লা নিনা এবং এল নিনো যেভাবে পৃথিবীর তাপমাত্রার পরিবর্তন ঘটায়
জলবায়ু সম্পৃক্ত বিভিন্ন দুর্যোগ যেমন- বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় এগুলো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। তবে ইদানীং এসব দুর্যোগ যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বৃষ্টির সময় এতটাই অতিবৃষ্টি হচ্ছে, যা আকস্মিক বন্যায় রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি দুবাইয়ে অতি বৃষ্টির কারণে আকস্মিক বন্যা দেখেছি, ২০২২ সালের জুনে সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা দেখেছি।
আবার তাপদাহের মতো আরেকটি দুর্যোগ নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। আমার শিক্ষাজীবনে কখনো স্কুল-কলেজ অতিরিক্ত গরমের কারণে ছুটি দিতে দেখিনি; কিন্তু এই বছর সেটা দেখেছি। এই অতিরিক্ত গরম আমাদের মনে শঙ্কা ও কৌতূহল তৈরি করেছে। আমাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই মাত্রা অতিরিক্ত তাপমাত্রার পেছনে কারণ কী? দিন দিন কি পৃথিবীর তাপমাত্রা এভাবে বাড়তেই থাকবে?
প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই যে অবস্থার পরিবর্তন, এর মূল কারণ হচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু বিবর্তন ঘটছে, যা মোটা দাগে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে ঘটছে। আমরা প্রতিনিয়ত গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করছি, এই গ্রিন হাউস গ্যাসের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা তাপ ধরে রাখতে পারে। তার মানে সূর্য থেকে দিনেরবেলা যে তাপ শক্তি আসে, তার কিছু অংশ গ্রিন হাউস গ্যাসের কারণে রাতেও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে থেকে যায় এবং এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন তাপ আটকে থাকার ফলে পৃথিবীর সামগ্রিক তাপমাত্রা অর্থাৎ জল এবং স্থলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।
গত এক শতকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখা যায় ১৯৭০ সালের পর, যখন থেকে বড় পরিসরে শিল্পায়ন শুরু হয়। এই সময়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলছে।
যে কোনো একটি সিস্টেমের প্রত্যেকটি উপাদান পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে বা নির্ভর করে। সিস্টেমের কোনো একটি উপাদান পরিবর্তন করলেই সে অনুযায়ী সিস্টেমের অন্যান্য বিষয়গুলোতে পরিবর্তন ঘটে। বৈশ্বিক জলবায়ু একটি সিস্টেম, এখন এই সিস্টেমের সাম্যাবস্থা মানব সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে বিঘ্নিত হয়েছে এবং এর ফলাফল হিসেবে জলবায়ু সম্পৃক্ত বিভিন্ন ঘটনাতেও পরিবর্তন এসেছে।
বিষয়টি কেমন তা সহজ ভাবে বোঝার জন্য একটি পরিবার বিবেচনা করুন। ধরে নিলাম, পরিবারটি আর্থিকভাবে যথেষ্ট সচ্ছল, অর্থাৎ উচ্চবিত্ত পরিবার। এমন ক্ষেত্রে এই পরিবারের সদস্যরা জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর ক্ষেত্রেই প্রিমিয়াম কোয়ালিটির জিনিসপত্র ব্যবহার করবে। হোক সেটা খাদ্য, জামা-কাপড়, প্রসাধনী কিংবা অন্য যে কোনো কিছু। এখন কোনো কারণে যদি এই পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ভেঙে পড়ে, তবে তারা কি আর আগের মতো জীবনযাপন করতে পারবে? উত্তর হচ্ছে- না। তার মানে পরিবারটি তখন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী জীবনযাপনের ধরনের পরিবর্তন আনবে।
ঠিক তেমনি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বৈশ্বিক জলবায়ুতেও সে অনুযায়ী পরিবর্তন আসে এবং এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে তাপদাহ বা অতিরিক্ত গরম।
তাপদাহের বিষয়টি সামনে এলেই এল নিনো এবং লা নিনা নামক দুটি বিষয় সামনে চলে আসে। প্রশান্ত মহাসাগরের পানির তাপমাত্রা ওঠানামার পরিপ্রেক্ষিতেই এই দুটি বিষয় সামনে আসে, যা সম্পূর্ণ পৃথিবীর আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে। সূর্যের আলোর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরের দিকের পানি উত্তপ্ত হয় একই সঙ্গে পৃথিবী তার নিজ অক্ষে ঘূর্ণনের ফলে বিষুবীয় অঞ্চলে করিওলিস ফোর্সের প্রভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বাতাস বিদ্যমান থাকে। তাহলে এই দুটি বিষয়কে একসঙ্গে করে বলা যায়, বিষুবীয় অঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরের স্তরের উত্তপ্ত পানি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ধাবিত হয়। এর ফলে অস্ট্রেলিয়া কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উপকূলীয় অঞ্চলে সাগরের পানি বেশি উত্তপ্ত থাকে, ফলে ওই স্থানের পানি বাষ্প হয়ে ওপরে উঠে যায়, এর ফলে বৃষ্টিপাত হয়।
অন্যদিকে পেরু কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলে সাগরের পানি ঠান্ডা থাকে, ফলে শুরু হয় অনাবৃষ্টি। এখনই এই স্বাভাবিক ঘটনা যদি তীব্রভাবে সংঘটিত হয়, অর্থাৎ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণ গরম পানি পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায়, তখনই একে বলা হয় লা নিনা। লা নিনার উল্টো ঘটনাকে বলা হয় এল নিনো, অর্থাৎ প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরের স্তরের গরম পানি যদি পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাবার বিপরীতে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ধাবিত হয়, তবে তাকে বলা হয় এল নিনো। প্রশ্ন হচ্ছে এই দুটি ঘটনা কীভাবে বৈশ্বিক আবহাওয়াকে প্রভাবিত করে? এল নিনো কিংবা লা নিনার ফলে ওয়াকার সার্কুলেশনে পরিবর্তন ঘটে এবং এর ফলেই আবহাওয়াতেও পরিবর্তন আসে। দেখা যায় যেখানে বৃষ্টিপাত হবার কথা নয়, সেখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে আবার কোনো স্থানে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লা নিনা এবং এল নিনো কেন সংঘটিত হয়? প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরের স্তরে গরম পানি একখান থেকে আরেক স্থানে যাবার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক অর্থাৎ এল নিনোর পর লা নিনা সংগঠিত হতে দেখা যায়, বিষয়টি মূলত পর্যায়বৃত্তভাবে ঘটে; কিন্তু বর্তমানে লা নিনা এবং এল নিনো তীব্র বা চরম হচ্ছে। ১৯৬০ সালের পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে যে লা নিনা এবং এল নিনো সংগঠিত হয়েছে, এর সবই প্রায় তীব্র ছিল। এখন এই দুটি বিষয় তীব্র হবার ফলে আবহাওয়াতেও লক্ষণীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন গত ৩০ বছরে এল নিনোর দুটি চরম পর্যায়ে দেখা গিয়েছে। প্রথমটি ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৮ এবং দ্বিতীয়টি ২০১৫ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত। বিজ্ঞানীদের ধারণা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন অর্থাৎ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এল নিনো কিংবা লা লিনা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
২০২২ সালের তথ্যমতে চীন, আমেরিকা, ইন্ডিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং ব্রাজিল এই ছয়টি দেশ পৃথিবীর মোট গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের ৬১ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে থাকে। তবে মাথাপিছু হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে আছে কাতার। তারা বছরে জনপ্রতি ৬৭ দশমিক ৩৪ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে থাকে এবং মাথাপিছু সবচেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে বুরুন্ডি বছরে জনপ্রতি শূন্য দশমিক ৫৯ টন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বছরের জনপ্রতি ১ দশমিক ৬২ টন। সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোই মূলত বেশি পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ করে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে এবং ২১০০ সাল নাগাদ তা দাঁড়াবে ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
১৮৮০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা মাত্র ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে তাতেই পৃথিবীর জলবায়ুতে দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তার মানে আমরা যদি গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি তবে ভবিষ্যতের জন্য তা হবে ভয়াবহ।
বর্তমানে বাংলাদেশের যে তাপদাহ চলছে তা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সৃষ্ট চরম এল নিনোর ফলে সংগঠিত হলেও স্থানীয় বিভিন্ন কারণে তা যেন আমরা বেশি অনুভব করছি এবং সেই স্থানীয় কারণে মধ্যে প্রধানতম কারণ হচ্ছে বনভূমি উজাড়। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত কি পরিমাণ বনভূমি উজাড় হচ্ছে, গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে তা পরিসংখ্যান দিয়ে বলার প্রয়োজন নেই, আমরা সাধারণ দৃষ্টিতেই সেটা বুঝতে পারি। যে কোনো গাছপালা গ্রিন হাউস গ্যাসের মূল উপাদান কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং এর বিপরীতে অক্সিজেন নির্গত করে। এখন সেই গাছপালার পরিমাণই যদি কমে যায় তবে স্বাভাবিকভাবেই তা গ্রিন হাউস গ্যাস শোষণ করবে না ফলাফল পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তাছাড়া গাছপালা প্রচণ্ড গরমে আপনাকে ছায়া দেবে এর ফলে আপনি গরম কম অনুভব করবেন না, যা বর্তমানের তাপদাহ থেকে বোঝা যায়।
গত বছরসহ এই বছর আমরা প্রচণ্ড গরম অনুভব করলেও কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১৮ মে, ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস; কিন্তু তখনকার মানুষ এই গরম ওইভাবে অনুভব করেনি হয়তো। কারণ বাংলাদেশে তখন প্রচুর গাছপালা ছিল, নদী-নালা ছিল, জলাশয় ছিল, যার ফলে ভ্যাপসা গরমের যে বিষয় তা মানুষ ওইভাবে অনুভব করেনি; কিন্তু বর্তমান সময়ে গরমের ফলে যে ভ্যাপসা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, তা মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলছে। শুধু তাপদাহ কেন? আমরা যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করতে না পারি, তবে আরও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ অসহনীয় দানবীয় রূপে আমাদের সামনে আসবে। এখন কথা হচ্ছে এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?
আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে করণীয় হচ্ছে, গাছপালা লাগানো, সেইসঙ্গে পরিবেশ দূষণের বিষয়ে সচেতন থাকা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে করণীয় হচ্ছে বনভূমি রক্ষা, নদী দখল রোধ করা, জলাশয় দখলমুক্ত করা, পরিবেশ দূষণের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা, সেইসঙ্গে উন্নত দেশগুলোর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বিপরীতে জোরালো প্রতিবাদ জারি রাখা।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের দায় রয়েছে। আমরা যদি তাদের জন্য একটি বাসযোগ্য সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে না পারি, সেটা হবে আমাদের চরম ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অবিচার। আপাতত এই বিশাল মহাবিশ্বের কোটি কোটি গ্রহ উপগ্রহের মধ্যে আমাদের জন্য শুধু একটিই বাসস্থান রয়েছে এবং সেটি হচ্ছে এই পৃথিবী। নিজের ঘরকে যেমন আপনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন, ঠিক একইভাবে আপনার একমাত্র বাসস্থান এই পৃথিবীকেও আপনার নিজের স্বার্থেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা উচিত।
মো. জুম্মান ভূইয়া: কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও শিক্ষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে