টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত
দেশি মালিকানা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই শুরু হোক সংস্কার
দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে গত ১৬ বছরের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা কী? এ প্রশ্নের জবাব একবাক্যে দিতে হলে বলতে হবে, টেলিযোগাযোগ খাতে দেশি মালিকানা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা। অর্থাৎ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সার্বিকভাবে বিদেশি কোম্পানি এবং বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব হয়নি। উপরন্তু টেলিযোগাযোগ খাত থেকে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
দেশে ব্যবসা করা বিদেশি মোবাইল অপারেটরদের কর্মকর্তাসহ তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা অর্থ পাচারের জন্য আঙুল তোলেন টেলিযোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ করা দু-তিনটি দেশি কোম্পানির বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, এসব কোম্পানি টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের কথা বলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করেছে। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগের মোবাইল অপারেটর এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ, যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার আমদানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ‘ওভার ইনভয়েসিং (পণ্যের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য দেখানো)’ এর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা এদেশ থেকে হাতিয়ে নিয়ে গেছে।
দুটি অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রকৃত ও সুনির্দিষ্ট তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে সরকার চাইলে দুটি অভিযোগেরই সমাধান করতে পারে। প্রথমত, দেশি কোম্পানিগুলো গত ১৫ বছরে কতগুলো এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলেছে। এর বিপরীতে কত টাকা কোন উদ্দেশ্যে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তা সরকার অনুসন্ধান করতে পারে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় পর্যালোচনা, কোম্পানিগুলো কর্তৃক ব্যয় ও মূল্য পরিশোধের ধরন বিশ্লেষণ করেও প্রকৃত ব্যয় ও প্রদর্শিত ব্যয়ের পার্থক্য বের করা সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, বিদেশি মোবাইল অপারেটর এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়েও সরকার অনুসন্ধান করতে পারে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর আমদানি-রপ্তানির অনুমতি গ্রহণ এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় ও কিংবা ব্যবহারের সব তথ্য থাকে। দেখা দরকার বিদেশি বিনিয়োগকারী পরিচালিত তিনটি মোবাইল অপারেটর প্রকৃত পক্ষে এক বছরে কতবার বিদেশে আমদানি বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণের অনুমতি চেয়েছে, কোন ধরনের পণ্যের বিপরীতে কি পরিমাণ মূল্য নির্ধারণ করেছে, বিশ্ব বাজারে এসব পণ্যের প্রকৃত মূল্য কত এবং কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এর বিপরীতে দেশের বাইরে চলে গেছে। বিশেষ করে বিদেশের যে কোম্পানির নামে এলসি খুলে মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে, সেই কোম্পানি বাংলাদেশের তিনটি বিদেশি বিনিয়োগের মোবাইল অপারেটরদের মূল বিনিয়োগকারী কোম্পানির ছদ্মনাম কি না, সেটাও যাচাই করে দেখা উচিত। এমনো হতে পারে, এই অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের দীর্ঘ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির নেপথ্যের প্রকৃত কারণটাও উদ্ঘাটিত হয়ে গেল!
অবশ্য বিশেষজ্ঞ অনেকেই বলতে পারেন, মোবাইল অপারেটর এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা বিদেশি কোম্পানিগুলো এমনভাবে নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে ‘ওভার ইন ভয়েসিং’ গেম খেলে, সেটা ধরার সাধ্য সত্যিই কি বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষের আছে? বিদেশি কোম্পানির অতি উচ্চ বেতনের অসাধারণ স্মার্ট নির্বাহীদের সামনে দেশি কর্তৃপক্ষের চৌকস অনুসন্ধানী দল শেষ পর্যন্ত বোকা বনে যাবেন না তো?
এখানেই আমার আজকের মূল আলোচনা। আপনি যে গাড়িটি ব্যবহার করেন, সেটি অবশ্যই বিদেশি কোম্পানি তৈরি করেছে এবং বিদেশি প্রযুক্তির দ্বারা তৈরি; কিন্তু আপনি যখন এটি ব্যবহার করছেন, তখন তার মালিক আপনি, আপনার চালকও আপনার দেশি মানুষ, যিনি আপনার পরিচিত এবং বিশ্বস্ত। এই গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপনি যে ব্যয় করছেন, যেমন জ্বালানির মূল্য বাবদ পরিশোধিত অর্থ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে থেকে যাচ্ছে। যে চালকের বেতন দিচ্ছেন, তিনিও দেশি মানুষ এবং সেই বেতনের টাকা মূলত দেশেই খরচ করছেন; কিন্তু যখন আপনি বিদেশি মোবাইল অপারেটরকে প্রতি সেকেন্ডে কথা বলা কিংবা ডাটা ব্রাউজিংয়ের জন্য মূল্য পরিশোধ করছেন, তখন কিন্তু সেই টাকার একটি ক্ষুদ্র অংশ কর হিসেবে বাংলাদেশ সরকার পাচ্ছে। বড় অংশ কিন্তু মূল বিদেশি কোম্পানির কাছেই যাচ্ছে। কারণ এটা ব্যবসার নিয়ম। বিদেশি একটি কোম্পানি এ দেশে ব্যবসার জন্য বিনিয়োগ করেছে মুনাফার হিসাব করেই। অতএব, তার মুনাফা অর্জনকে অবৈধ বলার তো সুযোগ নেই। তবে অনৈতিক পন্থায় দেশে আয় করা টাকা বিদেশি কোম্পানির কোষাগারে পাঠানো হলে সেটা অবশ্যই অন্যায়।
শুধু দেশের টাকা বিদেশি কোম্পানি নিজের দেশে নিয়ে চলে যাচ্ছে, সেটাই বড় কথা নয়। বরং আজকের দুনিয়ায় সাইবার স্পেসে নিজেদের ডাটা ও তথ্যের সুরক্ষার জন্যও মোবাইল অপারেটর, মার্কেট প্লেস, রাইড শেয়ারিং, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ডাটা সেন্টার ও ক্লাউড সার্ভিস, এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও দেশি মালিকানাধীন হওয়া জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশই এখন এসব ক্ষেত্রে নিজেদের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করছে। ভারতে দেখুন, বিদেশি বিনিয়োগে মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ট্রান্সমিশন সার্ভিস গড়ে উঠলেও এখন সেখানে টেলিযোগাযোগ খাতে বিদেশি কোম্পানির অস্তিত্ব নেই। মোবাইল অপারেটর, ট্রান্সমিশন সেবাদাতা কোম্পানি, ইন্টারনেট সেবা দেয়া কোম্পানি- সবকিছুতেই দেশি কোম্পানি। আবার থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে নিজেদের মার্কেট প্লেস, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসকে সর্বাধিক জনপ্রিয় করেছে, যার ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলো আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে।
সাইবার নিরাপত্তায় কেন দেশি কোম্পানির প্রয়োজন, তার উদাহাণ চোখের সামনেই আছে। সর্বশেষ লেবাননে যেভাবে একসঙ্গে শত শত ডিভাইসে বিস্ফোরণ ঘটনো হলো, সেটা নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবার জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়। লেবাননের ঘটনার পর সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি আর শুধু সাইবার স্পেসে সীমাবদ্ধ নেই বরং সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সাইবার স্পেস ধারণ করে থাকা ডিজিটাল ডিভাইসের উৎপাদন এবং সাপ্লাই চেন ব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসতে পারে, আমাদের দেশি বিনিয়োগকারীরা কি বিদেশি কোম্পানির মতো মোবাইল অপারেটিং সার্ভিস, ক্লাউড সার্ভিস, মার্কেট প্লেস, এমএফএস সার্ভিস কোম্পানি তৈরি করতে পারে? উত্তরটা হচ্ছে, অবশ্যই পারে এবং করেও দেখিয়েছে।
যেমন ধরুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর রয়েছে টেলিটক। এখন সমস্যা হচ্ছে, টেলিটক জন্মলগ্ন থেকেই চরম অদক্ষ ও অপেশাদার, আমলাতান্ত্রিক পারিচালনা পর্ষদ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। মূলত পেশাদার ব্যবস্থাপনার অভাবেই এতদিনেও টেলিটক দাঁড়াতে পারেনি।একই কথা দেশের সবচেয়ে বড় টেলিযোগাযোগ কোম্পানি বিটিসিএলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিটিসিএলে দুর্নীতির অভিযোগ সবচেয়ে বেশি।
দুর্নীতির জন্য বিটিসিএলের নিজস্ব কর্মকর্তাদের দায় অবশ্যই আছে; কিন্তু গত ১৬ বছরের ইতিহাস অনুসন্ধান করে দেখুন, পদাধিকার বলে বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব মহোদয়গণ আসলে কী করেছেন বিটিসিএল ঘিরে? চমকে উঠবেন। সর্বশেষ বিটিসিএলের ‘ফাইভ-জি রেডিনেস’ প্রকল্প নিয়ে যে নজিরবিহীন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে, তার অনুসন্ধান করলেই বিটিসিএল কিংবা টেলিটকের মতো প্রতিষ্ঠানে বোর্ডে ‘পদাধিকার বলে’ দায়িত্বে থাকা চেয়ারম্যানরা চাইলে কীভাবে দিনকে রাতে বদলে দিতে পারেন, তার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে বলেই আমার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি।
আমার মনে হয়, এই ‘ফাইভ-জি রেডিনেস’ প্রকল্প থেকেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দুর্নীতির অনুসন্ধান শুরু হতে পারে। এ প্রকল্প ব্যবচ্ছেদ করলে গত ১৬ বছরে আরও বড় দুর্নীতির অনেক অজানা ইতিহাস সামনে চলে আসতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন বদল করার মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোকে ‘আমলাতান্ত্রিক ব্ল্যাকবক্স’ থেকে মুক্ত না করা হবে এবং পেশাদার ব্যবস্থাপনা পর্ষদ গড়ে তোলা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি খাতকে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়, এসব কোম্পানিও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। যদি সংস্কার করতেই হয়, তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলোর আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন পরিবর্তন থেকেই সেটা শুরু করুন।
বিদেশি মোবাইল অপারেটরগুলোতে পেশাদার ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। যে কারণে এসব কোম্পানিতে ব্যক্তিগত লাভের পরিবর্তে কোম্পানির সার্বিক মুনাফার বিষয়টি গুরুত্ব পায় ব্যবস্থাপকদের কাছে। কোম্পানি লাভবান হলে তারা নিজেরাও বেতন-ভাতা ও অন্যান্য পারিতোষিক সুবিধায় লাভবান হন; কিন্তু দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির ‘পদাধিকার বলে’র চেয়ারম্যান আজ এসে চেয়ারে বসেন, কাল চলে যান। তিনি জানেন, কোম্পানিতে তার মেয়াদ খুব বেশিদিন নেই। কোম্পানির লাভের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য পারিতোষিক সুবিধা বৃদ্ধিরও সম্পর্ক নেই। অতএব, কোনো একটি দামি প্রকল্প নিয়ে তার মাধ্যমে অল্প সময়ে নগদ কিছু কামাই করাটাই এই ‘পদাধিকার চেয়ারম্যান’ সাহেবদের মূল কার্যক্রম হয়ে ওঠে। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর; কিন্তু আর কতদিন? জেনে শুনে কেন আমলাতন্ত্রের দুর্নীতির বেড়াজালের মধ্যে বিটিসিএল, টেলিটিক, সাবমেরিন কেবল কোম্পানি কিংবা খুলনা কেবল শিল্প কোম্পানিকে বছরের পর বছর রাখা হচ্ছে?
কেউ কেউ বলতে পারেন বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি তো নিজস্ব চেয়ারম্যান দিয়ে চলছে। সেটার অবস্থা কি খুব ভালো? আসলে বাংলাদেশের মালিকানাধীন স্যাটেলাইট কোম্পানির ব্যবসা করার সুযোগই খুব সীমিত। এই কোম্পানির টেলিযোগাযোগ খাতে ভূমিকা রাখার পরিসরও ছোট। এ কোম্পানিতেও লোকসানের হিসাব লুকিয়ে রেখে ‘লাভ’ দেখানোর অপকৌশল চলেছে। অতএব, বিটিসিএল কিংবা টেলিটকের সঙ্গে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানির তুলনা করা এ খাত সম্পর্কে অজ্ঞতারই প্রকাশ মাত্র।
প্রকৃতপক্ষে বিটিসিএল, টেলিটকই হতে পারে দেশের বৃহত্তম ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে পেশাদার ব্যবস্থাপনায় আধুনিক করা হলে দেশের টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রাণকেন্দ্র হবে এ দুটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের নিজস্ব টায়ার ফোর ডাটা সেন্টার আছে। অথচ অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের কারণে এই ডাটা সেন্টারের নিয়ন্ত্রণও বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে! এই ডাটা সেন্টারের প্রকল্পে ক্লাউড সার্ভিস দেয়ার জন্য পৃথক বরাদ্দ থাকার পরও যখন বিদেশি কোম্পানি ওরাকলকে ক্লাউডের নিয়ন্ত্রণভার দিয়ে দেয়া হয়, তখন স্পষ্টই বোঝা যায়, অনিয়ম বড় ধরনেরই হয়েছে, এই ডাটা সেন্টার প্রকল্প ঘিরে। নিকট ভবিষ্যতে নিজেদের ডাটা সেন্টার এবং ক্লাউড সার্ভিস না থাকলে সাইবার নিরাপত্তার কিছুই প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বিদেশি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকা ক্লাউডে যখন দেশের সব সরকারি তথ্য জমা থাকে, তখন বুঝতে হবে, আপনার দেশের তথ্য আপনার কাছে নেই। আপনার ঘরের দরজার চাবি যদি অন্য কারও হাতে থাকে, তাহলে সে ঘরের মালিকানা আপনার হলেও সেটা কি আপনার জন্য নিরাপদ হবে?
আমাদের দেশে ‘আজকের ডিল’ ‘বাগডুম’ ‘কিকসা’ ‘পিকাবু’র মতো বড় স্বপ্ন নিয়ে বেশ কিছু মার্কেট প্লেস এসেছিল স্টার্টআপ হিসেবে। এসেছিল পাঠাও, ওভাই-এর মতো বড় পরিসরের রাইড শেয়ারিং সার্ভিস; কিন্তু সেগুলোর কিছুই দাঁড়াতে পারেনি। বরং অনেকগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। এসব স্টার্টআপ কেন ব্যর্থ হয়েছে, সে বিষয়েও তদন্ত হওয়া উচিত। অথচ দেখুন, পরে যাত্রা শুরু করেও থাইল্যান্ডে ‘গ্রাব’ রাইড শেয়ারিং সার্ভিস উজবেকিস্তানে ‘ইয়ানডেক্স গো’ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেছে। আমরা কেন এখনো মার্কেট প্লেসে, রাইড শেয়ারিংয়ে বিদেশি কোম্পানির শোষণের শিকার হয়ে যাচ্ছি? রাইড শেয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে একটি কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে দায়িত্বশীল গাড়ি চালকের খুবই অভাব। আমাদের অনেক দক্ষ চালক আছেন; কিন্তু দায়িত্বশীল চালক খুবই কম। দায়িত্বশীল চালক ছাড়া ট্যাক্সি সার্ভিস কিংবা রাইড শেয়ারিং সার্ভিস কোনোটিই দাঁড়াতে পারবে না। অতএব, দায়িত্বশীল চালক তৈরির দায়িত্বও সরকারকেই নিতে হবে।
২৮ বছরের পেশাদার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের নিজস্ব সক্ষমতা নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য সম্পদ এবং জনবল দুটিই আছে। দরকার শুধু সঠিক রাষ্ট্রীয় নীতি। বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতে ছোট বিনিয়োগ থেকে বড় বিনিয়োগকারীতে পরিণত হওয়া প্রতিষ্ঠান আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোতে পেশাদার ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসার পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। বিগত ১৬ বছরে যদি কোনো কোম্পানি অন্যায় সুবিধা নিয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে; কিন্তু ঢালাওভাবে ‘দেশের সব বিনিয়োগকারী কোম্পানি খারাপ, সুবিধাভোগী’- বিদেশি কোম্পানিগুলোর এই প্রচারণা থেকেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে। একটু ভালো খোঁজ করে দেখুন, গত ১৬ বছর শুধু নয়, গত ২৬ বছরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী কিন্তু বিদেশি কোম্পানিগুলোই ছিল।
দেখুন যুক্তরাষ্ট্রের হোক, চীনের হোক, নেদারল্যান্ডসের হোক কিংবা মালয়েশিয়ার হোক- সব বিদেশি কোম্পানি কিন্তু নিজের দেশের জন্যই নিবেদিত। আপনার-আমার পকেট থেকে মুনাফা নিংড়ে নেয়াটাই তাদের লক্ষ্য। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্র সরকার বছরের পর বছর রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিয়ে সে দেশের বেসরকারি কোম্পানি মাইক্রোসফট, ইনটেল, আইবিএম থেকে গুগল-ফেসবুক গড়ে তুলেছে। চীন জেডটিইর পাশাপাশি হুয়াওয়েকে আরও বেশি রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা দিয়েছে। মালয়েশিয়ার আজিয়াটা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সম্পদের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। অন্তত টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে চোখের সামনে থাকা সব দেশের বেসরকারি কোম্পানিই সে দেশের রাষ্ট্রীয় সুবিধা নিয়েই বিস্তৃত হয়েছে। অতএব, আমাদের দেশেও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রীয় নীতি সুবিধা দিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দেয়া উচিত। আগামীর সাইবার নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় নিজেদের নিরাপদ ও সক্ষম অবস্থান নিশ্চিত করার জন্যই এটা জরুরি।
রাশেদ মেহেদী: টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে