পুলিশ যেন জনবান্ধব হয়
গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাবসমূহ জমা দিয়েছে। বলপ্রয়োগ, আটক, গ্রেপ্তার, তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ, মানবাধিকার, প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক বাহিনী গঠন, থানায় জিডি রেকর্ড, মামলা রুজু, তদন্ত ও ভেরিফিকেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। বিশেষ করে বেআইনি সমাবেশ ও শোভাযাত্রা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের শক্তি প্রয়োগের সীমা নির্ধারণ, পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও আসামিকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা চেয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বাহিনী সংস্কারের জন্য ২২টি আইনের সংশোধন ও পরিমার্জন চেয়েছে কমিশন।
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের ওপর পুলিশের অত্যধিক বল প্রয়োগের কারণে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং সর্বস্তরের মানুষ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ও নিন্দিত হয়। অনেক জায়গায় ছাত্র-জনতা ক্ষুব্ধ হয়ে থানা-ফাঁড়িগুলোতে আক্রমণ করে। গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করতে দেরি হয়। তারপর থেকেই পুলিশ বাহিনী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয় এবং অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সঙ্গে পুলিশ সংস্কার কমিশনও গঠিত হয়। পুলিশ সংস্কারের জন্য সুপারিশ তৈরি করতে সাধারণ মানুষের মত নিয়েছিল কমিশন। সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ এ বাহিনীকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ করার ওপর জোর দেয়।
এখন সুপারিশের ভিত্তিতে হয়তো পুলিশ বাহিনীর কিছু সংস্কার হবে কিন্তু তারপরও আমাদের দেশের পুলিশ সত্যিই কতটা জনবান্ধব হবে তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় রয়েছে। জানা গেছে, জনসাধারণের সঙ্গে পুলিশের আচরণ কী রকম হবে তা নিয়ে ইউরোপের মডেল ফলো করার কথা বলা হয়েছে সুপারিশে। ভিড় বা জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কিছু নিয়মকানুন আছে। সেটার ব্যাপারে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ডিটেইল একটা গাইডলাইন তৈরি করে দেয়া হয়েছে।
পুলিশ একটি বিশেষ বাহিনীর সদস্য হলেও তারা ব্যক্তিমানুষ; ব্যক্তিমানুষ হিসেবে পুলিশের যদি নীতিনৈতিকতা উন্নত না হয়, তাহলে শুধু আইন পরিবর্তন করে, কিছুটা সংস্কার করে কী ফল হবে? সংস্কারের সুপারিশগুলো বিশিষ্টজনরা বিশ্লেষণ করে বলছেন, সুপারিশে কিছু বিষয় পরিষ্কার নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পুলিশ বাহিনীর গুণগত পরিবর্তনও কঠিন। তাই সংস্কার প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ভালো হলেও এটি কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে এখনই বলা কঠিন। কারণ এর আগে পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
আমরা জানি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মাঝে নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে কাজ করে পুলিশ বাহিনী। ব্যক্তি রাষ্ট্র-সমাজের কাছে অনিরাপদবোধ করলেও পুলিশের কাছে আশ্রয় পাবে, তার যদি কোনো অপরাধ থাকে সেটা বিচার করবে আদালত; কিন্তু আমাদের দেশে পুলিশই অনেক সময় বিচারের দায়ভার কাঁধে নিয়ে নেয়; এবং অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতাবানের হাতিয়ার হয়ে কাজ করে যা পুলিশ ধারণার একেবারেই বিপরীত। তাই সমাজ ও আইন বিশ্লেষকরা প্রস্তাব দেন, বলপ্রয়োগ নয়; নেতৃত্ব, ভালোবাসা, ইনফ্লুয়েন্সিং ক্যাপাসিটি ও মানবিক গুণাবলি দিয়ে পুলিশকে জনগণের মন জয় করতে হবে। এ ছাড়াও পেশাগত বিষয়ে পুলিশের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। অপরাধ ব্যবস্থাপনার সুবিধার্থে থানায় থানায় কমিউনিটি পুলিশিংয়ের নিরপেক্ষ, প্রতিনিধিত্বমূলক ও অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তা কার্যকর করা উচিত।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে