Views Bangladesh Logo

অমর একুশে সংখ্যা ২০২৫

বিদেশি ভাষা ব্যবহারে জাতীয় ভাষানীতি অবলম্বন করতে হবে

ভ্যন্তরীণ ও আন্তঃরাষ্ট্রিক ঘাত-প্রতিঘাত ও সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গতিশীল থাকে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে উপজাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায়, বিশেষ আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন জনগোষ্ঠী, ভাষাগত পার্থক্য ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠী দেখা দেয়। রাষ্ট্রের জনপ্রকৃতিতে বিরাজ করে বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যর স্বীকৃতি দিয়ে, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয়- এই নীতি অবলম্বন করে সরকারকে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ জনপ্রকৃতির বৈচিত্র্যগত সমস্যার সমাধান করতে হয়। সংস্কৃতির বহুত্ববাদের (Pluralism in culture) কথা বলে জাতির ভেতরে অনৈক্য সৃষ্টি করলে জাতি টেকে না। তাতে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের শর্তও নষ্ট হয়।

ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে জাতীয়তাবাদী আদর্শের স্বাভাবিক বিকাশের অভাবে এবং চিন্তা-চেতনার পশ্চাৎবর্তিতার কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্তিম পর্যায়ে দেখা দেয় হিন্দু ও মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদ- উদ্ভাবিত হয় দ্বিজাতিত্ত্ব। শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদের স্থলাভিষিক্ত হয় সাম্প্রদায়িকতাবাদ, এবং সাম্প্রদায়িকাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় দুই রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। এর দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশে জাতি-সমস্যার সমাধান হয়নি। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ভারতকে বলা হত পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সরলরৈখিক দূরত্ব ছিল এগারো শত মাইল। আর দুই অংশের জনগণের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ছিল আলাদা। ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হতে থাকে। বাংলাদেশও একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে।

তৎকালীন পাকিস্তানে দেখা যায় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমস্যা, জাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে সমস্যা, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে সমস্যা, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন নিয়ে সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানে দেখা দেয় পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, এবং ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ। তৎকালীন পাকিস্তানে লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা সৃষ্টির চেষ্টা, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির চেষ্টা, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও প্রবর্তনের সমস্যা কানোটারই সমাধান হয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে জাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিপন্থি যে কোনো আয়োজন ও চেষ্টার বিরুদ্ধেই এই ভূ-ভাগের জনগণ প্রবলভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদকেন্দ্রিক স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা অচিরেই স্বায়ত্তশাসনের রাজনৈতিক দাবিতে রূপান্তরিত হয় এবং সেই দাবিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে গণআন্দোলন। এই স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের সূত্রপাত রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে। আমাদের ভোলা উচিত নয় যে, প্রশ্ন মাতৃভাষা নিয়ে ছিল না, ছিল রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। গোটা ব্যাপারটিই ছিল রাষ্ট্রনৈতিক।

তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝখানে ভারতের অবস্থান। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতারা, যারা পাকিস্তানকে চিরস্থায়ী রাষ্ট্ররূপে প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন, তারা ভারতকে পাকিস্তানের জন্য বিপজ্জনক মনে করতেন। তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে, প্রগতিশীল লেখকদের এবং রাজনৈতিক নেতাদেরও বিশ্বাস করতেন না। তারা মনে করতেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সুযোগ পেলেই পাকিস্তানে থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এই অবিশ্বাস নিয়ে তারা এককেন্দ্রিক সংহত পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কঠোর দমননীতি অবলম্বন করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার দাবিও অবলম্বন করে দানা বাঁধে ও নিরন্তর বিকশিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন- যার প্রকৃত রূপ ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

উর্দু ছিল পাকিস্তানের দুই অংশের অল্প কিছু আশরাফ বা অভিজাত পরিবারের ভাষা। পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বালুচ ও পশতু ছিল যথাক্রমে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনগণের ভাষা। আর বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভাষা। ভাষার সঙ্গে প্রদেশগুলোর আলাদা আলাদা সংস্কৃতির প্রশ্নেও রাজনৈতিক মহল সচেতন ছিল। এ-অবস্থায় পাকিস্তানবাদীদের পক্ষ থেকে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংহতির উদ্দেশ্যে একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালানো হল। পাকিস্তানবাদীদের সামনে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দেয়।

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন চলাকালে ১৯৫২ সনের একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে ও ফাঁকা গুলি চালায়। ঘটনাক্রমে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত শহীদ হন। এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই গোটা পূর্ব বাংলাব্যাপী রাজনৈতিক অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আন্দোলন বেড়ে চলে। সরকার আন্দোলনের নেতাদের কারারুদ্ধ করে চলে। আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার কৌশলের পর কৌশল অবলম্বন করে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই আন্দোলন থামাতে সক্ষম হয়; কিন্তু এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক চেতনার যে স্ফুরণ ঘটে তা থেমে যায়নি বিকাশমান আবেগ রূপে বহমান থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয় শহীদ দিবস এবং প্রতি বছর তীব্র আবেগের সঙ্গে এই দিন উদযাপিত হয় শহীদ দিবস রূপে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মর্মে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠা করার আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেইসঙ্গে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় চেতনা, স্বতন্ত্র জাতীয় সংস্কৃতির চেতনা, গণতন্ত্রের চেতনা, আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ব্যাপারে ন্যায়বিচারের চেতনা। ওই গোটা চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল পূর্ববাংলার সকল স্তরের জনগণ। শেষ পর্যন্ত যারা এর বিরোধিতা করত তাদের সংখ্যা স্বল্প ছিল। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ত্রুটি-বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ও বিকার-বিকৃতিকে পটভূমিতে রেখেই বিকশিত হয়েছিল পাকিস্তানকালের আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও জাতীয়তাবাদী চেতনা। তখন রাষ্ট্রভাষার দাবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপার। প্রথমেই সব কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি ধাপে ধাপে স্পষ্ট হয়েছে।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে যে চেতনা রূপ লাভ করে, পরবর্তী সময়ে বছরগুলোতে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে তা গভীর, ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী হয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে সেকালে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানাদি ছিল খুবই সৃষ্টিশীল। প্রতি বছর ওইসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জনগণের চেতনা ক্রমাগত উন্নত হয়েছে। মানুষের মধ্যে বিকশিত হয়েছে প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা। তখন লেখক ও শিল্পীরাও অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। জ্ঞানচর্চা এবং সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে সাধিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য উন্নতি। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা, আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ন্যাপের চৌদ্দ দফা, ছাত্র সংগ্রাম কমিটির এগারো দফা বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের জাতীয় অভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা-যুদ্ধ সবই ঘটেছে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনার বিকাশের ধারাবাহিকতায়। ইতিহাসের যত গভীরে ও বিস্তারে দৃষ্টি দেয়া যাবে, ততই এ-ব্যাপারটি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর রূপে বোঝা যাবে।

বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তানকালের চেতনা রূপান্তরিত হয়ে বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে যায়। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা, আওয়ামী লীগের ছয় দফা, ন্যাপের চৌদ্দ দফা এবং ছাত্র সংগ্রাম কমিটির এগারো দফার ধারায় বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক-সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গতি পায়নি। এর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও আদর্শগত পরিবর্তনের ফলে বিশ্ববাস্তবতা বদলে গেছে। এ অবস্থায় আজ দরকার সৃষ্টিশীল চিন্তা ও কর্মের নতুন ধারা। রাষ্ট্র গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা পাকিস্তানকালে আমাদের জীবন ধারায় ছিল, আজকের বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশে তার প্রয়োজন আগের তুলনায় বেড়েছে বই কমেনি। বাংলাদেশের ভূভাগে জনগণের শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের সংকল্প হোক আজ আমাদের সংকল্প। রাষ্ট্রগঠনের জন্য গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি সব আদর্শের প্রতি সংশ্লেষণমূলক দৃষ্টি নিয়ে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে বিকশিত ও কার্যকর করতে হবে। গণতন্ত্রের মধ্যে সংশ্লেষিত করে নিতে হবে সব আদর্শকে।

উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ হলো জাতীয়তাবাদের বিকার। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোতে এই বিকার দেখা দেয়। ফলে বিশ্বব্যাপী জাতিরাষ্ট্রের বাস্তবতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা-ছাড়া রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখা দেয়। এতে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ মীমাংসার ও সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভূত হয়। এ অবস্থায় দেখা দেয় আন্তর্জাতিকতাবাদ। আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতি রাষ্ট্রগুলোকে রক্ষা করতে ও বিকশিত করতে উদ্যোগী হয়। এক রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য রাষ্ট্র যাতে হস্তক্ষেপ না করে, তার ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করে। তাদের মধ্যকার বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা চায়, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মানবজাতির সংহতি গড়ে তুলতে চায়। আন্তর্জাতিকতাবাদকে সফল করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতিসংঘ। আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবদের সম্পূরক। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের (১৯৯১) পর দেখা দিয়েছে বিশ্বায়নের মতবাদ। এর কেন্দ্রীয় প্রবণতা এককেন্দ্রিক বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে। বৃহৎ শক্তিবর্গের কূটনীতি, গোয়েন্দানীতি, সংস্কৃতিনীতি, বাণিজ্যনীতি ও যুদ্ধনীতিকে অবলম্বন করে বিকশিত হচ্ছে বিশ্বায়নের কার্যক্রম। কার্যক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিই বিশ্বায়ন। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো বিশ্বায়নের অভিঘাতে বিপর্যয় মোকাবিলা করে চলছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ হতে হলে হয়ে উঠতে হবে প্রকৃত জনগণের রাষ্ট্র, এবং তাদের অবলম্বন করতে হবে জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ। বাংলাদেশকেও তাই করতে হবে। তা করা হলেই আজকের বিশ্বব্যবস্থায় আমরা আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিক বিকাশের দিকে এগোবো।

কোনো সুদূর ভবিষ্যতে জাতীয় সংস্কৃতি ও জাতিরাষ্ট্র অবশ্যই বিলুপ্ত হবে, এবং বিশ্বসংস্কৃতি ও বিশ্বরাষ্ট্র গড়ে উঠবে; কিন্তু তা অদূর ভবিষ্যতে হবে না। একথা মনে রেখে আমাদের আত্মশক্তি বৃদ্ধির, আত্মনির্ভরতার এবং স্বদেশে নিজেদের প্রগতিশীল উন্নত জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আন্তর্জাতিকতাবাদের নীতি অনুসরণ করতে হবে। বাইরের জগৎ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বৈষয়িক সম্পদ আমাদের গ্রহণ করতে হবে এবং তার প্রতিদানও দিতে হবে; কিন্তু পরনির্ভরতা ত্যাগ করতে হবে। আমাদের দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। আমাদের জনগণ পরিশ্রমী এবং উদ্ভাবনশীল। যদি আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী করে গড়ে তুলতে পারি তাহলে আমাদের সৃষ্টিশীলতা গোটা মানবজাতির সামনে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হবে। এর জন্য দরকার উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, রাজনৈতিক দল ও সরকার।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বলে ঘোষণা করছে। এ উপলক্ষে আমাদের দেশে একুশে ফেব্রুয়ারিতে অনেকেই পৃথিবীর ‘অন্তত আট হাজার মাতৃভাষা’ নিয়ে আলোচনা করেন। তারা উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিসমূহের বিলীয়মান মাতৃভাষাসমূহকে রক্ষা করার উপায় সন্ধান করেন। অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পশ্চাৎবর্তী জাতি বা উপজাতিগুলোকে তাদের মাতৃভাষা রক্ষার কাজে সহায়তা করেন, আর্থিক সহায়তাও দিয়ে থাকেন। তাদের ভাষার জন্য বর্ণমালা চালু করার আয়োজন করেন। তাদের ভাষার মাধ্যমে তাদের অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের জন্য সরকারকে তাগিদ দিয়ে থাকেন। বিলীয়মান মাতৃভাষা সমূহকে রক্ষা করার নানা উপায় তারা প্রস্তাব করেন। পৃথিবীর যে দুইশো ভাষায় দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, সেগুলোর অবস্থা তারা অল্পই বিবেচনা করেন। এই দুইশ ভাষার মধ্যে দুর্বল জাতিসমূহের ভাষাগুলো বিলীয়মান। এসব ভাষার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। এই জাতিগুলো যদি নিজেদের শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করতে না পারে তাহলে তাদের ভাষা কতটা রক্ষা পাবে? রাষ্ট্র না থাকলে রাষ্ট্রভাষাও থাকে না। রাষ্ট্রভাষা না থাকলে, জাতীয় ভাষাকে বিলীয়মান অবস্থায় ছেড়ে দিয়ে, কেবল মাতৃভাষার চর্চা করে কী হবে?

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কার্যক্রম দ্বারা কী অর্জনের চেষ্টা করা হয় এবং কী অর্জন করা হয়, তা বিচার-বিবেচনা করে দেখা দরকার। উপজাতি বা জাতিসমূহের সার্বিক উন্নতির প্রশ্ন বিবেচনা করে তাদের ভাষা সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে।

আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, রাষ্ট্রভাষা আর মাতৃভাষা এক নয়। মাতৃভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মানুষে অর্জন করে; কিন্তু রাষ্ট্রভাষা শিক্ষা দ্বারা, সাধনা দ্বারা, পাণ্ডিত্যের দ্বারা, জ্ঞান-গরিমা নিয়ে অর্জন করতে হয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থার অভ্যন্তরে রাষ্ট্রভাষাকে সক্রিয় করতে হবে। বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসন ব্যবস্থায় এবং শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে রাষ্ট্রভাষাকে কার্যকর করতে হবে। চর্চার মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষাকে বিকাশশীলও রাখতে হয়। মাতৃভাষার চর্চা বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও ক্ষুদ্র পরিবেষ্টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। মাতৃভাষা দ্বারা জীবনকে বেশি উপভোগ করা যায়। আর মাতৃভাষাকে অবলম্বন করেই রাষ্ট্রভাষা গড়ে ওঠে। তবু মাতৃভাষার সঙ্গে রাষ্ট্রভাষার অনেক পার্থক্য। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আয়োজনকে আমরা যাতে রাষ্ট্রভাষার কার্যক্রমের সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলি, সেজন্য আমাদের বিশেষ সচেতনতা দরকার। মাতৃভাষার ব্যবহার আজীবন আমরা আমাদের জীবনে চাই; সেই সঙ্গে চাই রাষ্ট্রভাষার অনুশীলন। রাষ্ট্রভাষাকে যেন আমরা মাতৃভাষার চেয়ে গৌণ করে না দেখি এই হোক আজ আমাদের আন্তরিক কামনা। মাতৃভাষার জন্য রাষ্ট্রভাষা ত্যাগ করলে, কিংবা রাষ্ট্রভাষার জন্য মাতৃভাষা ত্যাগ করলে মারাত্মক ভুল করা হবে। উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতি মানুষের বেলায় সমস্যার প্রকৃতি ভিন্ন। বাইরের আয়োজন দিয়ে তাদের ভাষা বা সংস্কৃতিকে উন্নত করে দেওয়ার চেষ্টা করলে, তাদের ধর্মান্তরিত করলে তাতে সুফল হবে না। পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে তাদের স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে দিতে হবে।

প্রযুক্তির বিকাশ, বিশ্বায়নের আয়োজন, আর ইংরেজি ভাষার প্রসার দেখে অনেকেই আজ বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ ব্যাপারে শিথিল মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। সবাই যেন ধরে নিয়েছেন যে, মাতৃভাষার পরিমণ্ডলের বাইরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বেশি দিন চলবে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল। রাষ্ট্রভাষা কেবল সংবিধানে থাকলে হবে না, রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল স্তরে তার জীবন্ত ব্যবহার থাকতে হবে। রাষ্ট্রভাষার তথা জাতীয় ভাষার বিকাশের অনুকূলে আজ দরকার জাতীয় ভাষানীতি। জাতীয় ভাষানীতির প্রশ্নে যে চিন্তা-ভাবনা আজ দরকার, দেশের বিবেকবান চিন্তাশীল সবাইকে সাহসের সঙ্গে তা ব্যক্ত করতে হবে। সরূপ-বিরূপ আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের দিকে আমাদের যেতে হবে। বিচার-বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত আমাদের বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলবে। ইংরেজি আমরা গ্রহণ করব, সেই সঙ্গে ইংরেজি ভাষার জ্ঞান দিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করব। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে আমরা অবারিত রাখব। শুধু ইংরেজি কেন সকল ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় শব্দসম্পদ ও ভাবসম্পদ গ্রহণের বেলায় আমরা গোঁড়ামি ত্যাগ করব এবং কল্যাণকর উদারনীতি অবলম্বন করব এই হোক আমাদের মনোভাব। জাতীয় ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করতে গেলে আমার ভুল করব এবং ক্ষতিগ্রস্ত হব। ভাষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাই হোক আমাদের মূল অবলম্বন।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার এবং ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ, চিনা, জাপানি, আরবি, ফারসি, প্রভৃতি ভাষার ব্যবহার কোথায় কতখানি করতে হবে, এবং এসব ভাষা শিক্ষার কী ব্যবস্থা বাংলাদেশে করা হবে, সে সম্পর্কে একটি জাতীয় ভাষানীতি অবলম্বন করতে হবে। সরকার একাজে না এগোলে দেশের বিবেকবান চিন্তাশীল শিক্ষিত ব্যক্তিরা এগোতে পারেন। তারাও যদি তা না করেন, তা হলে বাংলাদেশে কার্যক্ষেত্রে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষারূপে কিংবা জাতীয় ভাষারূপে অস্তিত থাকবে না- কেবল মাতৃভাষা রূপেই থাকবে।

আবুল কাসেম ফজলুল হক: চিন্তাবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ