Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মানবাধিকার ও পুলিশিং

Md Shakhawat  Hossain

মো সাখাওয়াত হোসেন

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

মানবাধিকার প্রত্যয়টি অত্যন্ত স্পর্শকতার, স্পর্শকাতর এই অর্থে পরিস্থিতি এবং পরিবেশ বিবেচনায় মানবাধিকারের রকমফের পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। মানবাধিকার হচ্ছে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের সমন্বয় যার ভিত্তিতে মানবিক আচরণের একটি মাপকাঠি নির্ধারিত হয় এবং সেসব স্পষ্টতই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং সমান মর্যাদা এবং অধিকার লাভের স্বীকৃতি পেয়ে থাকে। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১ম অনুচ্ছেদে এ বিষয়টি বর্ণিত রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানও সুস্পষ্টভাবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিতে তাগিদ প্রদান করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মানবাধিকার কর্মীরা সোচ্চার ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষ করে ক্রসফায়ার, টর্চার, গুম ইত্যাদিতে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পৃক্ততার খবর পাওয়া যায়। স্বাভাবিকভাবে একজন নাগরিক জন্মগতভাবে মানবাধিকার অধিকার লাভ করে থাকে, পাশাপাশি একজন নাগরিক তার জাতীয়তার স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদেয় অধিকার ভোগ করার অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে।

পুলিশ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান যার মূল এবং অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নাগরিকের সম্পত্তির সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবেশ বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জনজীবনে স্বস্তি ও নিরাপদ আবাসনের নিশ্চয়তা প্রদান করা। সমসাময়িককালে পুলিশ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যেটি শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় প্রদান করে এবং অচলায়তন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতাকে বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়। এ কারণেই বলা হয়, সংঘর্ষ ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে কাজ করে থাকে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, তারা মূলত শক্তিশালীদের করাল থাবা থেকে অসহায়দের সহযোগিতা করে থাকে।

কাজেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষ করে বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যেভাবে মানবাধিকার নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে বেশ কিছু বিষয় কার্যাকর ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রথমত, পুলিশ বাহিনী কর্তৃক আইনকে সঠিকভাবে ব্যবহারের চর্চা করা, আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক দায়িত্ব পালন করা। বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে ধারা, নীতি, আইন, বিধি, বিধান রয়েছে সেগুলোর সঠিক চর্চার মাধ্যমেই মূলত আইনের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন প্রদান করা হয়। পুলিশ বাহিনীর জিম্মায় বন্দিকৃত কয়েদির সঙ্গে মানবিক আচরণের অনুশীলন বজায় রাখতে পারে। কোনোভাবেই একজন কয়েদিকে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। মানবাধিকার সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ০৫ এ উল্লেখ রয়েছে; গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে শারীরিক, মানসিক ও অমানবিক আচরণ করা যাবে না। কাজেই আইনের অনুশাসনে বিধি; প্রো-বিধি অনুসরণের মধ্য দিয়ে পুলিশ বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার নিশ্চিত করা যায়। একই ঘোষণাপত্রের ধারা ০৯ এ বলা হয়েছে; খেয়াল খুশিমতো কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ১১ (খ) এ উল্লেখ রয়েছে; ত্রুটির কারণে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, যদি না সেটি দণ্ডযুক্ত অপরাধ না হয়। এ ব্যাপারটিতে নজর দেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে; দণ্ডবিধির বই এ যত সব কর্মকাণ্ডের উল্লেখ রয়েছে প্রত্যেকটি কর্মই অপরাধ এবং সে সংক্রান্তে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। এর বাইরে কাউকে গ্রেপ্তার করার কোনোরূপ সুযোগ নেই।

দ্বিতীয়ত, মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য পুলিশ অফিসারদের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে, দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। মূলত পুলিশ সদস্যদের প্রোঅ্যাকটিভ ভূমিকাই পারে সাধারণ মানুষদের অধিকার সংরক্ষণে কার্যাকর ভূমিকা রাখতে। সে জায়গা থেকে মনে হয়; মানবাধিকার সর্বাগ্রে বাস্তবায়নের জন্য পুলিশ সদস্যদের ভূমিকাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থানের মাধ্যমেই মূলত একটি জাতি তথা রাষ্ট্রের মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে পুলিশ সদস্যদের দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে পুলিশের কার্যাক্রমকে মানবিক পুলিশিং হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি, পুলিশ সর্বসময়ে মানবিকতার মহান ব্রত নিয়ে তাদের দায়িত্ব অব্যাহতভাবে পালন করে যাবে। কেবলমাত্র সংকটকালেই মানবিকতার চর্চার বিপরীতে সকল সময়ে মানবিকতাকে লালন করতে হবে।

তৃতীয়ত, তদন্ত কাজের মাধ্যমে পুলিশ অফিসাররা মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিতে কাজ করতে পারে। তদন্তের প্রথম এবং অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি অভিযুক্ত বিষয়ের তথ্যানুসন্ধান করা। একটি জটিল বিষয়ের সঠিক সমাধান বের করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করা। শুধু তাই নয়, তদন্তে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ সদস্যের গাফিলতির ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশিত হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিকে অতিক্রম করে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর এর নীতিমালা অনুসরণ করে অভিযুক্ত ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে প্রকৃত দোষীদের উন্মোচন করে ক্ষতিগ্রস্তের অধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে কাজ করতে হবে। তদন্তের এ ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করতে পারলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে অসংখ্য মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে।

চতুর্থত, একজন পুলিশ সদস্যের নিজের, নিজের পরিবারের, নিজের সমাজের এবং রাষ্ট্রের নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিতে আইনি কাঠামোর মধ্যে ন্যস্ত করা হয়। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় সংকটে পুলিশের সদস্যরা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। বিশেষ করে দেখা যায়, একটা সময়ে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কেবলমাত্র অপরাধ প্রতিকারে কাজ করে যেত বর্তমানে পুলিশের দায়িত্বশীল সদস্যরা অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাৎপর্যময় ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে ইতিবাচক নজির সৃষ্টি করেছে। বলা হয়ে থাকে, অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গৃহীত নীতিমালা সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিতে অনেকখানি গুরুত্বপূণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এ সকল বিষয়ের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তথা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা মানুষের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং ফলশ্রুতিতে উপকৃত হচ্ছে সাধারণ জনগণ।

সাধারণ মানুষ মনে করে, পুলিশের দায়িত্বশীল ভূমিকাই পারে মৌলিক মানবাধিকার পরিপূর্ণরূপে নিশ্চিত করতে। বিশেষ করে একটি অভিযোগ থানায় রিপোর্ট হওয়ার পরই মূলত পুলিশ সদস্যরা অ্যাকশন গ্রহণ করে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক সময় মানবাধিকার নিশ্চিত করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু যদি অভিযোগ দায়েরের পূর্বে একজনের অধিকার খর্ব হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের সদস্যরা তাদের দায়িত্বশীলতার মধ্য থেকে উদ্যোগ গ্রহণে ব্রতী হয় তাহলে পুলিশিং এর মাধ্যমে সাধারণ জনগণের মানবাধিকার নিশ্চিত হবে।

বিশ্বব্যাপী মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বিভিন্ন আইনের ওপর নির্ভর করে থাকে। বিশেষ করে কোনো রাষ্ট্র যদি তার নাগরিকের অধিকারকে কোনোভাবে খর্ব করার মতো কর্মকাণ্ড সম্পাদন করে থাকে সে জায়গাতে পুলিশের সদস্যরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একজন নাগরিকের অধিকার নিশ্চিতে কাজ করতে পারে। অন্যদিকে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল ল, যুদ্ধ আইন প্রভূত আইনসমূহকে প্রতিপালন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিশ্বব্যাপী মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাচ্ছে।

আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের সব নাগরিক সমান এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে এ বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। তথাপি বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিযোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে অপারগতা প্রকাশ করে থাকে। এটি পরিপূর্ণভাবে একজন মানুষের মানবাধিকারের লঙ্ঘন। বাংলাদেশের সংবিধানে একজন নাগরিকের অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, সংগঠন করার অধিকারের কথা তুলে ধরা হয়েছে, সমাবেশ আয়োজনের কথা বর্ণিত হয়েছে। এ ব্যাপারগুলোয় রাষ্ট্রের নাগরিকের অধিকারকে কোনোভাবেই বঞ্চিত করা যাবে না। দেশি ও আন্তর্জাতিক আইনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পুলিশের সদস্যগণ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ