কুমিল্লায় শত কোটি টাকার সরকারি জমি দখলে অভিনব কূটকৌশল!
সিনেমা হল ও হোটেল নির্মাণের শর্তে দশমিক ৬১৬৩ একর সরকারি জমি লিজ নিয়ে সেখানে দশতলা বাণিজ্যিক ভবন গড়ার অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেনের স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচজন ওয়ারিশের বিরুদ্ধে। এমনকি লিজের বাইরেও দশমিক ১১৫৬ একর অতিরিক্ত জমি অবৈধ দখল নিয়ে পুরোটাই ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেছেন বর্তমান মালিক প্রায় সাত বছর আগে প্রয়াত দেলোয়ার হোসেনের ছেলে দেলোয়ার জাহিদ- এমন অভিযোগ নগরবাসীর।
নগরীর কেন্দ্রস্থল কান্দিরপাড়ের পুলিশ লাইন্স সড়কের ডান পাশে রূপায়ণ দেলোয়ার টাওয়ার নামে ভবনটির নির্মাণকাজ সম্প্রতি শেষ করেছেন দেলোয়ার থিয়েটার এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার দেলোয়ার জাহিদ। এখন ভবনটির দোকানগুলো সাজাচ্ছেন কিনে নেয়া ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি দেলোয়ার জাহিদের বিরুদ্ধে পাওয়া গেছে অবৈধভাবে দখলে রাখা লিজের অতিরিক্ত জমি বিক্রির চেষ্টারও।
সরেজমিন গেলে সবমিলিয়ে নানা কূটকৌশলে শত কোটি টাকার সম্পত্তি হাতানোর প্রক্রিয়া এখন শেষপর্যায়ে থাকলেও প্রশাসনের নীরব ভূমিকার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, কান্দিরপাড়ের ২৪২নং ছোটরা মৌজার ২৬৯ এসএ খতিয়ানভুক্ত ১২৯৮, ১২৯৯, ১২৯৬, ১৩০০ দাগের দশমিক ৬১৬৩ একর সরকারি ভূমি সিনেমা হল ও হোটেল নির্মাণের শর্তে ১৯৬৩ সালে বন্দোবস্ত পান ‘মেসার্স দেলোয়ার থিয়েটার এন্ড এন্টারপ্রাইজ’-এর স্বত্বাধিকারী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন। ১৯৬৫ সালে ওই সম্পত্তি রিকুইজিশন করে রেজিস্ট্রিকৃত দলিল সম্পাদন করে দেয় তৎকালীন সরকার।
শর্তানুসারে ১৯৬৭ সালে সেখানে ‘দীপিকা সিনেমা হল’ চালু করেন দেলোয়ার হোসেন। ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয় ভবনের তৃতীয় তলায় চালু করা হয় আরও একটি সিনেমা হল ‘দীপালি’ নামের আরও একটি সিনেমা হল। ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় উত্তরা ব্যাংকের শাখা, নিচতলায় হোটেল ডায়না, সিনেমা হলের সামনে ও পাশে ফুজি কালার ল্যাব, ঘড়ি, স্টুডিওসহ ২৮টি দোকানও ছিল। যার ভাড়াও নিতেন বন্দোবস্ত গ্রহীতা; কিন্তু ২০১২ সালে শত কোটি টাকার ওই সম্পত্তিতে সরকারের অনুমতি না নিয়েই বহুতল বাণিজ্যিক, আবাসিক ও সিনেমা হল তৈরি করতে ঢাকার একটি হাউজিং কোম্পানির (ডেভেলপার) সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় বন্দোবস্ত গ্রহীতা।
২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বন্দোবস্তের ওই স্থানে বহুতল বাণিজ্যিক, আবাসিক ও নতুন সিনেমা হল নির্মাণের অনুমতি চেয়ে মেসার্স দেলোয়ার থিয়েটার এন্ড এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার অহিদুর রহমান কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন জানান। এ বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়ে একই বছরের ২৯ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আদর্শ সদর উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আসাদুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, ‘ওই ভূমি সরকার থেকে শুধুমাত্র সিনেমা হল ও হোটেল নির্মাণে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। তাই বন্দোবস্ত শর্ত মোতাবেক সেখানে বাণিজ্যিক কিংবা আবাসিক ভবন তৈরির কোনো সুযোগ নেই।’
তারপরও বন্দোবস্ত গ্রহীতার পক্ষে মধ্যস্বত্বভোগী ওই হাউজিং কোম্পানি দীপিকা সিনেমা হল ভাঙা শুরু করে। খবর পেয়ে ২০১৩ সালের ৮ জানুয়ারি তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রেজাউল আহসানের নির্দেশে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে ভবন ভাঙা শুরু করে দেয়। একইদিন জেলা প্রশাসনের ২৫ নম্বর স্মারকে দেলোয়ার থিয়েটারের প্রোপাইটারকে কাজ বন্ধ রাখার আদেশে চিঠি দেয়া হয়। পরে ওই আদেশের বিরুদ্ধে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বিবাদী করে এর বিরুদ্ধে রিট করে রূপায়ণ হাউজিং এস্টেট। ভূমি মন্ত্রণালয়ের ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই এলএ মামলা হস্তান্তর করে দলিলে উল্লিখিত শর্তের বাইরে আবাসনসহ অন্য কোনো অবকাঠামো নির্মাণ না করার নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।
এরপর মূল মালিক দেলোয়ার হোসেন মারা গেলে দেলোয়ার থিয়েটারের মালিকানা পান তার স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচজন। ২০২১ সালের ১৪ জুন করা যুগ্ম জেলা জজ ১ নম্বর আমলি আদালতের ৯৬/২১ নম্বর মামলায় ওই পাঁচ ওয়ারিশকে বিবাদী করেন জেলা প্রশাসক।
মামলাটিতে অভিযোগ করা হয়েছে, লিজের শর্ত ভঙ্গ করে দেলোয়ার থিয়েটার এন্টারপ্রাইজ সরকারি জায়গা দখল এবং ডেভেলপার কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভূমি অফিস ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অন্তত পাঁচজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি জায়গা লিজ নিয়ে দখল বিক্রি বা হস্তান্তর এমনকি বহুতল ভবন নির্মাণের বিধান নেই। তারা শুধু ভবনই করেননি। একাধারে হাউজিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছেন এবং সর্বশেষ চুক্তির মূল শর্ত সিনেমা হলই করেননি। শুধু একটি নাম দিয়ে কোনোমতে নথি দেখাতে সিনেমা হলের রূপ দিয়েছেন। আর অবৈধভাবে লিজের জমিতে করা দোকান দেশের বিভিন্ন নামি-দামি পোশাক, জুতার ব্র্যান্ড ও ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেন। এটিও লিজের শর্ত লঙ্ঘন।
কুমিল্লার অন্তত দশজন আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে মোট শূন্য দশমিক ৬১৬৩ একর মেসার্স দেলোয়ার হোসেন থিয়েটারের নামে বিএস রেকর্ডভুক্ত করা হয়; কিন্তু তারা জালিয়াতির মাধ্যমে দশমিক ১১৫৬ একর অতিরিক্ত ভূমি বিএস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন যা লিজে পাওয়া সম্পত্তির অংশ নয়।
সূত্রে জানা গেছে, এই অতিরিক্ত সরকারি জমি বিক্রির পথ খুঁজছেন দেলোয়ারের ওয়ারিশ দেলোয়ার জাহিদ। এরই মধ্যে একটি পক্ষের কাছ থেকে ওই সরকারি জমি বিক্রির শর্তে প্রায় এক কোটি টাকা বায়নাও নিয়েছেন তিনি।
নগরবাসীর অভিযোগ, সরকারি জমি দখলে রূপায়ণ হাউজিং ও লিজ গ্রহীতা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার নানা কূটকৌশল অবলম্বন করেন। জীবোদ্দশায় তিনি কোটি কোটি টাকায় হাত করেন কুমিল্লা-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার, তার মেয়ে কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিন্টুসহ এক ডজন নেতাকর্মীকে। দশতলার রুপায়ণ দেলোয়ার টাওয়ারটি অবৈধভাবে নির্মাণে সহায়তার বিনিময়ে বিপুল আর্থিক সুবিধা পান এমপি বাহার। আর বিনামূল্যে দোকান বরাদ্দ পান তার মেয়ে তাহসিন বাহার সূচনা ও গানম্যান মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-দপ্তর সম্পাদক দুলাল মাহমুদ এবং মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম রিন্টু, আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুব রাজিব। পঞ্চম তলার ৫২৬, ৫২৭, ৫২৮, ৫২৯, ৫৩০ নম্বরের এসব দোকানের বাজারমূল্য দশ কোটি টাকা।
কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান প্রশাসনিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা প্রশাসনের পক্ষে বার বার বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম; কিন্তু ক্ষমতার কাছে আমরাও অসহায় ছিলাম। একবার এক নারী কর্মকর্তা এ ভবন নিয়ে ব্যবস্থা নিতে আসেন। এমপি বাহার ও তার নেতাকর্মীরা ওই কর্মকর্তাকে হেনস্তা করে ছাড়েন। পরে তাকে বদলি করে দেয়া হয়। এমন বহু ঘটনা আছে যা প্রশাসনের লোকরাই শুধু জানতেন।’
বর্তমান জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ‘সরকারি জায়গা দখলের অধিকার কারো নেই। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখব। সরকারি জমি দখল বা লিজের শর্ত ভঙ্গের প্রমাণ পাওয়া গেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নুরুল্লাহ বলেন, ‘আমি ওই ভবনের অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছিলাম। তখন সাবেক এমপি বাহার সাহেব আমাকে সার্কিট হাউসে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ওই ভবনের প্ল্যান অনুমোদনের নির্দেশ দেন; কিন্তু আমি অনুমোদন দেইনি এবং তাতে কোনো স্বাক্ষরও করিনি। পরে তিনি প্রভাব খাটিয়ে ওই প্ল্যান অনুমোদন করিয়ে নেন। যদিও নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে আমার স্বাক্ষর থাকার কথা ছিল।’
এ বিষয়ে রূপায়ণ দেলোয়ার টাওয়ারের বর্তমান মালিক দেলোয়ার জাহিদকে মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি রিসিভ করেন। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে রং নম্বর বলে কল কেটে দেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে