Views Bangladesh Logo

সংবিধানের মূলনীতি-বিতর্ক

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলেই সংবিধানের মূলনীতি বদলে যাবে এটি ভাবার কোনো কারণ নেই

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপক্ষেতার বদলে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র রাখার সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হয়, সেখানে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ এই তিনটি বিষয়কেই বাংলাদেশের সংবিধানের আদি মূলনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সংবিধান সংস্কার কমিশন এই তিনটির সঙ্গে বর্তমান সংবিধানের মূলনীতি ‘গণতন্ত্র’ বহাল রেখে একটি নতুন শব্দ এর সঙ্গে যোগ করার সুপারিশ করেছে, সেটি হলো ‘বহুত্ববাদ’।

কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধানের এই মূলনীতি বদলে দেয়া হবে; কী করে এটা কার্যকর হবে বা এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠবে কি না- সে বিষয়ে কথা বলার আগে একটু পেছনে ফেরা যাক। সংবিধানের মূলনীতি নিয়ে বিতর্কের শুরু আসলে ১৯৭২ সালে গণপরিষদেই। ‘গণতন্ত্র’ ছাড়া বাকি তিনটি মূলনীতি নিয়েই গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ইস্যুতে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে- যার রেশ এখনো টানতে হচ্ছে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে পরদিন থেকে শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অবর্তমানে তাকে রাষ্ট্রপতি করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।

বাংলাদেশের আইনি বৈধতা এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য একটি সরকার গঠন করা জরুরি ছিল। সেজন্য প্রয়োজন ছিল একটি ‘প্রকলেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ বা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তৈরি। এটি তৈরি করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তিনি লিখেছেন, ‘আমি ও তাজউদ্দীন ভাই যে ঘরে থাকতাম সে ঘরের একটি ছোট্ট স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে লেখার কাজ করি। আমার কাছে কোনো বই নেই, নেই অন্য দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো কপি। আমেরিকার ইন্ডিপেনডেন্স বিল অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। এ অরিজিনাল দলিল চোখের সামনে ভাসছে। আর সেই বড় বড় হাতের স্বাক্ষরগুলো; কিন্তু ভাষা বা ফর্ম কিছুই মনে নেই। তবে বেশি কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম না। শুধু মনে করলাম কী কী পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার রয়েছে। এমনই চিন্তা করে ঘোষণাপত্রের একটি খসড়া তৈরি করলাম। স্বাধীনতার ঘোষণার অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেয়া হলো।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়া রচনার পর তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালাম। তিনি পছন্দ করলেন। আমি বললাম, আমরা সবাই এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ। এই দলিলের খসড়াটি কোনো একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভালো হতো। তিনি বললেন এই মুহূর্তে কাকে আর পাবেন। যদি সম্ভব হয় কাউকে দেখিয়ে নিন। ইতিমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন। তাদের মধ্য সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। আমি তার লেখা কিছু নিবন্ধ পড়েছি বলে মনে হলো। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর ঠিকানা জেনে নিলাম। টেলিফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। বললাম তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন। বালিগঞ্জে (কলকাতা) তার বাসা। আমার পরিচয়, ‘রহমত আলী’ নামে। সুব্রত রায় চৌধুরীর বাসায় পৌঁছে তাকে আমার প্রণীত ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখালাম। খসড়াটি দেখে তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। এই খসড়া আমি করেছি কি না জিজ্ঞাসা করলেন। আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দিই। তিনি বলেন, একটা কমা বা সেমিকোলন বদলাবার কোনো প্রয়োজন নেই। (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কাগজ প্রকাশন/১৯৯১, পৃ. ৪৯)।

ওই ঘোষণাপত্রে লেখা হয়: ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম।’ স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রকেই বাংলাদেশের সংবিধানের আদি দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং মনে করা হয়, এখানে যে তিনটি অধিকারের কথা বলা হয়েছে, এগুলোই সংবিধানের আদি মূলনীতি। সংগত কারণেই প্রত্যাশা করা হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশের জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করা হবে সেখানে মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে; কিন্তু তা হয়নি। তবে এটা ঠিক যে, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের সঙ্গে সংবিধানের চার মূলনীতির অনেকখানি মিলও আছে। যেমন সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ বলছে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

যেখানে গণতন্ত্র আছে, সেখানে সাম্য আছে। সাম্য ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। গণতন্ত্র ছাড়া সাম্য হয় না। মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলেও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক আবহ থাকতে হয়। মানবিক মর্যাদা মানে প্রত্যেকে যে ইনডিভিজ্যুয়াল, অর্থাৎ প্রত্যেকের যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা আছে এবং প্রত্যেকে যে সমান মর্যাদা ও অধিকার লাভের অধিকারী, সেটিই গণততেন্ত্রর স্পিরিট।

সামাজিক সুবিচারও গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। অগণতান্ত্রিক সমাজে সুবিচার থাকে না। তার মানে যখন কোনো রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার কার্যকর হয়ে যায়। ফলে কেউ কেউ মনে করেন, সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে শুধু গণতন্ত্র থাকলেই সবকিছু এসে যায়। আলাদা করে সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা না বললেও চলে। যেমন আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন: গণতন্ত্র ছাড়া আর বাবি সবকটিই সরকারি নীতি। রাষ্ট্রীয় নীতি নয়। দেশে ঠিকমতো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইলেই আর সব ভাল কাজ নিশ্চিত হইয়া যায়। উল্লিখিত ভাল কাজ মানে জনগণের জন্য ভাল; জনগণের ইচ্ছামতোই সেসব কাজ হইবে। জাতীয়তাবাদ, সমাজবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা সবই জনগণের জন্য, সুতরাং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর। নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রই সে কল্যাণের গ্যারান্টি। গণতন্ত্র নিরাপদ না হইলে ওর একটাও নিরাপদ নয়। (আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, খোশরোজ কিতাব মহল/২০১০, পৃ. ৬১৯)।

বস্তুত সংবিধানের মূলনীতিগুলোর বিষয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম দিকে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের দুদিন পরে। এটি ছিল স্বাধীন দেশে তার প্রথম সংবাদ সম্মেলন। বলেন, গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণ। এর কিছুদিন পরে ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে যান, যেটি ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম বিদেশ সফর। সেখানে তিনি গণতন্ত্রসহ সংবিধানের চার মূলনীতি তুলে ধরেন। এর ২০ দিন পর ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে দেয়া এক জনসভায় তিনি বলেন, ‘শাসনতন্ত্রে লিখে দিয়েছি যে, কোনোদিন আর শোষকরা বাংলার মানুষকে শোষণ করতে পারবে না ইনশাল্লাহ্। দ্বিতীয় কথা, আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। জনগণের ভোটে জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ চালাবে এর মধ্যে কারো কোনো হাত থাকা উচিত নয়। তৃতীয়, আমি বাঙালি। বাঙালি জাতি হিসেবে বাঁচতে চাই সম্মানের সঙ্গে। চতুর্থ, আমার রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, হিন্দু তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, বুড্ডিস্ট তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। তবে একটা কথা হলো, এই ধর্মের নামে আর ব্যবসা করা যাবে না।’ (সময়রেখায় বঙ্গবন্ধু, শিলালিপি/২০২১, পৃ. ২৬০)।

বঙ্গবন্ধু যখন এই কথা বলছেন, তখনো সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়নি। তার মানে সংবিধানের মূলনীতি কী হবে সেই ভাবনাটি তার মাথায় আগে থেকেই ছিল এবং তিনি বলেছেন: ‘শাসনতন্ত্রে লিখে দিয়েছি।’ তার মানে সংবিধানের একটা খসড়াও হয়তো তার মাথায় ছিল- যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে ড. কামালের নেতৃত্বে প্রস্তুত হয়।

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের বৈঠক শুরু হয় এবং সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্য পরদিন খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ১২ অক্টোবর কমিটি প্রতিবেদন দিলে প্রতিটি অনুচ্ছেদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সেখানে চারটি মূলনীতির মধ্যে গণতন্ত্র ছাড়া বাকি তিনটি নিয়ে তুমুল আলোচনা ও বিতর্ক হয়। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ সিনিয়র নেতারা মূলনীতির পক্ষে তাদের জোরালো বক্তব্য রাখেন।

এটা অস্বীকার কার যাবে না, সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি কাজ করলেও এবং গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর দীর্ঘ আলোচনা হলেও পুরো প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধুর সরাসরি দিক-নির্দেশনা ছিল। তার বিশাল ব্যক্তিত্বের সামনে বাকিরা ছিলেন ম্লান। ফলে তিনি যা চেয়েছেন, তার বাইরে যাওয়া খুব বেশি সম্ভব ছিল না।

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন ছিল রাজনীতিতে গণতন্ত্র, অর্থনীতিতে সমাজতন্ত্র, পররাষ্ট্র নীতিতে জাতীয়তাবাদ এবং সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দুটি আলাদা রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থা হলেও বঙ্গবন্ধু এই দুটির মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল গণতান্ত্রিক পন্থায় সমাজতন্ত্রে উত্তরণ।

বলা হয় সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র যুক্ত করার পেছনে বঙ্গবন্ধুর ওপর রাশিয়ার প্রভাব ছিল। মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করেছে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠনের আগের মাসে ১৯৭২ সালের পয়লা মার্চ বঙ্গবন্ধু রশিয়া সফর করেন।

একইভাবে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করার পেছনে ভারতের প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়। তাছাড়া পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামোর অভিজ্ঞতার আলোকে মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করা হয়েছে বলে গণপরিষদে একাধিক সদস্য তাদের বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। তাদের মূল যুক্তি ছিল, পাকিস্তান ধর্মের দোহাই দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। সুতরাং সেই ধর্ম যাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপরিচালনায় কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা যুক্ত করা হয়।

১৯৭২ সালে যখন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন তার শুরুতে বিসমিল্লাহ ছিল না। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এ কে মোশাররফ হোসেন আকন্দ সংবিধনের প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় ও দয়াময়ের নামে’ যুক্ত করার প্রস্তাব দিলেও বঙ্গবন্ধু তাতে সায় দেননি; কিন্তু জিয়াউর রহমানের সময়ে পঞ্চম সংশোধনীর সময় প্রস্তাবনার শুরুতে বিসমিল্লাহ যুক্ত করা হয়। এরপর এরশাদ সরকার অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে যুক্ত করেন। তার ফলে সংবিধানে একইসঙ্গে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম ও মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বহাল থাকে- যা একধরনের গোঁজামিল তৈরি করে।

২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর সময়ে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের অনেক বিধান ফিরিয়ে আনা হলেও আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান থেকে বিসমিল্লাহ বা রাষ্ট্রধর্ম বাদ দেয়ার সাহস করেনি। তাছাড়া এ বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও রায় আছে। তবে এই সংশোধনীর সময় রাষ্ট্রধর্ম অনুচ্ছেদে কিছুটা সংশোধন আনা হয়। এখন এই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বাক্যটা এরকম: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা না হলেও এই অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে ইসলামের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মকে সমমর্যাদা দেয়া হয় এবং সব ধর্ম পালনে সকলের সমঅধিকার নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। যদিও কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে অন্য ধর্মের সমান মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করা যায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়ার যে সুপারিশ করেছে, তার মধ্য দিয়ে এই গোঁজামিলের হয়তো অবসান হবে; কিন্তু বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখলে ‘যে লাউ সেই কদু’। কেননা যখনই কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয়, তখন অন্য ধর্মগুলো মাইনর হয়ে যায়। ফলে এই চিন্তা থেকেই হয়তো সংবিধান সংস্কার কমিশন মূলনীতিতে ‘বহুত্ববাদ’ যুক্ত করার সুপারিশ করেছে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ