Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার-২০২৪

হান ক্যাংয়ের নোবেল জয় মানেই মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখে দাঁড়ানোর শক্তি

Dulal Al  Monsur

দুলাল আল মনসুর

শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪

০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার কথাসাহিত্যিক হান ক্যাং। নারী লেখক হিসেবে ১৮তম এবং নোবেল পুরস্কারের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিজয়ীদের মধ্যে ১২১তম সাহিত্যিক হিসেবে পেলেন এ পুরস্কার। নোবেল কমিটির মন্তব্য অনুসারে, ‘ইতিহাসজাত মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখে দাঁড়ানোর শক্তি এবং মানব জীবনের ভঙ্গুরতার চিত্র উন্মোচন করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্যের’ জন্য তাকে দেয়া হলো এবারের নোবেল পুরস্কার। নোবেল একাডেমির দৃষ্টিতে, ‘তার কাব্যিক ও নিরীক্ষাধর্মী গদ্যের কারণে হান সমকালীন গদ্যের একজন উদ্ভাবকের মর্যাদায় উঠেছেন। ৫৩ বছর বয়সী নোবেল লরিয়েট হান ইতোমধ্যে সারাবিশ্বেই তার পরিচিতি এবং মনোযোগী পাঠক পেয়েছেন।

হান ক্যাংয়ের জন্ম ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর দক্ষিণ কোরিয়ায়। তিনি বেড়ে উঠেছেন সাহিত্যিক আবহে। বাবা হান সিউং ওন ঔপন্যাসিক। তার ভাই হান ডং রিমও লেখক। হান ক্যাং ইয়নসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরীয় সাহিত্যে পড়াশোনা করেন। তার লেখালেখির শুরু কবিতা এবং ছোটগল্প দিয়ে। ১৯৯৩ সালে ‘লিট্রেচার অ্যান্ড সোসাইটি’ পত্রিকার শীতকালীন সংখ্যায় তার পাঁচটি কবিতা প্রকাশ করা হয়। সেগুলোর একটি হলো ‘উইন্টার ইন সিউল’। পরের বছর ‘দৈনিক সিউল শিনমিং’ পত্রিকার বসন্ত সংখ্যায় ছোট গল্প শাখার প্রতিযোগিতার প্রথম পুরস্কার পায় তার প্রকাশিত প্রথম ছোট গল্প ‘দ্য স্কারলেট অ্যাংকর’।

১৯৯৫ সালে প্রকাশ করা হয় তার প্রথম গল্প সংকলন ‘লাভ অব ইয়েওসা’। তিনি পাঠকদের মাঝে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন ১৯৯৫ সালে তার উপন্যাস ‘আ কনভিট্কস লাভ’ প্রকাশের পর। বাহুল্যবর্জিত যথার্থতার জন্য তার এ রচনাটি বোদ্ধাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। তার অন্যান্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ‘মাই উওম্যানস ফ্রুটস’ (২০০০), ‘দ্য ব্ল্যাক ডিয়ার’ (১৯৯৮), ‘ইওর কোল্ড হ্যান্ডস’ (২০০২), ‘মাই নেইম ইজ সান ফ্লাওয়ার’ (২০০২), ‘দ্য রেড ফ্লাওয়ার স্টোরি’ (২০০৩), ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ (২০০৭), ‘টিয়ার বক্স’ (২০০৮), ‘ব্রিদ ফাইটিং’ (২০১০) ‘গ্রিক লেসনস’ (২০১১) ইত্যাদি।

অল্প বয়স থেকেই কবিতার প্রতি তার টান ছিল। কলেজজীবনে ই স্যাংয়ের কবিতার একটি পঙক্তি হানের মানস জগতে নাড়া দিয়ে যায়। পঙক্তিটি হলো- ‘আমি বিশ্বাস করি, মানুষের উচিত বৃক্ষে রূপান্তরিত হওয়া।’ ঔপনিবেশিক আমলে যে ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছে, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো উৎসাহ তিনি এখান থেকেই পান এবং এখানকার উৎসাহের বলেই তিনি তার সবচেয়ে সফল সৃষ্টিকর্ম ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ লিখতে পারেন। ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ উপন্যাসের জন্য ২০১৬ সালে তিনি ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কার পান। মনুষ্য নিষ্ঠুরতা এড়িয়ে চলার জন্য এক নারী মাংস খাওয়া বর্জন করে। তাকে নিয়েই উপন্যাসের কাহিনি তৈরি হয়েছে। কোরীয় ভাষা থেকে এ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ব্রিটিশ অনুবাদক ডেবোরা স্মিথ। তিনি মূল উপন্যাসের মিতবাক স্বর বজায় রেখেছেন ইংরেজিতেও।

আসলে তিনটি উপন্যাসিকার সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ উপন্যাসটি। ইংরেজি অনুবাদের আগে কোরিয়ায় তিনটি উপন্যাসিকারূপেই প্রকাশ করা হয়েছিল। এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম ইয়ং-হে। উপন্যাসটির তিনটি অংশের সমন্বিত রূপের সবটুকুরই কেন্দ্রে আছে ইয়ং-হে। তবে তিনজন আলাদা চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে কাহিনি। ইয়ং-হের স্বামী মি. চিয়ং, ইয়ং-হের বোন ইন হে এবং বোনের স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করা হয়েছে তিনটি অংশে। প্রথম অংশের বয়ানকারী মি. চিয়ংয়ের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় সংবেদনশীলতার অভাব; সে করপোরেট জগতের একজন অতি সাধারণ প্রতিনিধি। ইয়ং-হে কোনো দিক থেকেই লক্ষণীয় স্বভাবের ছিল না বলেই তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে সে। জোর গলায় কিছু বলবে না এমন একজন স্ত্রীই তার দরকার ছিল। উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কার অর্জনের প্রক্রিয়ায় এ উপন্যাসটির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল নোবেলজয়ী তুর্কি কথাসাহিত্যিক ওরহান পামুকের ‘আ স্ট্রেঞ্জনেস অব মাই মাইন্ড’, ইতালির এলেনা ফেরান্তের ‘লস্ট চাইল্ড’, অস্ট্রিয়ার রবার্ট সিথালারের ‘আ হোল লাইফ’ এবং অ্যাঙ্গোলার হোসে এডুয়ার্ডো আগুয়ালুসার ‘আ জেনারেল থিওরি অব অবলিভিয়ন।’

তার সম্পর্কে মার্কিন লেখক সমালোচক লিল্যান্ড চিউক এনপিআরের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পাঠকের মনে নাড়া দিয়ে যাওয়ার মতো এবং প্রচলিত ছক ভেঙে ফেলার মতো কাজ দিয়ে আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে সম্মানজনক পরিচিতি তৈরি করেছেন তিনি। তার লেখার মধ্যে অপ্রত্যাশিত বিষয় খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। মাঝে মাঝেই পাঠক চমকের মুখোমুখি হয়ে থাকেন। শৈলীর বলিষ্ঠ ছোঁয়ায় হান হাজির করেন মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রবল প্রবাহ।’ যেমন তার ‘গ্রিক লেসনস’ উপন্যাসে বাকশক্তি হারানো একজন নারী প্রাচীন গ্রিক সাহিত্য পাঠ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যার কাছে পাঠ নেবে তারও অবস্থা ওই নারীর মতোই: ধীরে ধীরে সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে। তবে এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, ভালোবাসার প্রায়শ্চিত্তমূলক শক্তিতে আশাবাদী ও মানবীয় বিশ্বাস নিহিত থাকে।

২০১৬ সালে এনপিআরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হ্যান বলেন, ‘উপন্যাস লেখার সময় আমার প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়। মানুষের সংঘর্ষ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন আমার মনে অনেক দিন থেকেই আছে। সংঘর্ষ এড়ানোর সম্ভাবনা কিংবা অসম্ভাবনা এবং সংঘর্ষ এড়ানোর বিষয় নিয়েই কাজ করার তাড়না অনুভব করি। আমার পাঠকরা যদি আমার প্রশ্নগুলো নিজেদের মনে ও কাজে নিয়ে থাকেন তাহলে আমার ভালো লাগবে।’

নোবেল পুরস্কার এবং বুকার পুরস্কার ছাড়াও এযাবৎ তিনি আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে অন্য শিল্পও তৈরি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে তিনি উপন্যাসিকা ‘বেবি বুদ্ধ’-এর জন্য পঁচিশতম কোরিয়ান নভেল অ্যাওয়ার্ড জয় করেন। ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’-এর জন্য ২০০০ সালে পান ইয়াং আর্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড এবং ২০০৫ সালে ই স্যাং লিট্রারি অ্যাওয়ার্ড। আর ‘ব্রিদ ফাইটিং’-এর জন্য ২০১০ সালে লাভ করেন ডং-নি লিট্রারি অ্যাওআর্ড। তার উপন্যাস ‘ব্রিদ ফাইটিং’, ‘বেবি বুদ্ধ’ এবং ‘দ্য ভেজিটারিয়ান’ চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। রয়েল সোসাইটি অব লিট্রেচার ২০২৩ সালে তাকে ইন্টারন্যাশনাল রাইটারের সম্মান দেয়।

দুলাল আল মনসুর: প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ