Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ফুটবল: খেলোয়াড় জন্মগ্রহণ করে না, সৃষ্টি করতে হয়

Ekramuzzaman

ইকরামউজ্জমান

শুক্রবার, ১৪ জুন ২০২৪

ছর দুয়েক আগে বাংলাদেশে একমাত্র উয়েফা-এ লাইসেন্সের অধিকারী ফুটবল কোচ এ কে এম মারুফুল হক বলেছেন, দেশে তৃণমূল এবং কিশোর বয়স থেকে ফুটবলে শিক্ষিত হবার সুযোগ নেই বললেই চলে। এতে করে আমরা ক্লাব এবং অন্যান্য পর্যায়ে যখন ছেলেদের পাই, তাদের ‘টেকনিক্যাল’ এবং ট্যাকটিক্যাল স্কিলের ধারণা থাকে খুব কম। এটি ওদের দোষ নয়, আমাদের ফুটবল কাঠামোতে তৃণমূল পর্যায়ে গুরুত্ব বড় কম। আর এটি অবশ্যই বড় সমস্যা। তৃণমূল থেকে সঠিক ফুটবলের জ্ঞান নিয়ে যথেষ্ট সংখ্যায় জুনিয়র ফুটবলার উঠে আসছে না। তৃণমূল পর্যায় গবেষণাধর্মী পেপার তৈরি করতে যেয়ে পর্যবেক্ষণ হলো কোচ মারুফের বক্তব্য শতভাগ সত্যি।

বাস্তবতা হলো জুনিয়র থেকে ধাপে ধাপে সিনিয়র পর্যায়ে পৌঁছানোর রাস্তাগুলো খোলা নেই দেখে। দেশের ফুটবলে এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। সমস্যা সমাধানের চেষ্টার বদৌলতে সব সময় সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা দেশে ঘরোয়া ফুটবলকে দেখছি বিদেশিদের শক্তি দিয়ে। দেশকে কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করে না বিদেশিরা- করে এই ভূমির সন্তানরা, তখন বোঝা যায়, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। সব সময় বলা হয়, অভিজ্ঞতা নেই, দক্ষতায় সূক্ষ্ম বিষয় নেই, টেকনিক একেবারেই সাধারণ- তাদের দিয়ে জাতীয় দল কিছু আসা করবে কীভাবে? কখনো ভাবা হয় না তারা সামর্থ্যের প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবে কীভাবে? তাদের নিয়ে তো পরিকল্পনামাফিক জরুরি কাজগুলো সময় অনুযায়ী যেটা করার দরকার সেটির অভাব দেশের ফুটবলে। খেলোয়াড় তো জন্মগ্রহণ করে না, সৃষ্টি করতে হয়।

দেশে বয়সভিত্তিক কোচিংয়ের কোনো বিশেষ পদ্ধতি নেই। যেখানে ছেলে ও মেয়েরা ধাপে ধাপে এগোবে। ১৩, ১৫, ১৬, ১৮ এবং ১৯ পেরিয়ে বড় দলের কাছে পৌঁছাবে। এটাই আদর্শ প্রক্রিয়া। দেশে একেকটা টুর্নামেন্টের জন্য একটা নতুন দল গঠন করা হয়। টুর্নামেন্ট শেষে সবাই সবার নিজস্ব অবস্থানে ফিরে যায়। এরপর আর এদের কেউ খোঁজ রাখে না। কখনো কখনো আবার প্রতিযোগিতা বা টুর্নামেন্ট শেষে প্রচার দেওয়া হয় যাদের নির্বাচিত করা হয়েছে- তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা হবে। এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির বিষয়টি আর জনসমক্ষে উঠে আসে না।

ক্রীড়াঙ্গনে যুগ যুগ ধরে তো এই সংস্কৃতি চলে আসছে। পরিবর্তনের উদ্যোগ এবং সময়ের সঙ্গে গা ভাসিয়ে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দ্রুত বদলে যাচ্ছে ফুটবল। ফুটবল এখন টাইম অ্যান্ড স্পেসের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব। আরও গতি, আরও গতি জেটকে হার মানানোর শপথ নিয়ে মাঠে নামছেন ফুটবলাররা। ওই গতি দিয়েই তৈরি করছে মাঠের ফাঁকা জমি। যেটা ভরাটের জন্যও দরকার হচ্ছে গতির। গতি শক্তির পাশাপাশি একই রকমভাবে গুরুত্ব আছে স্কিলের। শ্রেষ্ঠত্বের এটাই একমাত্র পথ।

হংকংয়ে ‘ফুটবল এশিয়া’ সেমিনার কক্ষে বসে অনেক দেশ থেকে পেপার তৈরি করে নিয়ে এসেছেন তাদের গলায় শুনলাম ফুটবল বিশ্বে এখনো সেই কোচের সংখ্যাই বেশি, যারা ছাই উড়িয়ে পরম পাথর খুঁজে বেড়ান। কাছাকাছি মনে হলেই ঘষতে-মাজতে শুরু করেন। আমাদের ফুটবল কোচদের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা এবং ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সুযোগ বড় সীমিত। আমরা দেশের ফুটবলে পারতাম যদি সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে চিন্তার প্রসার ঘটিয়ে বিশ্বাসী হতেন। তাহলে এতগুলো বছরে পরিকাঠামোর উন্নতি হতো। বাড়তো বিজ্ঞানভিত্তিক ট্রেনিং সুযোগ-সুবিধা।

সংগঠকদের মধ্যে সব দেশেই অন্তঃকলহ এবং বিভিন্ন ধরনের মতপার্থক্য এবং বিবাদ আছে। এরপরও তারা কিন্তু জাতীয় স্বার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে একমত হন, হতে বাধ্য হন। আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে আদর্শগত শূন্যতা ক্রীড়া উন্নয়নে অন্তরায়। দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন এবং গত কয়েক বছরের ঘটনাবলির দিকে যারা নজর রেখেছেন, তাদের এটা স্পষ্ট যে, ক্রীড়াঙ্গন চলছে অনেকটা দিক ভ্রান্তভাবে। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায় সংগঠকদের। সোজাসুজি বললে বলতে হবে, তাদের অযোগ্যতা এবং ক্রীড়াঙ্গনকে পড়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সেই আগের থেকেই প্রতিবন্ধকতা। ক্রীড়াঙ্গনের জীবনে ব্যক্তির প্রাধান্য তীব্র স্বাতন্ত্র্যবাদ সব সময় চ্যালেঞ্জ।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের উদ্যোগে ফিফার আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় বিএফএফ একাডেমি চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। অংশ নিয়েছিল দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৬৮টি দল। আঞ্চলিক পর্যায়ে খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে চূড়ান্ত রাউন্ডের খেলা। এ গুরুত্বপূর্ণ চ্যাম্পিয়নশিপ কেন জানি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় তেমন নজর কাড়তে পারেনি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তি এবং সমষ্টির উদ্যোগ এবং পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হচ্ছে প্রায় ৩শ ফুটবল একাডেমি। এই ফুটবল একাডেমিগুলোই খেলোয়াড় জোগান দিচ্ছে সব সময়। ক্লাবগুলোতে নতুন খেলোয়াড় পাবার একমাত্র অবলম্বন এই একাডেমিগুলো।

দেশের ক্লাবগুলো তো নিজস্ব একাডেমি পরিচালনা করে না। পেশাদার লিগে যে দলগুলো অংশ নেয়, তাদের একাডেমি স্থাপন এবং যুব দল রাখার বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়লে ক্লাবগুলোর তোয়াক্কা করেন না। তরুণদের নিয়ে তাদের নিজস্ব মাথাব্যথা এবং পরিকল্পনা নেই। তারা চান শুধু খেলোয়াড়কে তাদের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে। কিছুদিন আগে পেশাদার লিগ কমিটি থেকে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল- সেটি ছিল বিপিএল ফুটবল যে দলগুলো আগামী মৌসুমে খেলবে প্রত্যেক দলকে অনূর্ধ্ব-১৮ একজন খেলোয়াড়কে ম্যাচে খেলাতে হবে। এতে করে দশ-এগারো জন তরুণ উদীয়মান প্রতি বছর পেশাদার লিগে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলার সুযোগ পাবেন। বড় খেলায় খেলার অভিজ্ঞতা বাড়বে। ভালো দেশি এবং বিদেশি সিনিয়র খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে।

প্রতিযোগিতামূলক খেলায় অংশগ্রহণের বদৌলতে তাদের স্কিল এবং টেকনিকেও উন্নতি সাধন ঘটবে। প্রতি বছর একজন করে খেলার সুযোগ মানে আগামী পাঁচ বছরে কম করে হলেও পঞ্চাশ জন দক্ষ খেলোয়াড় পাওয়া। এতে করে জাতীয় দলের পাইপ লাইনে খেলোয়াড়ের ঘাটতি হবে না। দুঃখের বিষয় এই প্রস্তাবটি ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাহী পরিষদের সভায় নাকচ হয়েছে। অথচ লিগ কমিটির সভাতে কিন্তু নির্বাহী কমিটির এসব সদস্য ঐকমত্য পোষণ করেছিলেন। ফুটবল সংগঠকদের একেক জায়গায় একেক ধরনের আচরণ এবং চেহারা। আমাদের জানা নেই ফুটবল ফেডারেশন ফুটবল একাডেমি চ্যাম্পিয়নশিপ এখন থেকে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে কি না। তবে এটি চালিয়ে যেতে পারলে দেশের ফুটবলের শেকড় নতুন প্রাণ শুধু ফিরে পাবে না দেশের সার্বিক ফুটবলও উপকৃত হবে।

ঢাকা থেকে অনেক দূরে যারা ফুটবল একাডেমি পরিচালনা করছেন তারা সত্যি নীরবে অসাধারণ কাজ করছেন দেশের জন্য। এদের স্বীকৃতি নয়- বড় বেশি প্রয়োজন আর্থিক সহযোগিতা। এই একাডেমিগুলো দেশের ফুটবলের জন্য সবচেয়ে কার্যকর দায়িত্ব পালন করছে। করপোরেট হাউস/বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার একাডেমিগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারে না। তাদের সিএসআর কর্মসূচির আওতায়? তৃণমূলে আলো জ্বললেই ফুটবল চত্বর আলোকিত হবে। আর এর জন্য শিকড়ে কাজ করতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২৮ বছর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের শেখার বিষয়টি বন্ধ হয়ে যায়। আর তাই একদম কম বয়সে থেকে শুরু করা ছাড়া উপায় নেই। যেসব দেশ ফুটবলে এগিয়ে চলেছে, তারা এই কাজটি সব সময় করছে।

লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ