মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে অনেক দিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল; কিন্তু অধিকাংশ দেশই তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি সাধন করতে পারেনি। অনেক দিন ধরেই মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের কাছাকাছি ওঠানামা করছে। কোনো কোনো সময় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও তা খুব একটা উল্লেখযোগ্য নয়। আমাদের এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির হিসাবটি সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা অনুমান করা যাচ্ছে না। যে সরকারি সংস্থা দেশের সব তথ্য উপাত্তের প্রধান উৎস, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পরিসংখ্যান যদি সঠিক না হয় তাহলে দেশের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না আর সেই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে তা কখনোই সঠিক হতে পারে না; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-পরিসংখ্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে এত বেশি প্রভাব এবং নির্দেশ দেয়া হয় যে সংস্থাটির পক্ষে তা উপেক্ষা করে সঠিকভাবে কাজ করা হয়ে উঠে না। বিভিন্ন নমুনা থেকে বোঝা যায় যে, বোঝাপড়াটা হচ্ছে এমন যে, পরিসংখ্যান প্রণয়নের সময় সরকারর উন্নয়নকে ফলাও করে দেখাতে হবে, সরকারের ব্যর্থতাগুলোকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে।
যেমন বাজারে আমরা যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রত্যক্ষ করি, সরকারি কাগজপত্রে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায় না। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশ বলে দেখানো হচ্ছে। মাঝখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত দেখানো হয়েছিল; কিন্তু বাজারে আমরা দেখছি খাদ্য পণ্যের মূল্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে পঞ্চাশ শতাংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। সার্বিকভাবে গড় মূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশের কম হবার কথা নয়; কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানে সর্বশেষ গড় মূল্যস্ফীতি দেখানো হয়েছে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। সাধারণ মানুষ সরকারের দেয়া মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান বিশ্বাস করছে না।
অর্থনীতিতে কিছু নিয়ম কাজ করে। অর্থশাস্ত্র বলে, মূল্যস্ফীতির দুটি কারণ। একটি হচ্ছে কস্টপুশ অর্থাৎ ব্যয় বৃদ্ধি থেকে মূল্যস্ফীতি হতে পারে। আরেকটিকে বলে ডিমান্ড পুল–মানে কোনো কারণে যদি হঠাৎ করেই একটি পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, তাহলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে। ব্যয় নানা কারণেই বৃদ্ধি পেতে পারে। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেতে পারে। আবার স্থানীয়ভাবে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি দিতে পারে। এ ছাড়া কিছু উৎস তো আমরা দেখছিই- গ্যাসে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, আমদানিকৃত জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে অধিকাংশ পণ্যের উৎপাদন ব্যয় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেড়েছে। পণ্য উৎপাদনের এই বর্ধিত ব্যয় শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই বহন করতে হচ্ছে। কোনো কারণে অর্থনীতিতে যদি অর্থপ্রবাহ বাড়ে, যদি হঠাৎ করে আয় বেড়ে যায়, তাহলে বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটতে পারে। আমরা দেখি সমাজে কিছু মানুষের আয় তো অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সম্পদের যে হলফনামা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা গেলো অনেকেরই সম্পদের পরিমাণ কয়েক শত থেকে শুরু করে হাজার গুণ বেড়েছে। এটা তাদের প্রদর্শিত ‘বৈধ’ আয়। এ ছাড়া এদের অপ্রদর্শিত অবৈধ আয় আছে। পুরো সম্পত্তির হিসাব যদি নেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে সমাজের শীর্ষ পর্যায়ের ৫ শতাংশ মানুষের আয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই আয় কীভাবে এতটা বৃদ্ধি পেলো সে ব্যাপারে তারা কোনো সন্তুষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারবে না। সমাজের বিত্তবান ৫ শতাংশ মানুষ বৈধ-অবৈধ পথে যে অর্থ সম্পদ উপার্জন করে তা তারা দেশে রাখে না। দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়; কিন্তু তার ক্ষতিকর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে থেকে যায়। সমাজে মহাবিত্তবান গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা মেরে দিয়েছে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে তারা অর্থবিত্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য যে প্রাথমিক ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় বাস্তবে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। এই বর্ধিত ব্যয়ের চাপটা তো সাধারণ মানুষের ওপরই পড়ছে। সমাজের শীর্ষ পর্যায়ের ৫ শতাংশ মানুষ যে প্রক্রিয়ায় অর্থবিত্ত অর্জন করছে তার কারণে অনেক জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে।
স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে কিছু একচেটিয় গোষ্ঠীর ভূমিকা আছে। এদের অর্থনীতির পরিভাষায় ‘ওলিগোপলি’ বলা হয়। বাজার যদি এ ধরনের গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে সে বাজারে পণ্যমূল্য স্বাভাবিকভাবে অর্থাৎ চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতে পারে না। এই গোষ্ঠী তাদের ইচ্ছামতো পণ্যমূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করতে পারে। বাংলাদেশের মার্কেটাই হচ্ছে ‘ওলিগোপলি’ মার্কেট। তাই এখানে অর্থনীতির সাধারণ সূত্র কার্যকর হতে পারছে না। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক প্রণীত মুদ্রানীতি সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। বাজার অর্থনীতি সঠিকভাবে কাজ করতে হলে সর্বোচ্চ মাত্রায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সব তথ্য সুলভ ইত্যাদি নিশ্চিত থাকতে হবে। একটি অর্থনীতিতে যদি মনোপলি বা ‘ওলিগোপলি’ কার্যকর থাকে তাহলে সেখানে অর্থনীতির নানা কলকবজা সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না, আবার ক্ষমতার ওপর থেকে যদি নির্দেশনা দিয়ে কিছু সুবিধাভোগীর স্বার্থ রক্ষা করা হয়, তাহলেও অর্থনীতির সাধারণ সূত্র কাজ করতে পারবে না।
এরকম পরিস্থিতিতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে-কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্য ৭৭টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। এ ছাড়া আরো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এতে দেশগুলোর উচ্চ মূল্যস্ফীতির সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকবার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ, এখন তা ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে; কিন্তু এরপরও ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি কমানো যায়নি। এর কারণ হচ্ছে পলিসি রেট বাড়ানো হলেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার কিছুদিন আগ পর্যন্ত ৯ শতাংশে সীমিত করে রাখা হয়েছিল। ফলে পলিসি রেট বাড়ানোর প্রক্রিয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণ তুলনামূলকভাবে সস্তা হয়ে পড়ে। অনেকেই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছেন। এমনকি বিদেশে পাচার করেছেন বলেও অনেকে অভিযোগ করছেন। পুরো মুদ্রা ব্যবস্থা যদি স্বাধীন এবং সংগঠিতভাবে কাজ করতো তাহলে হয়তো মূল্যস্ফীতি এতটা বৃদ্ধি পেতো না। আমাদের মতো দেশ, যেখানে কিছু গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রয়েছে সেখানে শুধু মুদ্রানীতি নিয়ে কখনোই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কিছু গোষ্ঠী যেখানে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তা শোধ না করার জন্য এবং তারা এর জন্য ক্ষমতার সহযোগিতা পায়, সেখানে সুদের হার কাজ করবে কীভাবে?
দেশের ব্যাংকিং খাত মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এই খাত থেকে একটি প্রভাবশালী মহল হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছে। পণ্য আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। হয়তো ১০০ টাকার পণ্য আমদানি করছেন কিন্তু আমদানি ব্যয় দেখানো হচ্ছে ২০০ টাকা। আবার ১০০ টাকার পণ্য রপ্তানি করে রপ্তানি আয় দেখানো হচ্ছে ৫০ টাকা। এভাবে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। অর্থ পাচারের একটি সহজ পদ্ধতি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) কযেক বছর আগে তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বাংলাদেশ থেকে শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও আড়ালেই প্রতি বছর ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে থাকে। যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করেন তাদের জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি কোনো বিষয় নয়; কিন্তু যারা সাধারণ দরিদ্র এবং নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতি তাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ এবং দুর্ভোগ ডেকে আনে। সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কতটা কস্টে আছে টিসিবির ট্রাক সেলের লাইন দেখলেই তা অনুধাবন করা যায়। এক শ্রেণির মানুষ বিদেশে অর্থ পাচার করার কারণে দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দুর্ভোগ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ তারা চাইলেই তাদের আয় বাড়াতে পারছে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় দিন দিনই কমে যাচ্ছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির আরও একটি বড় কারণ হচ্ছে আমদানি নির্ভরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়া। দেশ ক্রমেই অধিক মাত্রায় আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে। যেমন গ্যাস এবং বিদ্যুৎ খাতে আমদানি নির্ভরতা এবং ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের স্বল্প মূল্যে গ্যাস প্রাপ্তির সুযোগ ছিল। কম দামে বিদ্যুৎ পাবার সুযোগ ছিল; কিন্তু সেই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে গোষ্ঠী বিশেষকে ব্যবসায় দেবার জন্য এলএনজি আমদানির সুযোগ দেয়া হচ্ছে। বিশেষ করে এলএনজিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় এই খাতে ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলন করা হলে যে পরিমাণ গ্যাস ২ টাকায় পাওয়া সম্ভব ছিল সেই পরিমাণ গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে ২০০ টাকা। উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ফলে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে বাজারে এসব পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেলে সরকার স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে। তখন বলা হয়েছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস পেলে স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অনেকটাই কমেছে; কিন্তু স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়নি। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আর পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। যেসব উৎসে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পেলো সেই ব্যয় বৃদ্ধিটা অনিবার্য ছিল না। মহল বিশেষকে ব্যবসায়িক সুবিধা দেবার জন্য সরকার পুরো দেশের অর্থনীতিকেই নাজুক অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
পণ্য মূল্য বৃদ্ধি বা উচ্চ মূল্যস্ফীতির পেছনে আরও একটি কারণ রয়েছে, যা সরকার ইচ্ছে করলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো কিন্তু এ ব্যাপারে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সেটা হচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক চাঁদাবাজি। যে পণ্য কৃষক পর্যায় থেকে ১০ টাকা দিয়ে ক্রয় করে আনা হয় সেই পণ্যই রাজধানীতে আসার পর মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ১০০ টাকায়। পরিবহন খরচ মেটানোর পরও পণ্যটির মূল্য ৩০ টাকার বেশি হবার কথা নয়; কিন্তু সেই পণ্য আমরা অর্থাৎ রাজধানীর ভোক্তারা খাচ্ছি ১০০ টাকায়। উৎপাদক যে কৃষক তারা পণ্যের সঠিক মূল্য পান না। আবার ভোক্তারাও তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্যটি পান না। মাঝখানে তৎপর মধ্যস্বস্তভোগীরা মুনাফা লুটে নিচ্ছে। কোনো পণ্য পরিবহনকালে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়। যেহেতু বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার কোনো জবাবদিহি নেই। তাই চাঁদাবাজরা নির্বিঘ্নে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক শ্রেণির সদস্যসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন চাঁদাবাজি করে চলেছে। মূলত ব্যাপক চাঁদাবাজির কারণেই পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাঁদাবাজি এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে কোনোভাবেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দায়ভার কার? উচ্চ মূল্যস্ফীতির দায়ভার নিশ্চিতভাবেই সরকারের নীতি কাঠামোর। সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূল কারণ নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ না নিয়ে নানাভাবে এই সমস্যা সমাধানের কথা বলছে, যা কোনোভাবেই কাজ করবে না। সরকার যদি পরিবহন খাতের ব্যাপক চাঁদাবাজি বন্ধ করতে না পারে, অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, ব্যাংক লুট বন্ধ না করে, যদি অতিব্যয়ের প্রকল্প চলতে থাকে এবং সর্বোপরি অর্থনীতিতে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে বইপুস্তকের কোনো ব্যবস্থা দিয়েই অর্থনীতিতে বিদ্যমান অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বাধীন এবং সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। সব প্রতিষ্ঠানই উপরের আদেশক্রমে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কাজ করছে না। এই অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে