Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ: জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাওয়া এক ক্রিকেটার

Dulal Mahmud

দুলাল মাহমুদ

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

ব্যসাচী ক্রিকেটার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের তার ক্যারিয়ার নিয়ে আক্ষেপ না থাকলেও আমাদের কিন্তু আক্ষেপ থেকে যাবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে ধাপে ধাপে সরে দাঁড়ালেও তাকে নিয়ে তেমন কোনো মনোকষ্ট নেই। ৩৯ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার অনেক আগেই তার সেরা সময় পেরিয়ে এসেছেন। যদিও মাঝে মাঝেই বুড়ো হাড়ের ভেল্কি দেখিয়েছেন, কিন্তু সেটার মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়েছে। তারপরও যে কোনো কারণেই হোক, নিজের গ্ল্যামার ভাঙিয়ে ক্যারিয়ারটাকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দীর্ঘ করার পথ বেছে নিয়েছেন।

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অধিকাংশের এমনই বৈশিষ্ট্য। ফর্ম না থাকলেও নিজেদের শেষ পর্যন্ত অপরিহার্য মনে করেন। যখন সরে দাঁড়ান কিংবা সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন, তখন তাদের প্রতি আর আকর্ষণ থাকে না। ক্রিকেটাররা কেন যেন নিজেদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন না। সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন। খ্যাতির হ্যাংওভার কাটাতে পারেন না। ক্যারিয়ারজুড়েই এজন্য খেসারত দিতে হয়।

খেলোয়াড়ি জীবন শেষে যেখানে থাকার কথা, সেখানে পৌঁছাতে পারেন না। মজার বিষয়, তা নিয়ে বেশিরভাগ ক্রিকেটারকে আক্ষেপ করতে দেখা যায় না। হয়তো ভাবতে পারেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে যেটুকু নামডাক হয়েছে, তাতেই শোকর আলহামদুলিল্লাহ। অল্পেই সন্তুষ্ট থাকার এই মনোভাবের কারণে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব হয় না। এই না পারাদের অন্যতম হলেন মাহমুদউল্লাহ।

মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে আক্ষেপের কারণ, তাকে নিয়ে অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল। তিনি পুরোপুরিভাবে সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। তাকে নিয়ে বড় ধরনের একটি অপূর্ণতা রয়ে গেছে। যে কারণে জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাওয়া এক তারকা ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। যুগপৎভাবে ধারাবাহিকতা এবং অধারাবাহিকতার প্রতিমূর্তি। অথচ তিনি যদি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে খেলতে পারতেন, তাহলে আরও উঁচুতে থাকত তার আসন। বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হতে পারত।

প্রশ্ন আসতে পারে, কেউ কি ইচ্ছে করে খারাপ খেলেন? সেটা হয়তো খেলেন না। তবে অন্তর্গত তাগিদ বলতে একটা কথা আছে। খেলার প্রতি গভীর নিবেদন এবং নিজেকে পুরোপুরিভাবে নিংড়ে দেয়ার মানসিকতা থাকলে মাহমুদউল্লাহর মতো প্রতিভাবান ও মেধাবী ক্রিকেটারের কাছ থেকে আরও বেশি কিছু পাওয়া যেতে পারত।

কেন যেন তাকে মনে হয়েছে ক্যাজুয়াল ক্রিকেটার। যখন মনোযোগ দিয়ে খেলেছেন, তখন তাকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। আর মনোযোগ হারিয়ে ফেললে তাকে মনে হয় খামখেয়ালিময় এক ক্রিকেটার। এ কারণে দেখা যায়, পর পর কয়েকটি ম্যাচ খুব ভালো খেলেন। আবার একটানা কয়েকটি ম্যাচে ডাব্বা মারেন।

‘সাইলেন্ট কিলার’ হিসেবে খ্যাত এই অলরাউন্ডার মিডল অর্ডার কিংবা লোয়ার অর্ডারে নেমে এমন সব ম্যাচ জিতিয়েছেন, তা এক কথায় বলা যায় অবিশ্বাস্য। এ কারণে তাকে ফিনিশার হিসেবেও অভিহিত করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দল জিততে না পারলেও তার নিঃসঙ্গ লড়াই নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

মাহমুদউল্লাহর ক্যারিয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উত্থান আর পতনের গল্প। ২০১৫ সালে ওয়ান ডে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে। প্রথম ম্যাচে জিতলেও দ্বিতীয়টিতে হেরেছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার অপরাজেয় ১০২ রানের ইনিংসে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় দল।

২০১৮ সালে কলম্বোয় নিদহাস টি-টোয়েন্টি ত্রিদেশীয় সিরিজে ১৮ বলে ৪৩ রানের মারকুটে ইনিংস খেলে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে বাংলাদেশকে ফাইনালে নিয়ে যাওয়ার নায়ক ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে ওয়ান ডে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ৪৬ ও ৬৯ রানের চমকপ্রদ ইনিংস খেলেন। ২০২২ সালে সফরকারী ভারতের বিপক্ষে ৭৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

২০২৩ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তার একাকী লড়াই মন ছুঁয়ে যায়। তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১১১ রানের ইনিংসটি উল্লেখযোগ্য। টেস্ট ক্রিকেটেও তার ভালো ভালো অনেক ইনিংস রয়েছে। ২০১০ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি এবং ২০১৮ সালে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৩৬ রানের ইনিংসের কথা স্মরণ করা যায়।

তবে তীরে গিয়ে তরী ডুবানোর বদনামও আছে। ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে ফিনিশিং ঠিকমতো করতে না পারায় স্বাগতিক ভারতের কাছে ১ রানে হারার দুঃখটা রয়ে গেছে। এ ছাড়া একাধিকবার অর্পিত দায়িত্বের ভারে ভেঙে পড়েন তিনি।

মূলত ব্যাটসম্যান হিসেবে সাফল্য পেলেও বল হতে কখনো-সখনো প্রয়োজনীয় সমর্থন দিয়েছেন। ঘুরিয়ে দিয়েছেন খেলার মোড়। ২০০৯ সালে কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৮ উইকেট নিয়ে কার্যকর অবদান রাখেন। এ ছাড়া ব্যক্তিগত কিছু মাইলফলকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম।

ধ্রুপদি ক্রিকেটারদের একজন মাহমুদউল্লাহ। তার ব্যাটে আছে সৌকর্য ও সৌন্দর্য। তার নান্দনিক ব্যাটিংশৈলী দর্শকদের ভরিয়ে দিয়েছে মুগ্ধতায়; কিন্তু তিন সংস্করণের ক্রিকেটের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে তাকে বদলাতে হয়েছে খেলার প্যাটার্ন। এ কারণে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ এই ক্রিকেটার দলের প্রয়োজনে কতটা আক্রমণাত্মক হতে পারেন, তার নজিরও তিনি স্থাপন করেছেন।

নিপাট ভদ্রলোক, সজ্জন ও মৃদুভাষী ক্রিকেটারের প্রতিকৃতি মাহমুদউল্লাহ। তাকে নিয়ে কোনো স্ক্যান্ডাল নেই। কোনো তর্ক-বিতর্ক নেই। খেলার মাঠে ও মাঠের বাইরে ক্রিকেটারদের নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। পেশাদার ক্রিকেটের এই যুগে নিজেকে নির্ভেজাল ও নির্দোষ রাখা মোটেও সহজ নয়। সে ক্ষেত্রে তিনি অনন্য ও ব্যতিক্রম। কোনো মালিন্য তাকে স্পর্শ করতে দেননি। ‘ক্রিকেটীয় আচরণ’ মেনে চলার ব্যাপারে সম্ভবত তিনি ভিক্টোরিয়ান ঘরানাকে অনুসরণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা পাঁচজন ক্রিকেটারের অন্যতম মাহমুদউল্লাহ। যদিও পরিণত বয়সেই ক্রিকেট থেকে সরে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেট থেকে। ২০২১ সালে সর্বশেষ টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক ছিলেন। হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই টেস্টে অপরাজিত ১৫০ রানের ইনিংস খেললেও আনুষ্ঠানিকভাবে টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেননি। এখনো তার মনোবাসনা আছে ওয়ানডে খেলার। খেলার সুযোগ পাবেন কি না সেটা নিশ্চিত নয়।

মোটামুটিভাবে ক্যারিয়ারের অন্তিম পর্বে দাঁড়িয়ে আছেন মাহমুদউল্লাহ। তার শূন্যতা সহজে পূরণ হবে না। তিন সংস্করণ ক্রিকেট মিলিয়ে দশ সহস্রাধিক রান, দেড় শতাধিক উইকেট, দেড় শতাধিক ক্যাচের ওজন তো নেহাত হালকা নয়। এর সঙ্গে আছে অধিনায়কীয় ক্যারিশমা। সামগ্রিকভাবে আরেক জন অলরাউন্ডার মাহমুদউল্লাহকে পাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হবে বৈকি।

লেখক: সম্পাদক, পাক্ষিক ক্রীড়াজগত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ