কেমন ছিল ২০২৪, কেমন হবে ২০২৫ সাল
বর্ষ পরিক্রমায় আমরা একটি নতুন পঞ্জিকা বছরে পদার্পণ করেছি। ঘটনাবহুল ২০২৪ সাল আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেসব বছর সবচেয়ে ঘটনাবহুল তার মধ্যে যে কোনো বিবেচনায়ই ২০২৪ সাল অনন্য হয়ে থাকবে। জনমত উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রচেষ্টা যে দীর্ঘ মেয়াদে কখনোই সফল হয় না ২০২৪ সালের ঘটনাপ্রবাহ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। স্থানীয় ও বিদেশি বিভিন্ন গোষ্ঠীর আনুকূল্যে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত যে সরকার পতনের আন্দোলনের আন্দোলনে পরিণত হবে, তা আগে থেকে কেউ বুঝতে পারেনি। সরকারও বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। তারা হয়তো ভেবেছিল আগের আন্দোলনগুলোর মতো ছাত্র আন্দোলনও তারা হয়তো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করতে পারবেন; কিন্তু সরকার বুঝতে ভুল করেছিল যে, আগের আন্দোলনগুলোর মতো এবারের ছাত্রদের সংগ্রাম কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল দীর্ঘ দিনের পরিকল্পিত একটি আন্দোলন, যা দমন করার ক্ষমতা সরকারের ছিল না।
ছাত্রদের কোটাবিরোধী প্রতিবাদ কোনো সাধারণ আন্দোলনে ছিল না। এর গভীরতা আরও অনেক কিছুর সঙ্গে যুক্ত ছিল। যদি তাই না হতো তাহলে আদালতের রায়ে সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সুবিধা সংস্কার করা হলেও ছাত্ররা তাদের আন্দোলন কেন স্থগিত করল না? ছাত্রদের আন্দোলনের গণমনে পুঁঞ্জিভূত ক্ষোভও যোগ হয়েছিল। যে কারণে সরকারবিরোধী বা সরকার পতনের আন্দোলন গতিশীলতা লাভ করে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৪, ১৮ এবং ২৪ সালে বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা একেবারে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছিল। তারা হয়তো ভেবেছিল সরকার পরিচালনার জন্য জনগণের মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই। পুলিশ এবং প্রশাসন পক্ষে থাকলে যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব; কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। কোনো স্বেচ্ছাতন্ত্রই জনমতকে উপেক্ষা করে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এটাই ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা; কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে শিক্ষা হচ্ছে কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ৫ মাস গত হতে চলেছে। ৫ আগস্টের ছাত্রদের সফল আন্দোলনের মাধ্যমে যে জনপ্রত্যাশা এবং আকাঙ্ক্ষ তৈরি হয়েছিল, তা ইতিমধ্যেই ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে। যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেছেন তাদের মধ্যে মাত্র কয়েক জনের সক্রিয়তা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। অন্য উপদেষ্টারা কি করছেন তা সাধারণ মানুষ জানতে এবং বুঝতে পারছে না। অবস্থা যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে আগামীতে পরিস্থিতি খুব একটা ভালো হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিভিন্ন খাতে সংস্কারের যে অঙ্গিকার করেছিল তার গতি খুবই মন্থর। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত রাজনৈতিক সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করবে; কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে,সংস্কার শেষ হবার পরই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সর্বশেষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করা হবে। এই বক্তব্যের মধ্যে বিভ্রান্তি প্রত্যক্ষ করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন গত ৫৩ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম চালাতে পারেনি। তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক বা দুবছরের মধ্যেই সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করে ফেলবেন তা প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। কারণ সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের প্রয়োজনে আবশ্যিক সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। তাই কোনো একটি সরকার যদি বলে আমরা দুই বা তিন বছরের মধ্যে সংস্কার করে ফেলব তাদের আস্থা রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে ২০২৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলো খুব একটা জোর দাবি জানাচ্ছে না। তারা কিছুটা হলেও সহনীয়তা প্রদর্শন করছে; কিন্তু ২০২৫ সালে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ বৃদ্ধি করবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে। কাজেই ২০২৫ সাল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বছর হতে যাচ্ছে। কোর্টের রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করা হয়েছে। আরও কিছু আইনি প্রক্রিয়া শেষে বলা যাবে আগামী জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অধীনে হবে কি না। মোটামুটি ধারণা করা যায়, আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পর আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখতে যাচ্ছি। আমাদের দেশের রাজনীতির একটি ঘৃন্য প্রক্রিয়া হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো যে আইনের সুযোগ গ্রহণ করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ক্ষমতায় যাবার পর সেই সুযোগটাকেই সবার আগে ধ্বংস সরকার প্রক্রিয়া শুরু করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়েছিল; কিন্তু মেয়াদ শেষে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে এমনভাবে কলুষিত করার চেষ্টা করে যাতে তাদের হীনম্মন্যতাই প্রকাশ পায়। পরে তৎকালীন বিরোধী দলগুলো প্রচণ্ড আন্দোলনের মুখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়।
২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়; কিন্তু ক্ষমতাসীন হবার পর তারা কোর্টকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়। আওয়ামী লীগ যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ না দিতো তাহলে দেশে জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থা কায়েম থাকত এবং আওয়ামী লীগকে হয়তো আজকেই এই নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হতো না। আগামীতে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ফিরে আসে তাকে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে কোনো রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ব্যবহার করতে না পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিই জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হবার একমাত্র গ্যারান্টি নয়। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন তাদের সততা এবং নিষ্ঠার ওপর এই ব্যবস্থার সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করবে। উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে যাতে দলীয় সরকার তাতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। আগামী বছর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা রয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে উন্নত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা। গত সরকার আমলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা দলীয় ক্যাডারের মতো ব্যবহৃত হয়েছে। হেন অপকর্ম নেই যা পুলিশ করেনি। পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। পুলিশ বাহিনীর নৈতিক বল অনেকটাই ভেঙে গেছে। অতীতে বাংলাদেশে যত আন্দোলন হয়েছে এবং সরকার পরিবর্তিত হয়েছে কোনো সময়ই থানা থেকে পুলিশ পালিয়ে যায়নি। এবার তাই হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হবে না। ২০২৫ সালেও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করতে পারে। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সাধিত হবে বলে মনে হয় না।
পঞ্জিকা বছর ২০২৫ এবং চলতি অর্থবছরে দেশের জন্য সবচেয়ে জটিলতা সৃষ্টি করবে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো। প্রথমেই আসা যাক মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সাড়ে ৯ শতাংশের ওপর মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসছে না। মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে সাধারণ নিম্নবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলো আজ বড়ই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যতই সংস্কারের কথা বলুক না কেনো তাতে মানুষের পেট ভরবে না। তারা সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে চায়। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখীর কারণে মানুষ কতটা বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হয়েছে তা গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্ট্রিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) এর সাম্প্রতিক একটি জরিপ থেকে প্রতীয়মান হয়।
প্রতিষ্ঠানটি তাদের জরিপে উল্লেখ করেছে, ২০২২ সালে যে সংখ্যক মানুষ দরিদ্র্সীমার অবস্থান করছিল এখন তার সঙ্গে আরও ৭৮ লাখ মানুষ যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ গত দুবছরে দেশে দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৭৮ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার কিছু মানুষ আছেন যারা দরিদ্রসীমার কিছুটা ওপরে অবস্থান করছে; কিন্তু সামান্য আঘাতেই তারা দরিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে পারেন। দরিদ্রসীমার সঙ্গে আরও ২৫ শতাংশ আয় যোগ করলে যেটা পাওয়া যায়, তার নিচে এবং দরিদ্রসীমার ওপরে বসবাসকারী মানুষগুলোই নতুন করে দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবার ঝুঁকিতে আছে বলে মনে করা হয়। এখনো দরিদ্রসীমার ওপরে আছে কিন্তু যে কোনো সময় সামান্য আঘাতেই দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যেতে পারে এমন আরও প্রায় ১ কোটি মানুষ রয়েছে। অর্থৎ গত দুই বছরে দরিদ্রসীমার নিচে চলে গেছে এবং দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবার ঝুঁকিতে আছে এমন মানুষের সংখ্যা হচ্ছে ১ কোটি ৭৮ লাখ। এর আগে অন্য একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, করোনাকালীন সময়ে ৩ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ কর্মচ্যুৎ হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই দরিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে। যারা দরিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে পরবর্তীতে তাদের অবস্থা কেমন হয়েছে। তারা কি পুনরায় দরিদ্রসীমার ওপরে উঠে আসতে পেরেছেন তা কিন্তু আমরা জানতে পারছি না।
বাংলাদেশ ব্যাংক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করছে তার কোনোটিই সঠিকভাবে কাজ করছে না। আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতি সব সময় অর্থনৈতিক সূত্র দ্বারা পরিচালিত হয় না। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মাধ্যমে বিশ্বের অনেক দেশই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সিন্ডিকেটগুলো রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট। কাজেই যারা সরকারে থাকেন তারা কার্যত এসব সিন্ডিকেটর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। সিন্ডিকেটগুলো অত্যন্ত শক্তিশালি এবং তারা অর্থ দিয়ে সব কিছু ‘ম্যানেজ’ করার সামর্থ্য রাখে। যারা সিন্ডিকেট পরিচালনা করে তারা সরকার এবং বিরোধী দল যাদের নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার সম্ভাবনা থাকে উভয় পক্ষকেই ম্যানেজ করে থাকে। আগামী বছর পুরোটাই আমাদের উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি পরিবহন খাতকে ব্যবসায় বান্ধব করতে হবে। সর্বশেষ জ্বালানি তেলের মূল্য লিটারপ্রতি ৪২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে; কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে কমে গেলেও অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করা হয়নি। জ্বালানি তেল এমনই এক উপকরণ যা সবকিছুর ওপরই প্রভাব ফেলে। ২০২৫ সালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। সরকার চেষ্টা করবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য কিন্তু এ ক্ষেত্রে সফল হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন খাত মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। ২০২৪ সালের অর্ধাংশ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করার অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ওপর তা বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করেছে। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ শতাংশে নিচে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। অবশ্য দেশের যে পরিস্থিতি তাতে এই মুহূর্তে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনাটাই বেশি জরুরি। আগামী বছর দেশের সাধারণ দরিদ্র মানুষের জন্য যেসব সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি আছে সেগুলোর পরিধি এবং মাত্রা আরও বাড়ানো যেতে পারে। এই মূহূর্তে দরিদ্র মানুষের জীবন বাঁচানোটাই বেশি জরুরি।
চলতি অর্থবছরের জন্য ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে জিডিপির ২৭ শতাংশ। এটা কোনোভাবেই অর্জিত হবে না এটা শতভাগ নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে প্রতি শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে জিডিপির অন্তত ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই বিনিয়োগ হতে হবে ব্যক্তি খাতে। চলতি অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২০ শতাংশ হতে পারে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে যে মন্তব্য করা হচ্ছে তা বিনিয়োগ আহরণের জন্য মোটেও সহায়ক নয়। বিশ্বব্যাংকের কয়েক বছর আগেকার সর্বশেষ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। সেই অবস্থা থেকে যে কোনো উত্তরণ ঘটেছে তা বলা যাবে না। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক আর একটি সূচক প্রকাশ করেছে। ‘বিজসেন রেডি’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে মোট ৫০টি দেশকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ সারিতে। জাপানি সংস্থা জেট্রো তাদের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ব্যবসায়-বাণিজ্যে নিয়োজিত জাপানি উদ্যোক্তাদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছে, ৭৫ শতাংশ জাপানি উদ্যোক্তা বাংলাদেশের বিনিয়োগ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। এই অবস্থায় ২০২৫ সালে বিনিয়োগ কার্যক্রম খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ব্যতীত প্রবৃদ্ধি অর্জিত না হলে উচ্চ মাত্রায় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। বিনিয়োগ ব্যতীত নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলে দারিদ্র্য বিমোচন পরিস্থিতি আরও গভীর খাদে পতিত হতে পারে। বিদ্যমান বিনিয়োগ কার্যক্রমও মন্থর হয়ে পড়তে পারে। কারণ যারা বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করে দেশের উৎপাদন কার্যক্রমকে সচল রেখেছিলেন তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। কেউ বা বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এই অবস্থায় তাদের প্রকল্পগুলো বন্ধ অথবা উৎপাদন বিঘ্নিত হতে পারে।
সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে তা দুর্নীতিকেই উসকে দেয়, যা আমরা গত সরকারের আমলে প্রত্যক্ষ করেছি। ইতিমধ্যে যেসব মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০২৫ সালে তার বাস্তবায়নের গতি অনেকটাই মন্থর হয়ে পড়বে। এছাড়া বেশ কিছু প্রকল্প আছে যেগুলো বাতিল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে তা বাতিল করা কোনো যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে না। বরং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন -পরিমার্জন করে প্রকল্পগুলোকে বাস্তবায়ন করাই যৌক্তিক হবে। কারণ প্রকল্পগুলোর পেছনে রাষ্ট্রীয় অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে।
২০২৪ সালে অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়াতে না পারা। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কর আদায় করা না গেলে কোনো ভাবেই অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে আহরিত অর্থ দিয়ে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যাবে না। উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন এমনকি সরকারের ব্যয় নির্বাহের জন্যও বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হবে। ইতিমধ্যেই বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। জাপানের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ৩৪দশমিক ১ শতাংশ। অর্থাৎ দেশটির আদায়কৃত ট্যাক্সের পরিমাণ হচ্ছে জিডিপির ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে ট্যাক্স-জিডিপি হচ্ছে ৩২ শতাংশ, চীনের ২০ দশমিক ১ শতাংশ, ভিয়েতনামে ১৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১২ দশমিক ২ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ, ভুটান এবং পাকিস্তানে যথাক্রমে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ ও ১০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে এটা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও আরও কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে দেশের অর্থনীতি এখন ক্রমশ বিদেশি ঋণ নির্ভর হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে।
বিদেশি ঋণ গ্রহণ করে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে তার বেশির ভাগই অবকাঠামোগত খাতে। অবকাঠামোগত যে অর্থ বিনিয়োগ করা হয় বা উন্নয়ন সাধিত হয় তা সরাসরি উৎপাদনে কাজে ভূমিকা রাখে না। যেমন বলা হয়েছিল পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হলে দেশের প্রবৃদ্ধি দেড় থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। খুবই ভালো কথা; কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি কিভাবে অর্জিত হবে? পদ্মা সেতুর মাধ্যমে যানবাহন চলাচলের জন্য যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে তার মাধ্যমে এই অর্জন সম্ভব? নাকি এ জন্য সেতুর দুই পাড়ের জনপদে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠার প্রয়োজন আছে। অবকাঠামো সরাসরি উৎপাদন কাজে ব্যবহৃত হয় না। বরং উৎপাদেন কার্যক্রম ত্বরান্বিতকরণে অবকাঠামো সহায়তা করে থাকে; কিন্তু সেজন্য তো প্রোডাক্টিভ সেক্টরে উৎপাদন বাড়তে হবে। আমরা কি তা করতে পারছি? বিদেশি ঋণের পরিমাণ যেমন উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে সেই ঋণের কিস্তি শোধ করার জন্য প্রতি বছর বর্ধিত হারে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য ১২৯ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে তা ২৬৮ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও কিস্তি বাবদ ৩২৮ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে এটা বৃদ্ধি পেয়ে ৪০২ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে ৫১৫ কোটি মার্কিন ডলার এবং ২০৩৪-৩৫ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও কিস্তি বাবদ ৪৪৫ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে। অবস্থা এমন দাঁড়াবে যে নতুন করে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পুরোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে আমাদের দেশে কোনো সরকার বেশি পরিমাণে বৈদেশিক ঋণ আনতে পারলে সেই সরকারকে সফল বলে মনে করা হয়। আসলে বিষয়টি উল্টো হওয়া উচিৎ ছিল। যে সরকার তুলনামূলক কম ঋণ গ্রহণ করে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে পারে সেই সরকারই হচ্ছে উত্তম সরকার।
গত সরকার আমলে অর্থনীতির বিভিন্ন ইতিবাচক তথ্য বাড়িয়ে দেখানো এবং নেতিবাচক তথ্য কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চেষ্টা করছে কিভাবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো যায়; কিন্তু এ ক্ষেত্রে খুব একটা সফলতা আসবে বলে মনে হয় না। অর্থনীতির বিভিন্ন খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো সহজ হবে না। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামি দেশে সুস্থ্য ধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপস্থিতি ছাড়া ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায় না; কিন্তু বিগত সরকার আমলে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে লুটেরাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে যে, এই খাতটি আর সহসাই উঠে দাঁড়াতে পারবে না। নানাভাবে ঋণ খেলাপিদের আইনি সুবিধা দিয়ে এই খাতের অবস্থা কতটা বিপন্ন করে ফেলা হয়েছে তার সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে আমাদের আরও ৭/৮ বছর অপেক্ষা করতে হবে। মুষ্টিমেয় আর্থিক দুষ্কৃতকারীদের সুবিধা দেবার জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিদ্যমান আন্তর্জাতিক মানের আইনগুলোকে পরিবর্তনের মাধ্যমে এই খাতকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের বিদ্যমান খেলাপি ঋণের হার কমিয়ে দেখানোর জন্য নানা ধরনের আইনি সুবিধা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এই খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ যা দেখানো হচ্ছে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ তার চেয়ে অন্তত তিনগুন বেশি। উচ্চ মাত্রায় খেলাপি ঋণের উপস্থিতির কারণে ব্যাংকিং খাত তারল্য সঙ্কটে পতিত হয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়ে যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি ব্যাংকিং খাতের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা রীতিমতো ভয়াবহ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) কিছুদিন আগে তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে বড় ধরনের ২৪টি দুর্নীতি এবং লুটপাটের ঘটনায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে সরকার সংশ্লিষ্ট একটি গোষ্ঠী। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ম হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। শ্বেতপত্র কমিটির একজন সদস্য বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি অর্থ বিদেশে লেনদেন হয়েছে। দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী,আমলারা এই অর্থ পাচারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ৫৩২টি বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশিদের বাড়ি রয়েছে ৩ হাজার ৬০০টি। বর্ণিত সময়ে রাজনৈতিক নেতারা ঘুষ গ্রহণ করেছেন ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। আমলারা ঘুষ নিয়েছেন ৯৮ হাজার কোটি টাকা। শেয়ারবাজার থেকে লুট করা হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে লুট করা হয়েছে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা। কোনো কোনো উপদেষ্টার বক্তব্য শ্রবণ করলে মনে হয় এটা যেনো মামার বাড়ির আবদারের মতো। ফেরত চাইলাম আর বিদেশিরা তাদের দেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে দিল। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে হলে উদ্দিষ্ট গন্তব্যের দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। তারপর নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হবে পারে; কিন্তু সেই সময় এবং সুযোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাব না। অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার পর তা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করার চেয়ে জরুরি হচ্ছে কেউ যেনো অর্থ পাচার করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি সেটা করতে পারবেন? রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ কলুষিত করে ফেলা হয়েছে। গত ১৫ বছর প্রতিটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতাদের প্রবল উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গেছে। এখন তারা একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। অনেকেই জিয়া পরিষদে ঢুকে পড়েছেন। এই অনৈতিক চর্চা কেনো এখনো চলতে দেয়া হচ্ছে? যারা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারি। যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবেন তার যৌক্তিক নির্দেশনা মেনে চলাই হচ্ছে রাষ্ট্রীয মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাজ। এরা কোনোভাবেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারেন না। যারা বিগত সরকার আমলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নামে দলীয় রাজনীতি চর্চা করেছেন এবং নতুন পরিস্থিতিতে যারা জিয়া পরিষদের ব্যানারে দলীয় রাজনীতি চর্চা শুরু করেছেন তাদের উভয়কেই চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুৎকরণসহ উপার্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্তকরণ এখন সময়ের দাবি।
বিগত সরকার আমলে নানা ব্যানারে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তাদের বিচারের আওতায় আনার অঙ্গীকার রয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। সেই অঙ্গীকার দ্রুত এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে পালন করতে হবে। তবে সব ক্ষেত্রেই কেমন যেন ঢিলে তাল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সাধারণ মানুষ অবশ্যই সময় দিবে কিন্তু তাদের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে হবে। যারা উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন তাদের অনেকেরই যোগ্যতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই প্রয়োজনে উপদেষ্টাদের পরিবর্তন করা যেতে পারে। আবেগ দিয়ে কোনো কাজ হবে না বাস্তবতাকে নেমে নিতে হবে। কোনো কোনো উপদেষ্টা নানাভাবে ভারত বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছন। এটা কোনো মতেই কাম্য হতে পারে না। ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। তাদের সঙ্গে কোনো বিষয়ে মতান্তর হলে তা আলোচনার মাধ্যমে মেটানো যেতে পারে; কিন্তু এমন কিছু বলা বা করা ঠিক হবে না যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ নষ্ট করে। আমরা অবশ্যই স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করব; কিন্তু তাই বলে কারো সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হবো এটা কাম্য হতে পারে না।
এম এ খালেক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে