কলকাতায় দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় লেখার উদ্যোগ
ভারত সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার দোকান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে পৌরসভা। সেগুলোতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ানো নিয়ে চিন্তা-ভাবনাও আরো দানা বাধছে।
সূত্র জানায়, বাংলা ভাষা ব্যবহারে জোরালো উদ্যোগ নিতে চলেছেন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ফিরহাদ হাকিম। শুক্রবার (৫ অক্টোবর) বাংলার ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতিতে আশাব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে বড় করে বাংলায় সাইনবোর্ড লিখুন। তারপর যার যে ভাষা পছন্দ, সেটা হিন্দি, উর্দু কিংবা ইংরেজি যাই হোক না কেন, তাতে লিখতে পারেন। তবে, বাংলা ভাষাকে আগে গুরুত্ব দিন’।
আনন্দিত কলকাতার মানুষও বলছেন, ‘বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির লড়াই বিশ্ববাসী জানে। সে বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারি হোক আর ভারতের আসাম রাজ্যের ঊনিশে মে। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের জন্য এ স্বীকৃতি তাই আনন্দের’।
‘বাংলা ভাষার যেকোনো অর্জন মানেই বাঙালির অর্জন, তিনি যে দেশেই থাকুন, বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন’- প্রতিক্রিয়া শহরটির নাগরিকদের।
মেয়র ফিরহাদ হাকিম এর আগেওে কলকাতা শহরের দোকান বা ব্যবসায়িক কেন্দ্রগুলোতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের করার কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল, ‘রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ বাংলা বোঝেন। তাদের মাতৃভাষা বাংলা। তাই বাংলায় লিখলে সবার বুঝতে সুবিধা হবে এবং এজন্য গর্ব অনুভব করতে পারবেন’। সেবার এই উদ্যোগ খুব একটা দানা বাধতে পারেনি।
আবার পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে যে কারণেই হোক, সে উদ্যোগে ভাটা পড়ে।
বাম শাসনামলে সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারে শিল্পী-সাহিত্যিকদের আহ্বানও সাড়া জাগিয়েছিল জনমনে। সে সময় কলকাতার অনেক জায়গায় বাংলা হরফের সাইনবোর্ড বসেছিল হিন্দি বা ইংরেজি উঠে গিয়ে।
শহর কলকাতায় বাংলা ভাষার মুগ্ধতা বিরাজমান রাখতে সে উদ্যোগের পুরোধা ছিলেন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাদের সহায়তা করেছিলেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকারও। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বামফ্রন্ট জমানায় ৯০-এর দশকে সুনীল-সহ আমরা অনেকেই শহরে বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরুর আন্দোলন চালিয়েছিলাম। সে সময়ের সরকারও আমাদের সাহায্য করেছিল। তবে সুনীল চলে যাওয়ার পর সেই আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল’।
কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ফিরহাদ হাকিমের উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়ে পবিত্র সরকার বলেন, ‘সত্যিই যদি আবার সে রকম কোনো উদ্যোগ শুরু হয়, তাতে আমি খুশিই হব। দেরিতে হলেও বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। তাই আমাদের উচিত, বাংলা ভাষা নিয়ে আরও বেশি কাজ করা’।
‘রাজ্য সরকার কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বাংলা ভাষার প্রসারে কাজ করে, তবেই এ ধরনের উদ্যোগ সফল হতে পারে’- যোগ করেন বরেণ্য এই ভাষাবিদ।
কলকাতার সাধারণ মানুষ আরো বলছেন, ‘যখন চিনা, জাপানিরা নিজের মাতৃভাষায় চালিত শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নততম দেশ হয়ে উঠছে, তখন কলকাতাসহ সারা পশ্চিমবঙ্গে ৫০ শতাংশের বেশি অভিভাবক নিজের সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পাঠাতে ব্যস্ত। তাতে অবশ্য আপত্তির কিছু নেই। সমস্যা হল, এই শিশুদের একটা বড় অংশ বাংলা পড়তে বা লিখতে পারে না’।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার একটু উদ্যোগী হলে হয়তো মিশ্র সংস্কৃতির কলকাতায় বাঙালি নিজের ভাষাকে আরেকটু সযত্নে লালন করতে পারবে বলেও মনে করেন তারা।
বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পাওয়ায় অবশ্য আনন্দ ও লড়াইয়ের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘আমি খুশি যে, বাংলাকে ধ্রপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হল। আমি দশ বছর ধরে লড়াই করছি। আমি গবেষকদের দিস্তা দিস্তা গবেষণাপত্র দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়েছিলাম। আজ যদি তামিলনাড়ু পায়, কেরালা পায়, বাংলা সারা পৃথিবীতে পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা, এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা। তাহলে আমাদেরটা কেন ধ্রপদী ভাষার স্বীকৃতি পাবে না? আমার নথিকে অস্বীকার করতে পারেনি কেন্দ্র। দীর্ঘদিন বঞ্চিত থাকলেও বাংলা তার সম্মান পেয়েছে। আমি খুশি।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে