই।

বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা পাকিস্তানের চেয়ে কোন প্রসঙ্গে খারাপ, তা কিন্তু গভর্নর উল্লেখ করেননি। তার কথা বিশ্বাসযোগ্য হতো যদি তিনি বলতেন, একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পাকিস্তানের চেয়ে খারাপ ছিল। ৯ মাসের যুদ্ধে দেশের অবকাঠামোসহ সর্বত্র ছিল ধ্বংসের চিহ্ন,- অফিস-আদালত, দোকানপাট, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, ব্রিজ, কালভার্ট, রেললাইন, বিদ্যুৎকেন্দ্র কিছুই অক্ষুণ্ন ছিল না। পাকিস্তানি সৈন্যরা লাখ লাখ বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল। মানুষ ও খাদ্য পরিবহনের জন্য ছিল না রেল, বাস, ট্রাক, লরি। ছিল না বৈদেশিক মুদ্রা। যুদ্ধোত্তর দেশে সরকারকে পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে শত শত বাড়িঘর, শত শত কিলোমিটার রাস্তা, নির্মাণ করতে হয়েছে শত শত কালভার্ট-পুল-ব্রিজ। ঘর নেই, বাড়ি নেই, বস্ত্র নেই, খাবার নেই, খাবার কেনার পয়সা নেই- চারদিকে ছিল শুধু হাহাকার।

স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেই ব্যাংকে ছিল না কোনো নিজস্ব টাকা, ছিল না বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ বা রূপা। বাংলাদেশের নিজস্ব টাকা না থাকায় পাকিস্তানি রুপিতে ‘বাংলাদেশ’ সিল দিয়ে লেনদেন করতে হয়েছে বহুদিন। পাকিস্তানি টাকাও বেশি ছিল না; পাকিস্তানি সেনারা পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে মতিঝিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্ট থেকে সব টাকা বের করে তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সদ্য স্বাধীন দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার আর্থিক দীনতা এত প্রকট ছিল যে, ব্যাংকগুলো তাদের বিদেশি দায়ও পরিশোধ করতে সামর্থ্য ছিল না। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত এক বিলিয়ন ডলারের সাহায্যই ছিল সরকারের একমাত্র সম্বল। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর এ এন এম হামিদুল্লাহ এত হতাশা ব্যক্ত করেননি, রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি। ইতোমধ্যে বর্তমান গভর্নর নেতিবাচক বক্তব্য দিয়ে অনেক ব্যাংককে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছেন, এখন দেশটাকেও দেউলিয়া আখ্যা দেয়া হলে বিদেশের বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে, দেশের ব্যাংকগুলোর ওপর বিদেশি ব্যাংকগুলোর আস্থা শূন্যতে নেমে আসবে।

একাত্তরে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল শূন্য থেকে; ভারত আর রাশিয়ার সাহায্য না থাকলে দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হতো। অন্যদিকে পাকিস্তানের তখন রমরমা অবস্থা, অঢেল সম্পদ; তারা বাংলাদেশের পাওনা দেয়নি, তাদের ছিল চীন, আমেরিকা, সৌদি আরবসহ অসংখ্য বন্ধু দেশ। তারপরও বিভিন্ন সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ প্রায় সব সূচকে পাকিস্তানের উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছিল। শুধু পাকিস্তানের নয়, বিশ্ব দরবারেও বাংলাদেশ উন্নয়নের মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এটা কোনো সরকারের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বাচালতা নয়, এই স্বীকৃতি দিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, দিয়েছে বিশ্বের মশহুর পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’।

বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা, এখন হয়েছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বিরাট বিরাট বাজেট মূল্যস্ফীতির কারণ হতে পারে; কিন্তু দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও বেড়েছে। বিগত বহু বছর ধরে দেশে গড়ে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি ছিল; অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩-৪ শতাংশ। করোনার দুর্যোগের সময় বিশ্বের বহু দেশের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হলেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ইতিবাচক। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার, শিশু মৃত্যুর হার কমেছিল, বেড়েছিল শিক্ষার হার, গড় আয়ু, মাথাপিছু আয়, আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ, দেশজ উৎপাদন। রপ্তানি আয় ছিল পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি, রিজার্ভ ছিল প্রায় চারগুণ বেশি, বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ছিল তিন গুণ বেশি। বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার, আর পাকিস্তানের জিডিপি আকার ছিল ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার।

দুর্নীতির কথা স্বীকার করে নেওয়ার পরও বলতে হবে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো উন্নয়নের অগ্রগতি ছিল ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী না হলেও পাকিস্তান আমলে ৭ কোটি লোকের যে খাদ্য ঘাটতি ছিল, এখন ১৮ কোটি লোকের ঘাটতি তার বেশি নয়। মিঠা পানির মাছ ও সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয় ও পঞ্চম স্থানে। মানব উন্নয়ন সূচক, সহজে ব্যবসা করার সূচক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক, গড় আয়ুষ্কাল, শ্রম শক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকেও বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়ে ছিল।

বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে পাকিস্তানের প্রশংসা পাকিস্তানের মিডিয়ায় প্রায়ই শোনা যায়। ইমরান খান ২০১৮ সনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েই প্রথম পাঁচ বছরে পাকিস্তানকে সুইডেনের মডেলে উন্নীত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের টেলিভিশনের একটি টকশোতে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট জাইগাম খান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের উক্ত অতিশোয়ক্তির প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে, সুইডেন নয়, পাকিস্তানকে ইমরান খান আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের স্তরে নিয়ে যেতে পারলেই পাকিস্তানের জনগণ খুশিতে আত্মহারা হবে। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ভূয়সী প্রশংসা করে যা বলেছেন, তা বোধ হয় গভর্নর মহোদয় শোনেননি; তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে তাকালে আমাদের লজ্জা হয়’।

গভর্নর হওয়ার আগে বাংলাদেশের অর্জন প্রসঙ্গে ড. আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্য ছিল, ‘যে দেশটির কাছ থেকে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক সূচকেই এগিয়ে আছে’। হঠাৎ বিগত তিন মাসে এমন কী হলো যে, একই বিশেষজ্ঞের চোখে ধরা পড়ল, বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা পাকিস্তানের চেয়ে খারাপ! শুধু গভর্নর নন, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নিয়েই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আপনারা দেশের অবস্থা যত খারাপ ভাবছেন, তত খারাপ নয়’। দেশের কর্ণধারদের দেশের স্বার্থেই অর্থ উপদেষ্টার মতো ইতিবাচক হতে হবে, নতুবা বেফাঁস কথার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমস্যা বাড়তেই থাকবে।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ