অমর একুশে বিশেষ সংখ্যা ২০২৪
পেশাগত দক্ষতায় আমাদের ইংরেজি জানাটা কতটা জরুরি
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭ হাজার ভাষায় কথা বলা হয়। ভাষাগুলোর মধ্যে কিছু মিল থাকলেও প্রত্যেক ভাষার মূল পরস্পর থেকে একেবারে ভিন্ন। ভাষাগুলোর গঠন এবং এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এই ভিন্নতা সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। ভাষাবিদদের মতে, একটি ভাষা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তা বোঝার মধ্য দিয়ে মানবজাতিতে কীভাবে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ, সম্পর্ক ও ভাবের আদান-প্রদানের বিবর্তন হয়েছে, তাও বোঝা যায়। কথা বলার ভঙ্গি, ভাষার বহিঃপ্রকাশ ইত্যাদি গবেষণার মাধ্যমে মানুষের আচরণ ও কোন কোন বিষয় তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে, সেটাও নির্ণয় করা সম্ভব। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যবহৃত ভাষার পর্যালোচনা করে ব্যবহারকারীদের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের বিষয়গুলোও নির্ণয় করা সম্ভব।
প্রাণিজগতে মানুষ সবচেয়ে ভিন্ন যে কারণে তা হলো ভাষা। মানুষ যার মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান করে। প্রাণিজগতের মধ্যে এই এক মানুষের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যার ব্যবহারে মানুষ শুধু ভাবের আদান-প্রদান নয়, রীতিনীতি, সংস্কৃতি, ও সামাজিক চর্চা করতে পারে, আদান-প্রদান করতে পারে। একটি ভাষা শেখার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে ব্যক্তি শব্দগুচ্ছের সমন্বয়ে গঠিত এক জটিল প্রক্রিয়া, গঠন, ও ব্যাকরণরীতি আয়ত্ত করেছে যাতে কার্যকরভাবে ভাবের আদান-প্রদান করতে পারে। অনেকের জন্য একটি ভাষা শেখাটা খুব সহজ ও সহজাত বিষয়। আমরা কথা বলা শিখার আগেই ভাবের আদান করতে শিখে ফেলি। তবে, ভাষার দক্ষতা ভাবের আদান-প্রদান প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও ত্বরান্বিত করে।
ভাষাচর্চা মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। ভাষা শিখার ফলে মস্তিষ্কের নতুন দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তাশক্তির উদ্রেক হয়। স্মৃতিশক্তি জোরালো হয়। একটি নতুন ভাষা শেখা ডিমেনশিয়া ও আলজেইমারসের মতো কঠিন রোগের প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে। ভাষাচর্চা এমন এক মানসিক ব্যয়াম যা মস্তিষ্ককে আরও দক্ষ, কার্যকর, ও বুদ্ধিমান করে। শিক্ষাক্ষেত্রে আরো ভালো করতে ভাষায় দক্ষতা অনেক বড় নিয়ামক। একটি বিদেশি ভাষা শেখার মাধ্যমে ব্যক্তি নতুন তত্ব, চিন্তা, দর্শন ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানা যায়, বোঝা যায়। ভিন্ন সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে জানা যায়, তাদের রীতিনীতি অনুধাবন করা যায়। ভাষা সংস্কৃতি ও সামাজিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়ক। বাড়ন্ত শিশুরা বয়সের ভিন্ন ভিন্ন সন্ধিক্ষণে কথা বলতে শিখে। শিশু কখন কথা বলতে শিখছে সেটা পর্যালোচনা করে বোঝা সম্ভব কতটা তাদের মানসিক বিকাশ হচ্ছে। স্কুলপড়ুয়া ছাত্রদের দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষা ও এর দক্ষতা পর্যালোচনা তাদের মানসিক বিকাশ ও বুদ্ধিবৃত্তির নির্ণায়ক হিসেবেও অত্যন্ত কার্যকর। যারা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুটি ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, যেমন বাংলাদেশি কেউ যদি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বসবাস করা শুরু করে, এবং বাসায় বাংলা ও স্কুলে ও বাইরে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, তাহলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি বেশ বৃদ্ধি পায়। হয়তো এ জন্যই অভিবাসীরা ভিনদেশে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে আরও কার্যকর ও সফল হতে পারে।
তবে, এই দুই ভাষায় কথা বলার কিছু সমস্যাও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দ্বিতীয় ভাষায় দক্ষতা ও উচ্চারণের স্বল্পতা ব্যক্তির জন্য দুশ্চিন্তা ও হীনম্মন্যতার কারণে পরিণত হয়। এই হীনম্মন্যতা আরও প্রকট হয়ে উঠে যখন নিজ মাতৃভাষা সম্বন্ধে ব্যক্তির মনে আগে থেকেই এক ধরনের হীনম্মন্যতা বিরাজ করে। অর্থাৎ, নিজ মাতৃভাষাকে দ্বিতীয় ভাষার তুলনায় গুরুত্বহীন মনে করে। শুধু তাই নয়, নিজ মাতৃভাষায়ও যদি কেউ নিজ দক্ষতা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে, তাহলে সমাজজীবনে ও ব্যক্তি পর্যায়ে দুশ্চিন্তা, ও হীনম্মন্যতা আরো প্রখর রূপ ধারণ করতে পারে। সমাজে সবর্ক্ষণ হেয় ও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ভীতি মনে বিরাজ করে। বাংলাদেশে এ বিষয়টার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। আঞ্চলিক টান হোক, বাংলায় স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব হোক, কিংবা ইংরেজিতে দুর্বলতা, এসবই আমাদের অনেকের জন্য হীনম্মন্যতা, দুশ্চিন্তা, পেশাগত জীবনে আটকে পড়ার উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকে। আমরা অনেকেই এই পরিস্থিতির সঙ্গে অতিপরিচিত এবং প্রতিনিয়ত এর সম্মুখীন।
ইংরেজি ভাষা জানা আমাদের দেশে একটি পেশাগত দক্ষতা হিসেবেই বিবেচ্য। পরিস্থিতি এতটাই প্রকট মনে হয় মাঝেমধ্যে যে অনেকের মধ্যে এই বিষয়টি বদ্ধমূল যে ইংরেজিতে দক্ষতা থাকলে বাকি বিষয়সমূহ গৌণ হয়ে যায়। আমি নিজে গত প্রায় দশ বছরের অধিক সময়ব্যাপী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত, এবং প্রায় ১৭ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ইংরেজিতে দক্ষতা পেশাগত জীবনে প্রয়োজন; কিন্তু পেশাগত প্রতিষ্ঠানে নিজ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এটা কতটা অপরিহার্য সেটার বিচারে আমরা হয়তো কিছুটা ত্রুটি করে বসি। পেশাগত জীবনে আমাদের কতক্ষণ ইংরেজিতে কথা বলতে হয়, কিংবা ইংরেজিতে কাজের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হয়। ই-মেইল এখন আমাদের পেশাগত জীবনের এক অপরিহার্য অংশ, এবং এতে আমাদের স্বভাবতই টেকনিক্যাল কারণে ইংরেজির ব্যবহার করতে হয়। অতএব, লিখিত ইংরেজির দক্ষতার ক্ষেত্রে আমাদের প্রায় সবারই প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও সঠিক ব্যবহারের সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বলে ইংরেজিতে স্বতস্ফূর্তভাবে কথা বলতে না পারা যে দক্ষতার স্বল্পতা কিংবা পেশাদারি সামর্থ্যে অভাব নয়, সেটা আমাদের বুঝতে হবে। একই সঙ্গে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলার চর্চা ও এর দক্ষতা শানিত করা উচিত।
ড. আনু মুহাম্মদের এক লেখায় আমাদের দেশে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার অতিচর্চার সমালোচনা নিয়ে কথা বলেছিলেন। দেশের সকল নীতিপত্র ইংরেজিতে রচিত হয়। আমাদের দেশে গবেষণার কোনো কাজও বাংলায় হয় না। বাংলা ভাষায় দক্ষতা অর্জনের বিষয়টি এখন গৌণ হিসেবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিবেচ্য। ড. সলিমুল্লাহ খানের এক বক্তৃতায় তিনিও সর্বজনীন ইংরেজির ব্যবহারের সমালোচনা করে বলেন বিষয়টি যে সংবিধানের লঙ্ঘন হিসেবেও বিবেচ্য হতে পারে। যখন এই লেখা লিখছি, তখন আমি এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রাথমিক অর্থনীতির কোর্স পরিচালনা করছি। আমার ছাত্রদের মধ্যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে কোনো দক্ষতার অভাব যে নেই সেটা তাদের আত্মবিশ্বাস থেকেই প্রকট (যদিও আমি বিষয়টার তেমন কিছুই জানি না)। নতুন কিছু শিখার এবং নিজ পেশাগত জীবনে সেটার প্রয়োগের স্পৃহারও কোনো অভাব নেই তাদের মধ্যে; কিন্তু ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার অভাব যে তাদের পেশাগত পথযাত্রায় এক বিশাল বাধা, সেটা তাদের মনে এ সময় থেকেই দানা বেঁধে বসে রয়েছে। লিখিত দক্ষতায় তাদের আরও ভালো হওয়ার প্রয়োজন সেটা স্বীকার করি। তবে, কথ্য ইংরেজিতে দক্ষ না হওয়াটা যে তাদের পেশাদারী জীবনে কোনো প্রভাব ফেলা উচিত নয় সেটা তাদের বোঝাতে পারি না। আর পারার কথাও নয়, কারণ তাদের এই ভীতি ও দুশ্চিন্তা যে ভিত্তিহীন নয়। পেশাগত জীবন শুরুর আগেই মানসিকভাবে তারা পিছিয়ে পড়ছে। এমনটা কি আদৌ হওয়া উচিত? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত আমার কাছে নেই।
ফেব্রুয়ারি মাসে, বিশ্বের একমাত্র দেশে, যেখানে ভাষার অধিকার নিয়ে মানুষকে রক্ত ঝরিয়ে নিজ মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ও দাপ্তরিক ভাষার সম্মান প্রদানের লড়াই লড়তে হয়েছে, সেই দেশে ছাত্র সমাজের মনে এমন দুশ্চিন্তা যে কাম্যই নয় কেবল, বরং এক বিশাল হতাশার বিষয়। চীন, থাইল্যান্ড ও আরও অনেক দেশ রয়েছে যেখানে তাদের সাধারণ ইংরেজি দক্ষতা স্বল্পমানের। তা সত্ত্বেও তারা বিশ্ববাজারে দাপটের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে। তারা গর্বের সঙ্গে নিজ মাতৃভাষায় কথা বলে, ইংরেজিকে অতটা গুরুত্ব না দিয়েও তাদের পেশাগত জীবনে উন্নতি করছে। পেশাগত জীবনের পশ্চিমাদের সঙ্গে কাজ করার অনেক সুযোগ হয়েছে আমার। এক বিদেশির কথা সবসময় কানে বাজে। সে বলেছিল, ‘কজন বাংলাদেশি ভাঙাচোরা ইংরেজি বলতে গিয়ে যদি লজ্জায় পড়ে তাহলে আমার বিদেশি হিসেবে আরো বেশি লজ্জা পাওয়া উচিত। কারণ আমি তো এক ফোটাও বাংলা বলতে পারি না; কিন্তু ওই বাংলাদেশি তো আমার ইংরেজি ভাষায় তাও কথা বলার চেষ্টা করছে। আমি বাংলায় যেখানে কিছুই করতে পারছি না সেখানে ইংরেজিতে সে তুলনামূলক অনেক ভালো করছে।’ কথাটার গুরুত্ব ও গভীরতা আমাদের কর্মসংস্থান প্রণেতাদের অনুধাবন করা উচিত। পেশাগত দক্ষতায় আমাদের অনেক দুর্বলতা তখন হয়তো শক্তিতে পরিণত হবে।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে