সলিমুল্লাহ খান
‘আমাদের বুদ্ধিজীবীদের প্রধান সমস্যা, দেশের ইতিহাস সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা নিয়ে অগ্রসর হওয়া’
এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন আর জনযুদ্ধে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। এক, দুই, তিন করে এরই মধ্যেই দেশটি পার করেছে স্বাধীনতার ৫২ বছর। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী; কিন্তু এই ৫২ বছরে একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কতদূর এগুলো। শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, বুদ্ধিজীবীতা সব কিছুতে কত পথ পাড়ি দিল বাংলাদেশ। এসব বিষয় নিয়ে দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাহাত মিনহাজ বিস্তারিত কথোপকথন করেছেন। সেই কথোপকথনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো।
রাহাত মিনহাজ: গত ৫২ বছরের বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, বুদ্ধিবৃত্তিক অর্জন বা বুদ্ধিজীবীতা কত দূর এগিয়েছে, আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
সলিমুল্লাহ খান: এই দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি বা অবনতি বিচারের আগে আমাদের দুটি কথা প্রসার করা দরকার। বাংলাদেশের ইতিহাস মাত্র ৫২ বছরের নয়। অর্থাৎ এই ৫২ বছর হচ্ছে রাষ্ট্রের ইতিহাস। বর্তমানে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে, দেশের ইতিহাস সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা নিয়ে অগ্রসর হওয়া। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ৫২ বছরের এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু বাংলাদেশ, জাতি অথবা দেশ হিসেবে আরও বহু পুরোনো। এই গত ৫২ বছরে আমাদের কতটুকু উন্নতি হয়েছে, তার একটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। এই দেশ এক সময় ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। তার আগে মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। আমি এত লম্বা ইতিহাসে না গিয়ে বলি, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এই দেশ ত্যাগ করার মুহূর্তে ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হয়েছিল। তার আগেই এখানে ইতিহাসের কিছু সম্বল আমরা আবিষ্কার করেছিলাম। যেমন-ধরুন, ঢাকার দক্ষিণে বিক্রমপুরে নলিনীকান্ত ভট্টশালী বলে এক ভদ্রলোক ছিলেন। যিনি ঢাকা জাদুঘর তৈরি করেছিলেন। যেটাকে আজকে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বলি। তিনি অন্তত ৩০টি বড় বড় স্তূপ আবিষ্কার করেছিলেন। এটা ১৯২০-১৯৩০ এর দশকের কথা। যখন পশ্চিমে হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো আবিষ্কৃত হয়েছে; কিন্তু এরপরে আর খুব বেশি কাজ হয়নি। এই বিক্রমপুর তো হাজার বছর আগেও বাংলার এক অংশের রাজধানী ছিল। একটু উদাহরণ দিয়ে বলছি। তারপরে আমরা দেখেছি বগুড়ায় মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর এবং কুমিল্লার ময়নামতি-লালমাই-এগুলো আমাদের ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। আপনি যদি একটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তির গোড়ায় যেতে চান, তাহলে সেই দেশকে তার নিজের ইতিহাস জানতে হবে।
এই জায়গাগুলো আমরা পর্যটন করপোরেশনের জন্য উন্মুক্ত করেছি। মানুষ এগুলো দেখতে যায়। কিন্তু আমাদের ইতিহাসে এগুলোর তাৎপর্য জানতে হবে। এখানে বড় বড় অনেক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এটা মৌর্য সাম্রাজের অংশ ছিল। যেটি যিশু খ্রিষ্টেরও তিন-চার শ বছর আগে সম্রাট অশোকের সময়। এর প্রায় পাঁচ-সাত শ বছর পরে যেটাকে আমরা গুপ্ত সাম্রাজ্য বলি, বোঝার জন্য বলছি কালিদাশের কাল যেটাকে বলা হয় তখন বাংলাদেশের অংশ ছিল।
রাহাত মিনহাজ: স্যার, স্বাধীনতার পরও তো অনেক আবিষ্কার হয়েছে। অনেক কিছু নতুন করে সামনে এসেছে।
সলিমুল্লাহ খান: হ্যাঁ, একটা নতুন আবিষ্কার হয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর। সেটা উয়ারী বটেশ্বর। উয়ারী বটেশ্বরটা কোন জায়গায়? এক সময় ব্রহ্মপুত্র এসে যেখানে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হতো সেই সন্ধিক্ষণে, সেই মিলনস্থলে। দেখা গেছে সেখানে বহু পুরোনো আমলের মুদ্রা পাওয়া গেছে। হাবিবুল্লাহ পাঠান নামের একজন স্কুল শিক্ষক প্রথমে এগুলো সংগ্রহ করতেন। ২০০০ সনের পরে, বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কয়েকজন শিক্ষকের উদ্যোগে এটার খননকার্য শুরু হয়। তাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের ইতিহাসকে যতটা পুরোনো মনে করা হতো, তার চেয়েও বেশি পুরোনো। যেমন-সেখানে অনেক মুদ্রা পাওয়া গেছে, যে মুদ্রা আমরা পাল কিংবা সেন আমলে পাইনি। তাতে কোনো কিছু বেশি প্রমাণিত হয়েছে, তা বলছি না। কুমিল্লার লালমাই পাহাড় থেকে ময়নামতি, এই ১০-১২ মাইল বিস্তৃত জায়গায় বৌদ্ধ সভ্যতার অপূর্ব সব ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে। বৌদ্ধের শিলা, কষ্টি পাথরের মূর্তি। এগুলো যে শিল্পীরা তৈরি করেছিলেন এবং সেখানে যে বই লেখা হয়েছিল সেগুলোর কাহিনির এখনো সঠিক ইতিহাস আমাদের জানা নেই। এ জন্য বলছি, বাংলাদেশের ইতিহাসকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের ইতিহাসে পর্যবসিত করার মধ্যে আমরা এক ধরনের গৌরববোধ করতে পারি; কিন্তু এটা গোটা দেশের ইতিহাসকে খানিকটা অবহেলার দিকে ঠেলে দিতে পারে। এটা একটা বড় ব্যাপার। আমি এর জন্য বলব মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি, লালমাই এবং উয়ারী বটেশ্বর আরও বহু জায়গা আছে।
রাহাত মিনহাজ: স্যার ঢাকা বা এই অঞ্চলেও তো এক সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল। আমরা বিক্রমপুরের কথা জানি...
সলিমুল্লাহ খান: এই যে ঢাকা, সাভার, সোনারগাঁ- এগুলো মিলে ছিল বিক্রমপুর। এটা ছিল কেন্দ্রস্থল; কিন্তু এ দেশে সভ্যতার বিস্তার আরও হয়েছে। দিনাজপুরে বহু গড় পাওয়া যাচ্ছে। পঞ্চগড়ে গড় পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে এখানে অনেক বছর আগে রাষ্ট্র বা সমাজব্যবস্থা ছিল। চট্টগ্রামকে তো একটা অদ্ভুত দেশ বলা যায়। বাংলাদেশের সকল জীবিত শহরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও পুরাতন। কি জন্য? ঢাকার বয়স ৪০০ বছর। কলকাতার বয়স ৩০০ বছর। চট্টগ্রামের বয়স কম করে হলেও ১২০০ বছর। এটা আমরা জানি কীভাবে? পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে যারা বেড়াতে এসেছিলেন, যেমন চীন থেকে। তারা ওই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসতেন। এ রকম বন্দর সপ্তগ্রামে কলকাতার কাছে হুগলির মোহনায় ছিল। আর আমাদের হলো চট্টগ্রাম। এই কথাগুলো আমি এ কারণে বলছি যে বাংলাদেশ একটি অতি প্রাচীন দেশ। হয়তো এটা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর মতো প্রাচীন নয়। তাতে কিছু আসে যায় না। তবে এর সভ্যতা কম করে হলেও তিন হাজার বছরের। এই জিনিসটা বুঝলে আমাদের ভালো হয়, এই দেশের লোক সবসময় রাষ্ট্রের এক সীমানায় ছিল না।
রাহাত মিনহাজ: আর যদি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কথায় আসি।
সলিমুল্লাহ খান: দেখুন দেশের সীমানা কত দ্রুত বদলায়। ইংরেজ আমলে ইংরেজরা যখন সারা ভারত বিজয় শুরু করেছিল, তখন তারা তিনটি কেন্দ্র থেকে শুরু করেছিল। একটি হলো কলকাতা। একটা মুম্বাই আরেকটা মাদ্রাজ। এই কলকাতা সারা ভারতের রাজধানী ছিল। ১৯০৫ সালে যখন ইংরেজরা এই বাংলাদেশকে বিভক্ত করে দুটো প্রদেশ করল। আসাম আর পূর্ববঙ্গ, যাকে বঙ্গভঙ্গ বলে। অন্যদিকে বিহার এবং উড়িষ্যাসহ পশ্চিমবঙ্গকে আরেকটা প্রদেশ করা হয়েছিল। এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আসায় ছয় বছর পরে ইংরেজরা বঙ্গভঙ্গের রণে ভঙ্গ দিয়ে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে নিয়ে গেল। তাতে আমাদের ধারণা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজধানী চিরকালই বোধ হয় দিল্লি ছিল। এটা সত্য নয়। গত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে সারা ভারতবর্ষে রাজধানী হিসেবে দিল্লি পাঁচশ বছরের বেশি ছিল না। আমি সে কথাটিই বলছি। অর্থাৎ বাংলাদেশ সবসময় দিল্লির অধীনে ছিল না। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির (তুর্কি) বঙ্গ বিজয় থেকে যদি শুরু করেন, আমরা যদি সেটা হিসেবে ১২০০ সন ধরি তখন থেকে দেড়শ বছর পর্যন্ত হয়তো এটা দিল্লির সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারপর তো এটা দুইশ বছর পুরোপুরি স্বাধীন ছিল। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ পর্যন্ত। ১৫৭৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। তারপর আকবরের আমলে এই অঞ্চল প্রায় ১৭৫ বছর দিল্লির সাম্রাজ্যের অংশ থাকে। এমনকি সিরাজ-উদ-দৌলা, আলীবর্দি খান তারাও দিল্লির গভর্নর ছিলেন। তাদের সুবেদার বলা হতো। তারপর ইংরেজ আমল। এজন্য বলছি, আমাদের ইতিহাস কত বদলেছে। সীমান্ত দেখেন। আগে আমাদের বাংলাদেশের রাজধানী ছিল গৌড়। এরপর পশ্চিমবঙ্গে। গৌড়, পান্ডুয়া, রাজমহল বলে জায়গা ছিল।
বাংলাদেশের তখন ঐতিহাসিক যোগাযোগ ছিল বিহারের সঙ্গে। উত্তরবঙ্গ এবং বিহার মিলে যদি একটা ইউনিট হয়, তা হলে রাজধানীতো মধ্যস্থলে গৌড়েই হবে। এই বাংলাদেশকে তাই এক সময় গৌড়বঙ্গ বলা হতো। মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে। রাঢ়-গৌড়। বঙ্গ ছিল এইটাই, ফরিদপুর-ঢাকা এই অঞ্চল।
(ধারাবাহিকভাবে চলবে: পরের পর্ব বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নিয়ে সলিমুল্লাহ খানের মূল্যায়ন)
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: রাহাত মিনহাজ, সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে