প্রথম পর্ব
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফরেন পলিসি নিয়ে কাজ করার জন্য আসেনি
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশের খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী বন্ধু-রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দোদুল্যমান সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কূটনৈতিক সম্পর্ক কীরকম হতে পারে, তা নিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের সিনিয়র রিপোর্টার মানিক মিয়াজী। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।
ভিউজ বাংলাদেশ: ইউনূস-সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই সম্পর্কের ফলে বাংলাদেশ কী ধরনের লাভবান হচ্ছে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: কোনো নতুন সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তাদের কিছু ঘোষিত উদ্দেশ্য থাকে, সেটা হলো সংস্কার করা। আন্তর্জাতিক মহলে কতখানি কী করতে পারবে, তার চেয়ে বড় কথা হলো ঘরের ভেতরে সংস্কার করা জরুরি। আর এ সরকার তো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংস্কার করার জন্য আসেনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে, নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা যত তাড়াতাড়ি ত্বরান্বিত করতে পারবে ততই ভালো। আন্তর্জাতিক মহলও বুঝতে পারবে, তাদের সামনে কী করা উচিত। বর্তমান কিংবা নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করার একটা পরিকল্পনা তারা ঠিক করতে পারবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আগামী জানুয়ারি মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোন ধরনের ঝামেলায় পড়েতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা আছেন, তাদের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক পার্টির যে সম্পর্ক খোলামেলাভাবেই সবার জানা ছিল। এখন পর্যন্ত রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে ওই ধরনের সম্পর্ক আছে কি নেই, সেটা এখনো আমরা দেখিনি। তাদের মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক এখনো প্রকাশ পায়নি। জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় আসছেন ট্রাম্প। মনে রাখতে হবে যে, বড় ধরনের ম্যানডেড নিয়ে এবার রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় আসছেন, যা গত ১২৮ বছরেও হয়নি। তাদের সঙ্গে আগে সম্পর্ক না থাকলেও এখন তা তৈরি করা দরকার।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে বলে ট্রাম্প টুইট করেছেন। ট্রাম্পের শপথের পর তার কোনো প্রভাব কি পড়বে বাংলাদেশ সরকারের ওপর?
ইমতিয়াজ আহমেদ: বলতে গেলে ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ডেমেক্রেট পার্টির ভালো সম্পর্ক ছিল। ১৯৭১ সালের দিকে কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির সঙ্গে তেমন সম্পর্ক ছিলই না, বলতে গেলে তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক একবারেই খারাপ ছিল। বর্তমানে আবার আমরা দেখছি যে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, সেটা একটা দিক; কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে মাইনোরিটি নিয়ে ট্রাম্প প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেটা তো আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই। আমরা যদি সেই প্রিয়া সাহার কথা মনে রাখি, তা হলে তো আমরা তাই দেখি। সরকারের মহলের লোকরা তখন বলতো বিএনপি এসব করছে, এখন বলছে আওয়ামী লীগ করছে। তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে , যারা ট্রাম্প প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন, তারা পারিবারিকভাবে ভারতের কাছের। মাইনরিটি ইস্যু নিয়ে সবসময় রিপাবলিকানরা অনেক সরব ছিল। এর আগেও আমরা দেখেছি, এখনো আমরা দেখছি, বাংলাদেশে মাইনরিটি ইস্যু নিয়ে তারা কথা বলছে। আমরা যখন জানি যে, রিপাবলিকানরা এমন অবস্থানে রয়েছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের যারা কূটনীতি বোঝেন, বিশেষ করে এমন সংবেদনশীল ইস্যু নিয়ে কাজ করতে পারে, তাদের কাজে লাগানো দরকার।
ভিউজ বাংলাদেশ: সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভুয়া ভিডিও ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারের ফলে ত্রিপুরা বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে হামলা হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক নতুন করে আরও কি খারাপের দিকে যেতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: যখন আমরা দেখলাম ভারতের কিছু মিডিয়া ফলাও করে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল এবং নেগেটিভ প্রচারণা চালাচ্ছে তখনই বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল, তাদের হাইকমিশনারকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা। তবে আমি বলব ৪-৫ দিন দেরিতে হলেও এটা সঠিক কাজ হয়েছে। মানে বাংলাদেশ কূটনীতিতে ঢুকেছে। মাঝের কয়েকদিন আমাদের দেশ কূটনীতিতে ছিল না। কূটনীতিতে অনেক ভাষা আছে। সব ভাষাই ব্যবহার দরকার। কোন ভাষা কখন কাজ করে, তা বোঝা মুশকিল। তাই সব ভাষাই ব্যবহার করে দেখা দরকার। কোন মাধ্যম আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে তা তো আগে থেকে বলা যাবে না।
ভিউজ বাংলাদেশ: বলা হচ্ছে এ ঘটনা ভিয়েনা কনভেনশন পরিপন্থি। তা হলে বাংলাদেশ কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: এখানে মূলত তিনটি দিক রয়েছে, প্রথমত, এটা তো সরাসরি ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থি। দ্বিতীয়ত, ব্রিটেন কানাডা নিয়ে ভারত বারবার একই অভিযোগ করেছে। কারণ সেখানে ভারতের মিশনে হামলা হয়েছে। সেখানে ফ্ল্যাগ তোলা হয়েছে, ফ্ল্যাগ নামানো হয়েছে। সেখানে ভারত নিজে কীভাবে অন্য দেশের মিশনের ওপর হামলা করে তা দেখা দরকার। তাৎক্ষণিকভাবে যদি তাদের তলব করা হতো, তাহলে হয়তো বিষটি সমাধনে কিছুটা সহজ হতো। তাও দেখা যাক এখন কী হয়।
তবে তৃতীয় বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যে কোনো দেশে অন্য দেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হতেই পারে। আমেরিকার বিরুদ্ধে তো সারা পৃথিবীতেই বিক্ষোভ হচ্ছে। তবে সেখানে দেখতে হবে, যেন তা মিশনের কাছাকাছি না আসে। সেক্ষেত্রে ভারত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন দেখা দরকার ভারত কীভাবে মিশনগুলো রক্ষায় ভূমিকা রাখে।
ভিউজ বাংলাদেশ: হামলার ঘটনায় কি এটা প্রমাণ করে যে, বিদেশি মিশন রক্ষায় ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ? যদি ব্যর্থ হয়, তা হলে এর প্রভাব কি অন্য দেশের মিশনগুলোতে পড়বে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: তাৎক্ষণিকভাবে আমার কাছে মনে হয়েছে, দিল্লি কিংবা কলকাতা যেভাবে বিদেশি মিশন রক্ষায় অভিজ্ঞ ত্রিপুরা ততটা না। আমার মনে হয় আগরতলায় এর আগে কোনো বিদেশি মিশনে এমন ঘটনা ঘটেনি। তাই তাদের অভিজ্ঞতা তেমন নেই। সে ক্ষেত্রে তারা নিরাপত্তা দিতে অবশ্যই ব্যর্থ হয়েছে। ভারত নিরাপত্তার যেই আশ্বাস দিয়েছে সেটা তারা রক্ষা করতে পারছে কি না সেটা দেখা দরকার। আরেকটি জিনিস দেখা দরকার, যারা আসলেই ওখানে আছেন তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন কি না।
ভিউজ বাংলাদেশ: সেভেন সিস্টারের আইনশৃঙ্খলা কি ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: সেভেন সিস্টারে ভারতের নিরাপত্তার বাহিনী যথেষ্ট রয়েছে। সেখানে নিরাপত্তা রক্ষার্থে ভারত প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সৈন্যবাহিনী মোতায়েনে করে রেখেছে। এখন কথা হলো, তারা হয়তো সংঘাত মোকাবিলার অভিজ্ঞ; কিন্তু একটা দেশের মিশন নিরাপত্তা দিতে তাদের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: বিদেশি হাইকমিশনে হামলায় আমেরিকা, কানাডা, কিংবা ব্রিটেনে তাদের মিশনের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিতের সম্ভবনা কতটুকু?
ইমতিয়াজ আহমেদ: এই হামলার ফলে ব্রিটেন এবং কানাডার সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে। ব্রিটেন এবং কানাডার কাছ থেকে ভারতকে সব সময় শুনতে হয় এমন অভিযোগ। এখন তাদের বলতে সুবিধা হবে, তোমাদের দেশেই তো নিরাপত্তা দিতে পারো না, অথচ আমাদের বলো। তবে আমার মনে হয় না যে এ বিষটিকে অন্যান্য দেশগুলো সামনে নিয়ে আসবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের দেশের মিশনগুলোতে হামলা হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: বাংলাদেশে নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে ভারত তাদের হাইকমিশনের কার্যক্রম সীমিত করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী নিয়োগের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের একজন উপদেষ্টা ভারতের আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য পাল্টা শান্তিরক্ষীর কথা বলছে? এসব কথা কি কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: দুটোই রাজনীতির কথা। এটা কোনোভাবেই বলার কথা না। প্রথমত, এটা কেন্দ্রীয় সরকার বলার কথা। তা না বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললে তার কোনো মানে দাঁড়ায় না। আসলে দক্ষিণ এশিয়ায় যারাই ক্ষমতায় বসেন, তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বুঝেন না, আর না হয় বেশি সচেতন। আর না হয় মিডিয়ার এটেনশন চান। মমতা হয়তো ভেবেছেন আমি এটা বললে মিডিয়ার একটা এটেনশন পাবো। না হলে বিজিপি কিংবা দিল্লি পুরো ক্রেডিট নিয়ে ফেলছে। আমাদের দেশেও একই ধরনের কথা আমরা শুনতে পাই। আসলে যার যে কাজ না, সে সেই বিষয়ে কথা বললে এই সমস্যা তৈরি করে। তখন যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তার সমাধান করাটা আসলে জটিল হয়ে যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অবনতির ফলে বাংলাদেশ কি চায়না ভেল্টে ঝুঁকছে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিন্তু ফরেন পলিসি নিয়ে কাজ করার জন্য আসেনি। আর তারা জনে যে তারা বেশি দিন সরকারের থাকবে না। কিংবা থাকতে আসেনি। তাই কোনো বেল্টে ঢুকা না ঢুকার তাদের কিছু আসে যায় না। আর তারা যদি বেশি দিন সরকারে থাকতে চায় সেটা কিছুটা সমস্যা তৈরি করবেই। এখন বিদেশিরা হয়তো অপেক্ষা করছে কত তাড়াতাড়ি নির্বাচন হয়, নির্বাচনের পর তারা হয়তো সে সরকারের সঙ্গে এক ধরনের নেগোসিয়েশন করার চেষ্টা হতে পারে। এ মুহূর্তে হয়তো বিদেশিরা সেটার দিকে তাকিয়ে আছে, যারা আগামীতে ক্ষমতায় যেতে পারে কিংবা যাওয়ার সম্ভবনা আছে, সেসব দলের ফরেন পলিসি কী হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো কিংবা কমানোর আসলে কোনো বিষয় নেই।
(চলবে)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে