এসডিজি অর্জনে নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন জরুরি
বাংলাদেশ বিকাশমান একটি উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের দেশে নারী উদ্যোক্তাদের বিকশিত হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে নারী উদ্যোক্তারা তাদের সৃজনশীল প্রতিভাকে বিকশিত করার মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে। ২০১৩ সালের ইকোনমিক সেন্সাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৭৮ লাখের মতো এন্ট্রারপ্রাইজ ছিল। এর মধ্যে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ ছিলেন নারী উদ্যোক্তা। আমরা আগামী সেন্সাসের জন্য অপেক্ষা করছি। গত ১১ বছরে দেশে উদ্যোক্তার সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারও কারও মতে, বর্তমানে দেশে নারী উদ্যোক্তার হার ২০ শতাংশ। কারও মতে এ সংখ্যা আরও বেশি।
সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্কে না গেলেও আমরা বলতে পারি, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণের হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী পুরুষের মিলিত উদ্যোগেই একটি দেশের অর্থনীতি বিকশিত হতে পারে। নারীদের পেছনে ফেলে রেখে টেকসই উন্নয়ন কোনোভাবেই প্রত্যাশা করা যায় না। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে কাউকে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা থেকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। বর্তমান সরকার এসডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য নারীদের উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন।
এমন এক সময় ছিল যখন সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে নারী কর্মকর্তার হার ছিল খুবই নগন্য। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। ১২ জন সচিবই এখন নারী। নারীরা প্রমান করেছে সুযোগ পেলে তারা জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারেন। বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীরা ভালো রেজাল্ট করছে। এরাই পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে নিচ্ছে। কেউ বা স্বকর্মসংস্থানের প্রতি আগ্রহী হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। বর্তমানে যেসব নারী উদ্যোক্তা বা কর্মী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন তারা আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ। ফলে তারা ছেলেদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে কর্মস্থলে টিকে থাকতে পারছেন।
আমরা যখন নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করেছি তখন প্রত্যক্ষ করি, আমাদের দেশে তিন শ্রেণি বা ধরনের নারী উদ্যোক্তা আছেন। এদের একটি শ্রেণি বৃহৎ পরিসরের উদ্যোক্তা। এরা সাধারণত পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উদ্যোক্তা হয়েছেন। কোনো একটি শিল্পগোষ্ঠী হয়তো অনেক বড় হয়ে গেছে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বামী তার স্ত্রীকে অথবা ভাই তার বোনকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অর্পন করলেন। নারীরা এসব প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন। এরা ব্যবসায় বা শিল্প-কারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবার থেকে সাপোর্ট পাচ্ছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তা হয়তো নিজেই একটি বড় ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। আর একটি শ্রেণির নারী আছেন যারা পরিস্থিতির কারণে উদ্যোক্তা হয়েছেন। হয়তো স্বামী মারা গেছেন অথবা পরিবারে আর্থিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। পরিবারের আর্থিক ব্যয়ভার নির্বাহের মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি একসময় নিজেই উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হয়ে সংসারের ব্যয় নির্বাহের উদ্যোগ নিয়েছেন। এরা সাধারণত স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় বা শিল্পকারখানা পরিচালনা শুরু করেন। এই ধরনের নারী উদ্যোক্তাদের যেহেতু কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকে না তাই তাদের প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য প্রচুর সংগ্রাম এবং কষ্ট করতে হয়। এই ধরনের উদ্যোক্তারা সাধারণত ক্ষুদ্র আকারের উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে থাকেন। পরিস্থিতির কারণে যেসব নারী উদ্যোক্তা হয়েছেন তাদের মধ্য থেকে পরবর্তীতে বৃহৎ উদ্যোক্তায় পরিণত হবার নজীর খুবই কম। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত হন; কিন্তু বেশির ভাগই সমস্যার মধ্যে থেকে যান। আর এক শ্রেণির নারী উদ্যোক্তা আছেন যারা শিক্ষা জীবন থেকেই উদ্যোক্তা হবার চেষ্টা করে থাকেন। এরা যেহেতু আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি জ্ঞানে সমৃদ্ধ তাই তারা বেশ ভালো করছেন। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এরা বেশ পারদর্শী। যারা ছাত্র জীবন থেকে উদ্যোক্তা হবার চেষ্টা করেন তারা অত্যন্ত সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারি। এদের প্রয়োজনীয় সমর্থন ও সহযোগিতা দেয়া গেলে ভবিষ্যতে এরা অত্যন্ত ভালো করবেন এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
আমরা যখন মাঠ পর্যায়ে স্টাডি করেছিলাম তখন প্রত্যক্ষ করি, নারী উদ্যোক্তাদের ৪ ধরনের নিড (প্রয়োজন) আছে। তাদের সবচেয়ে বড় যে প্রয়োজন তাহলে অর্থায়ন সমস্যা। তারা চাইলেই সব সময় পরিবার থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায় পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন জোগান করতে পারেন না। অনেক নারী উদ্যোক্তাকে দেখেছি, প্রভুত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু অর্থায়ন জোগান করতে না পারার কারণে তারা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। নারী উদ্যোক্তারা যখন ঋণ গ্রহণের জন্য ব্যাংকে যান ব্যাংক তখন তাদের ঋণদানের ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহ প্রদর্শন করে না। ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের আস্থায় নিতে পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংক ঋণ পেতে হলে জামানত দিতে হয়। নারী উদ্যোক্তাদের পক্ষে অধিকাংশ সময়ই জামানত দেয়া সম্ভব হয় না। ব্যাংক নানাভাবে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে। অথচ বিভিন্ন গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে যে, নারী উদ্যোক্তারা সাধারণত ঋণ খেলাপি হন না। তারা পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় ঋণের কিস্তি পরিশোধে বেশি নিয়মিত।
নারী উদ্যোক্তাদের আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব। আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য প্রয়োজন ভিত্তিক (need-based) নতুন নতুন খাতে অংশগ্রহণের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নেই। যে কোনো কাজে সাফল্য অর্জন করতে চাইলে প্রশিক্ষণ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
নারী উদ্যোক্তাদের আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে তথ্য প্রাপ্তির অপর্যাপ্ত সুযোগ। নারী উদ্যোক্তারা তাদের আশপাশের মানুষের কাছে পণ্যের বাজার এবং অন্যান্য বিষয়াদির তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন। তবে বর্তমানে যারা নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগই উচ্চ শিক্ষিত এবং তুলনামূলকভাবে সচেতন। তারা বিভিন্নভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারছে। বিশেষ করে গুগলের মাধ্যমে যে কোনো তথ্য তারা সহজেই পেয়ে যাচ্ছেন। এসব সমস্যা দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যমান রয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
বিভিন্ন পলিসি সাপোর্ট প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও পুরুষ উদ্যোক্তারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি ব্যবহার করে থাকেন। যদিও কোনো কোনো নারী উদ্যোক্তারাও পলিসি সাপোর্ট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন; কিন্তু সেটি তারা সঠিকভাবে ব্যবহার করে সুযোগ নিতে তেমনভাবে প্রতিযোগী হতে পারছেন না। অবশ্য একটি গবেষণায় দেখেছি, নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় বা শিল্পের পরিধি যেহেতু ছোট এবং তারা অনেক কাজ নিজেরাই কাজগুলো সম্পন্ন করেন তাই কোনো কোনো রেগুলেটরি বিষয় যেমন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ, নবায়নের ক্ষেত্রে তারা পুরুষের চেয়ে কম সময়ে সেটা সম্পন্ন করতে পারেন।
পলিসি রিলেটেড সহায়তার ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। সরকার বরং নারী উদ্যোক্তাদের বেশি সহযোগিতা ও সমর্থন করতে চাচ্ছেন যাতে আরও অধিক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হতে পারে। নারী উদ্যোক্তাদের ট্যাক্স রিলেটেড কিছু সুবিধা দেয়া হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে এসব সুবিধার বেশির ভাগই পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে তারা ব্যবহার করতে পারেন না। যেমন মহিলা উদ্যোক্তার বার্ষিক টার্নওভার ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত করপোরেট কর বাধ্যতামূলক নয়। আর একটি সুবিধা রয়েছে এমন, যাদের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লাখ টাকার কম তাদের ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে না। অর্থাৎ মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২-এর ধারা ২ (৪৮) অনুযায়ী মূসক অব্যাহতি সীমা ৫০ লাখ টাকা নির্ধারিত আছে; কিন্তু সাধারণ আদেশ নং ১৭/মূসক/২০১৯ জারির ফলে অধিকাংশ ব্যাবসা এ অব্যাহতি সুবিধা হতে বঞ্চিত হচ্ছে এবং মাঠ পর্যায়ে মূসক কর্মকর্তারা সকল ব্যবসাকে মূসক প্রদানে বাধ্য করছে। এই আদেশের মাধ্যমে ১৬২টি পণ্য ও সেবা খাতকে টার্নওভার নির্বিশেষে ভ্যাট প্রদানের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন, লজেন্স, চুইংগাম, নেইলস এবং সেবার ক্ষেত্রে যেমন বিউটি পার্লার, শব্দ ও আলোক সরঞ্জাম ভাড়া প্রদানকারী সংস্থা যাদের বার্ষিক টার্নওভার অব্যাহতি প্রাপ্ত সীমার নিচে তাদের জন্য টার্নওভার নির্বিশেষে ভ্যাট প্রদান করা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য।
২০২২ এই আদেশ সংশোধন করা হয়েছে। উক্ত আদেশটি বহাল রেখে এর সঙ্গে আরও দুটি সেবার নাম (ই-সিম এবং তাপানুকূল নৌযান সার্ভিস) যুক্ত করা হয়ছে (সাধারণ আদেশ নং-০৬/মূসক/২০২২)। অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যেমন; বিস্কুট, চানাচুর, ছাপাখানা, মিষ্টান্ন ভান্ডার, বিউটি পার্লার, নেইলস, প্ল্যাস্টিক পণ্য, কাঠের পণ্য প্রস্ততকারী অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কাজেই নারী উদ্যোক্তা গণ-রেজিস্ট্রেশন ও ভ্যাট-সংক্রান্ত যে সুবিধা পাবার কথা তা তারা পাচ্ছেন না। এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য আমরা একাধিকবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অনুরোধ করা হয়েছে; কিন্তু তারা এখনো পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো কার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু আছে। কিছু পুনঅর্থায়ন স্কিম আছে যেখানে মহিলা উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেয়া আছে। এমনকি আমাদের শিল্পনীতিতে বলা আছে মোট অর্থায়নের অন্তত ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দিতে হবে; কিন্তু ব্যাংকগুলো নারী উদ্যোক্তাদের মোট ঋণের ১৫ শতাংশ দিতে পারছে না। কারণ ব্যাংকের যে নিয়ম-কানুন তাতে নারী উদ্যোক্তারা ঋণ প্রাপ্তির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হন না। ব্যাংক ঋণ পেতে হলে যেসব নিয়ন কানুন মানতে হয় বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তার পক্ষে তা মানা সম্ভব হয় না। বিশেষ করে জামানত দিতে হয়। নারী উদ্যোক্তাদের অধিকাংশেরই জামানত যোগ্য সম্পদ না থাকায় তারা ব্যাংক থেকে ঋণ পান না।
আরও একটি সমস্যা হচ্ছে এই রকম- হয়তো কোনো সময় ১০০ কোটি টাকার একটি ফান্ড ঘোষণা করা হলো ‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্ট্রারপ্রাইজ’ (সিএমএসএমই) সেক্টরের উদ্যোক্তাদের জন্য। প্রথমে মাঝারি উদ্যোক্তা, তারপর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে এ ঋণ প্রদানের পর কুটির ও অতিক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য অবশিষ্ট কমই থাকে। মিডিয়াম বা মাঝারি শিল্পের সঙ্গে বড় শিল্পের খুব একটা পার্থক্য নেই। আমরা একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বলেছি, যদি সত্যি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করতে হয় তাহলে কটেজ অ্যান্ড মাইক্রো শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা একটি ফান্ড প্রদান প্রয়োজন। বর্তমানে অবশ্য কোলেটারাল মুক্ত ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে কুটির, অতি খুদ্র, খুদ্র এবং মিডিয়াম স্কেল শিল্পও ঋণ পেতে পারেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকেও পদক্ষেপ প্রশংসনীয় এ ব্যাপারে একটি ক্রেডিট গ্যারান্টি ডিপার্টমেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। এটি সঠিকভাবে কাজ করলে এদের অর্থায়ন সমস্যা কিছুটা হলেও নিরসন হবে।
শিল্প নীতিতে নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দানের নির্দেশনা দেয়া হলেও সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের জামানত মুক্ত ঋণদানের নির্দেশনা দেয়া হলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে নারী উদ্যোক্তারা প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছেন। করোনাকালিন সময় খুলনা এলাকায় কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি একজন নারী উদ্যোক্তা মাত্র ৪০ হাজার টাকা ঋণের জন্য কতটা প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন; কিন্তু ব্যাংক তাকে সেই ঋণ তারা পায়নি। যে ইনসেন্টিভ প্যকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল তাও অনেক ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করতে পারেননি। যারা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের সামান্য অর্থায়ন করা হলেই উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করে যেতে পারেন।
বিভিন্ন সেক্টরে যেসব সম্ভাবনাময় নারী উদ্যোক্তা রযেছেন তাদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা করা হলে নারী উদ্যোক্তারা বিকশিত হতে পারবেন। দেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক এবং নীতিগত সহায়তা করা হলে তারা উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারবেন। তাদের প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। পূর্বেই বলা হয়েছে, নারী উদ্যোক্তারা সাধারণত ঋণ খেলাপি হন না। তারা গৃহীত ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ করেন। কাজেই ব্যাংক যদি নারী উদ্যোক্তাদের চাহিদা মতো ঋণদানের ব্যবস্থা করে তাহলে ব্যাংকের ঋণ নিরাপদ থাকবে। সরকার বিভিন্ন সময় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যেসব আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন তা ঠিক মতো উপকারভোগির নিকট পৌঁছালো কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ জন্য তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের ক্ষেত্রে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো সহ-জামানতের প্রয়োজন হবে না বিশয়ে নিতিমালায় থাকলেও তা বাস্তবে তেমন কার্যকর নয়; কিন্তু এই নীতি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আমি খুব কম নারী উদ্যোক্তাকেই দেখেছি যারা সহজামানত ছাড়া ঋণ পেয়েছে। নারী উদ্যোক্তাগণ যাতে সহজামানত ছাড়াই ঋণ পেতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় একজন নারী উদ্যোক্তার পক্ষে সহজামানত প্রদান করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। তাই সম্ভাবনাময় অনেক নারী উদ্যোক্তা ব্যাংক থেকে অর্থায়ন গ্রহণ করতে পারছেন না। আর অর্থায়নের অভাবে তারা শিল্প প্রতিষ্ঠান সম্প্রসারিত করতে পারছেন না। এ ছাড়া সহজামানত বিহীন ঋণের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকার পরিবর্তে ৫০ লাখ টাকা করা যেতে পারে যদি সে উদ্যোক্তা সঠিক জায়গায় বিনিয়োগ করেন এবং অর্থায়ন সংস্থা সঠিক মূল্যায়্ন করেন।
ব্যাংক থেকে ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তারা কিছু অসুবিধায় পড়েন। ব্যাংক ঋণ পেতে হলে একজন নারী উদ্যোক্তার ট্রেড লাইসেন্স থাকতে হয়; কিন্তু যারা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা তাদের অধিকাংশেরই ট্রেড লাইসেন্স থাকে না। ফলে তারা ব্যাংক থেকে ঋণ পান না। নারী উদ্যোক্তাদের অনেকের মাঝেই সৃজনশীল প্রতিভা রয়েছে। সেই প্রতিভা কাজে লাগিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করছেন; কিন্তু উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান কীভাবে আরও উন্নত করা যায়। উৎপাদিত পণ্য কীভাবে বাজারজাত করতে হয় এসব ব্যাপারে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা থাকে না। ফলে তারা বাজারে পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন। কোনো পণ্য শুধু অভ্যন্তরীণ বাজারের উদ্দেশ্যে উৎপাদন করলে সেই পণ্য উৎপাদনের সম্ভাবনা পূর্ণ মাত্রায় কাজে লাগানো যাবে না। আমাদের সব সময়ই স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানির প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। বর্তমান যারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখা সহজ হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়, বিশেষ করে করোনাকালীন অবস্থায় ই-কমার্স ব্যবসায় বেশ সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল। এখনো ই-কমার্স ব্যবসায়ের ভালো সম্ভবনা রয়েছে; কিন্তু ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের ব্যাংক থেকে অর্থায়ন প্রাপ্তির কোনো সুযোগ কম কারণ তারা ট্রেড লাইসেন্স পেতে সমস্যার সম্মুখিন হন। এ ক্ষেত্রে ডিবিয়াইডি নামে একটি ব্যবস্থা বাণিজ্য করলেও এ ডিজিটাল বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর এখনো ট্রেড লাইসেন্স ও বিকল্প হিসেবে ধরা হচ্ছে না। এই সমস্যা দূরীকরণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। কাজেই তাদের বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন প্রচেষ্টা সফল হতে পারে না। আমি মনে করি, দেশে নারী উদ্যোক্তা বান্ধব কার্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের নিতিমালা ও বাস্তবায়নের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য নিরসন করা দরকার।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও প্রধান নির্বাহী, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে