জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্রতই হোক সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রধান উদ্যোগ
আমাদের সবার জানা, সাধারণ অর্থে আইনের শাসন হলো আইনের সর্বোচ্চ প্রাধান্য। আইনের শাসনের মৌলিক নির্যাস হচ্ছে শাসনকার্যে স্বেচ্ছাচারিতার অনুপস্থিতি। এটি একটি সার্বিক প্রক্রিয়া এবং প্রায়োগিক বিষয় হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতাদের মনোভাব জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার অনুকূলে হওয়া একান্ত জরুরি। ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-দল নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয় নির্ধারণের মাপকাঠি হবে আইন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-শ্রেণি-দল-উপদল নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যেমন নিজস্ব প্রভাব বিস্তারে আইনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না, তেমনি কোনো নাগরিকই আইনের চোখে নিম্নতর হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের তার কৃতকর্মের জন্য আইনের মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি তার অধিকার ও দাবির ব্যাপারে আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে।
পক্ষান্তরে কোনো আইন যদি নীতিগত বা পদ্ধতিগতভাবে অযৌক্তিক হয়, তা হলে সে আইনে পরিচালিত শাসন আইনের মূলনীতির অনুকূল হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন-বাস্তবায়ন ও আইনের যথার্থ প্রয়োগ এবং মূল্যায়নসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োজিত সরকারের বিভিন্ন সংস্থা-বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা আবশ্যক। বিশেষত বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা একান্তই জরুরি।
আইনের শাসনের প্রবক্তা অধ্যাপক কে আলবার্ট ভ্যান ডাইসি ১৮৮৫ সালে তার প্রকাশিত ‘ল অব কনস্টিটিউশন’ গ্রন্থে আইনের শাসননীতির বিশদ ব্যাখ্যা করেন। তিনি আইনের শাসন বাস্তবায়নে চারটি শর্ত উল্লেখ করেন। শর্তগুলো হলো- আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান সুবিধা ভোগ করবে, সবার জন্য স্বাধীন বিচার বিভাগ উন্মুক্ত থাকবে, বিনা কারণে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না ও দেশের প্রচলিত আইন দ্বারা নাগরিক অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। অধ্যাপক ডাইসির অন্যতম সমর্থক লর্ড হিউয়ার্ট বলেন, ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা নির্ণয় বা রক্ষার জন্য স্বৈরাচারিতা বা আইন নয়, এমন কোনো বিকল্প পদ্ধতির পরিবর্তে সাধারণত আইনের সার্বভৌমত্ব বা প্রাধান্যকে আইনের শাসন বলা হয়। তাই রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে সবাই সমভাবে স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করতে পারবে, সবলের অত্যাচার হ্রাস পাবে এবং ব্যক্তি তার জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিত করতে সক্ষম হবে।’ অপর মনীষী জেনিংসের মতে, আইনের শাসনের চারটি ধাপ হলো সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা অপরাধ নির্ধারণ করা, আইনবহির্ভূত অপরাধে কাউকে শাস্তি না দেয়া, শাস্তি-সংক্রান্ত আইনকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা ও যে সময়ের অপরাধ সে সময়ের আইন দ্বারা বিচার করা।
গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেশভেদে আইনের শাসনের ভিন্নতা পরিলক্ষিত। ইংল্যান্ডে যেসব সাধারণ নীতি দ্বারা আইনের শাসন নিশ্চিত হয়েছে তার অধিকাংশই সেখানকার নাগরিকদের আদালতে উত্থাপিত বিভিন্ন মামলার বিচার বিভাগীয় রায়ের ফসল। ওইসব রায়ে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার নির্ধারিত হয়েছে। এ ছাড়া ম্যাগনা কার্টা (১২১৫), দ্য পিটিশন অব রাইটস (১৬২৮) এবং বিল রাইটস (১৬৮৯)-এ ইংরেজদের স্বাভাবিক অধিকারগুলো ঘোষিত হয়েছে যা ওই দেশের আইনের শাসন নিশ্চিত করে। ইংরেজ জাতির ঐতিহ্য-রীতিনীতি-ব্যবহারবিধি এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে ইংরেজদের সচেতনতা গড়ে উঠেছে। সেগুলো পরবর্তীকালে সৃষ্ট অনেক নতুন রাষ্ট্রের লিখিত সাংবিধানিক দলিলের মতোই অলঙ্ঘনীয়। অধিকাংশ নতুন রাষ্ট্রের সংবিধানে ইংরেজদের ওইসব অলিখিত নীতিমালা সন্নিবেশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সংবিধানের আওতায় যে কোনো আইন প্রণয়নে ক্ষমতাপ্রাপ্ত; কিন্তু এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের প্রণীত আইন প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। যেহেতু সংবিধান কংগ্রেসসহ সব প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে, সেহেতু কংগ্রেস সংবিধানবহির্ভূত বা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারে না। করলেও তা আইনের শাসনের ব্যত্যয় হবে, কারণ সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন ও কংগ্রেস প্রণীত আইন দেশটির সংবিধানের অধীন। এই যুক্তিতে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কংগ্রেস কর্তৃক প্রণীত আইন বাতিল করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনের শাসনের আরও একটি দিক হচ্ছে সংবিধানের অনুশাসন অনুসারে আইন প্রণয়নের সঠিক ব্যবহার। সংবিধানে ফেডারেল ও স্টেট সরকার কোন কোন ধরনের আইন প্রণয়ন করতে পারবে তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। স্টেট সরকারের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের আইন যদি কংগ্রেস প্রণয়ন করে কিংবা ফেডারেল সরকারের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের আইন যদি স্টেট আইনসভা প্রণয়ন করে তবে সুপ্রিম কোর্ট সেই আইনগুলো বাতিল করে দিতে পারবে।
আইনের শাসন বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সংবিধানের ২৭ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান বলে বিবেচিত হবে এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী হবে। ৩১ ধারা অনুসারে আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী আচরণ লাভের অধিকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। প্রচলিত আইনের বাইরে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না যাতে তার জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি হতে পারে। তাই দেশের সংবিধান অনুযায়ী সরকার প্রচলিত আইনের বাইরে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে না যা ব্যক্তির জান, মাল, সম্মান ও সুনামের জন্য হানিকর। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হলে তা অবশ্যই প্রচলিত আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়মনীতি ও পদ্ধতির অনুসরণ করে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কেননা সংবিধানে ব্যক্তির বিচার হওয়ার যেমন বিধান আছে, তেমনি তার আইনের আশ্রয় লাভেরও অধিকার আছে। পার্লামেন্টে কোনো আইন পাসের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে সংবিধানের ২৭ ও ৩১ ধারার মূলনীতি ও চেতনার প্রতি সজাগ থাকতে হবে। আইন অনুসারে কারও বিচার চাওয়া বা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটাই বিবেচ্য বিষয় হবে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক।
আইন সবার জন্য সমান হলেও বাস্তবে তার সমান প্রয়োগ তেমন দৃশ্যমান নয়। দেশে আইনের রাজনৈতিক অপপ্রয়োগ স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে পরিচালিত ছিল। সরকার বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম, হামলা-মামলা ইত্যাদি রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি দেশের রাজনীতিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে যা আইনের শাসনের পরিপন্থি। এটি আমাদের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, ব্যক্তির চেয়ে দেশ এবং দেশের সংবিধানসম্মত আইনের শাসনের সুরক্ষাই হচ্ছে যে কোনো সরকার-আদালতের প্রধান দায়িত্ব। যে কোনো ধরনের আপসকামিতা-অনৈতিক সমঝোতা কোনোভাবেই সুশাসনকে মর্যাদাসীন করে না। ‘আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলে’ এই আরাধ্য বিধিবিধানকে পক্ষপাতদুষ্ট বা কূটকৌশলে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা মোটেও সমীচীন নয়। দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব দেশপ্রেমিক জনগণ-রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে পৌঁছানো সময়ের জোরালো দাবি। মোদ্দা কথা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কারে সব পর্যায়ে শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের অবসান। মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অযৌক্তিক পন্থাকে সংহার করতে হবে। জনগণের সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্রতই হোক সরকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রধান উদ্যোগ।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী: শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে