রাজনীতিকে রাজপথ থেকে আদালতে আনা উচিত নয়
একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদের অবসানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব পালন করছে। এই সরকার প্রতিহিংসার রাজনীতি করতে চাইবে, এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কারণ এই সরকার মনে করে, মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাজনৈতিক দল অন্যতম প্ল্যাটফর্ম। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিশ্চিতভাবে কিছু অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে গুম, খুন, হত্যা ও অরাজকতার একটা অপরাধপ্রবণ জায়গায় জড়িয়ে পড়েছিল। তার অর্থ এই নয় যে, আওয়ামী লীগে কোনো ভালো নেতাকর্মী নেই। আওয়ামী লীগকে যারা সমর্থন করেন, তাদের রাজনৈতিক অধিকার, তাদের একটা আদর্শকে সমর্থন করার অধিকার থাকবে না, আমি তা বিশ্বাস করি না।
যদি আওয়ামী লীগের কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকেন, সে জন্য পৃথক আইনে ওই ব্যক্তির অপরাধের আলাদা বিচার হবে; কিন্তু একজন মানুষের একটা আদর্শকে সমর্থন করার সাংবিধানিক যে অধিকার, সে অধিকার যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয়, সরকার এ বিষয়ে সচেতন। আমরা চাই না, কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হোক। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ ও দেশের সংবিধান মানুষের রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার এখতিয়ার দেয়নি। বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা। সরকারের পলিসির মধ্যে কোন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ এর পরিকল্পনা নেই। আর অন্য কোনো রাজনৈতিক দলও চায় না যে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হোক।
বর্তমান সরকার চায় সব রাজনৈতিক দলের জন্য ওপেন ও ফেয়ার গ্রাউন্ড তৈরি করা। আওয়ামী লীগের লাখ লাখ সাপোর্টার আছে। তবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি কেন এখন সামনে এলো? কারা এই প্রক্ষাপট তৈরি করেছে? এতদিন বিচার বিভাগকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে? বিচার বিভাগ কী ভূমিকা পালন করেছে? বিচার বিভাগ আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এখতিয়ারের অতিপ্রয়োগ করেছে। অতীতে অনেক রাজনৈতিক বিষয়কে কোর্টে টেনে আনা হয়েছে। এর মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের। তাই যে গণঅভ্যুত্থানটি হয়েছে, তা বিচার বিভাগের ওপরও এসেছে। আদালতে কোনো ঘটনা হলে আইনজীবী হিসেবে আমারও ভীষণ কষ্ট হয়।
সম্প্রতি একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের অবসান ঘটেছে। কর্তৃত্ববাদের অবসানের মধ্য দিয়ে অপরাধের বিচার করা এখন সহজ হয়েছে। তবে একটি সংগঠনকে বন্ধ করে দিয়ে, তাদের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন করার পক্ষে নয় বর্তমান সরকার। এটা হলে সংবিধানের মৌলিক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক ও দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি হবে। কোনো একটি রাজনৈতিক দলও এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কথা বলেনি। রাজনীতি রাজপথে হওয়া উচিত, আদালতে নিয়ে আসা ঠিক নয়। সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়ে মানুষের সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা হলে সেই অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে বলে মনে করি। যা কিছু আগে হয়েছে তা এখনো হলে সেটা হবে দুঃখজনক। এটা হবেও না।
বিচার বিভাগে অবশ্যই সুদিন ফিরবে। বাড়বে ভাবমূর্তি। মানুষের সত্যিকারার্থে আস্থার জায়গা হবে বিচার বিভাগ। সুপ্রিম কোর্টে অনেক বিচারপতির প্রতি আগে বহু অন্যায় হয়েছে। অনেকেই যোগ্যতা থাকার পরেও পদোন্নতি পাননি। অনেকে বিচারের জন্য বেঞ্চও পাননি। এক বুক হতাশা নিয়ে অবসরে গেছেন অনেক দক্ষ বিচারপতি। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সুপ্রিম কোর্টসহ বিচার বিভাগে সংস্কার প্রয়োজন। এই বিচার ব্যবস্থায় যেসব বিচারক মেরুদণ্ড নিয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে পারবেন, তারাই কাজ করবেন। এখন সাংবিধানিকভাবে বিচারপতি নিয়োগ হবে। দলীয় বিবেচনায় অযোগ্যদের নিয়োগ আর হবে না বলেই আশা করছি।
সুপ্রিম কোর্ট থাকবে সব ধরনের সিন্ডিকেট মুক্ত। কেউ সিন্ডিকেট করলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অনেক ডেপুটি, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদত্যাগ করেছেন, অনেক রুমে তালা লাগানো আছে, এক্ষেত্রে কী করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা অতি দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করব। বিচারাঙ্গনে অনেক অনিয়ম আছে। বাংলাদেশের এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটাই হলো অনিয়মের বিরুদ্ধে। এসব অনিয়ম, অনাচারের বিরুদ্ধে জনগণ রুখে দাঁড়িয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের কোনো অনিয়ম থাকতে দেব না। প্রয়োজনে ঢেলে সাজানো হবে সুপ্রিম কোর্টসহ সব বিচারালয়। সব মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিতে অবশ্যই আমি আমার সর্বোচ্চটা দেব।
মো. আসাদুজ্জামান: বাংলাদেশের ১৭তম অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে