Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

শুভ নববর্ষ ১৪৩১

মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালার গুরুত্ব বাড়িয়েছে

AAMS Arefin  Siddique

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৪

বাংলা নববর্ষ আমাদের বাংলাদেশের মানুষের জন্য গর্ব, ঐতিহ্য এবং অহঙ্কারের একটি বিষয়। কারণ পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি আছে, যাদের কোনো নিজস্ব ক্যালেন্ডার নেই। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার দিয়ে তারা তাদের বছর হিসাব করে। এদিক থেকে আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান একটি জাতি এই জন্য যে, আমাদের একটি নিজস্ব সন আছে, একটি বাংলা পঞ্জিকা আছে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় হিসাব-নিকাশ করে থাকেন এ ক্যালেন্ডারের ভিত্তিতে। বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষিভিত্তিক দেশ। কৃষিই আমাদের প্রধান কৃষ্টি। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তারা নানা কাজে বাংলা সন এবং পঞ্জিকা ব্যবহার করেন।

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এই দেশে আমরা ঋতু বৈচিত্র্যের ছোঁয়া পেয়ে থাকি দৈনন্দিন জীবনে। ঠিক একইভাবে ঋতু ভেদে আমরা কৃষিপণ্যের বৈচিত্র্য অনুভব করে থাকি। ঋতু বৈচিত্র্যের দেশে নিজস্ব ক্যালেন্ডার থাকাটা যে কত প্রয়োজনীয়, তা আমরা বিভিন্ন কাজে বুঝতে পারি। ধর্মীয় কারণে আমরা হিজরি ক্যালেন্ডার এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কাজে আমরা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি। বাংলাদেশের নিজস্ব সন এবং ক্যালেন্ডার থাকায় আমরা গর্বিত। পহেলা বৈশাখ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা বছর শুরু হয়। সারা দেশের মানুষ এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে।

সরকারি অফিস আদালতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় বাংলা সন এবং তারিখের ওপর। বাংলা তারিখ লিখে তার নিচে গ্রেগরিয়ান তারিখ দেয়া হয়। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয় অত্যন্ত আনন্দময় পরিবেশে। এই দিন সরকারি ছুটি থাকে। সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে পহেলা বৈশাখ পালনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন সংগঠন পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এভাবে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এক ধরনের আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পহেলা বা বাংলা নববর্ষ এমনই এক দিন বা অনুষ্ঠান, যেখানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে। এভাবে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা সর্বজনিনতা লাভ করে।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট রমনার বটমূলে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তার খ্যাতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। সারা পৃথিবীতে ছায়ানটের এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচিতি লাভ করেছে। ছায়ানট পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তা আমরা শুধু ঢাকায় বসে দেখি তা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও অনলাইনে যুক্ত হয়ে ছায়ানটের অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও ছায়ানটের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালা কখনোই মিস করতে চান না।

এ ছাড়া পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্র্রীরা যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে, তা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানমালার গুরুত্বকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার অর্থই হচ্ছে পহেলা বৈশাখে আমরা নিজেদের জন্য মঙ্গল কামনা করি। আর পাশাপাশি সারা বিশ্ববাসীর জন্যও মঙ্গল কামনা করি। মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে যাবতীয় অমঙ্গল দূরীকরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। সব জীর্ণ পুরাতনকে অতিক্রম করে আমরা নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করি পহেলা বৈশাখে। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে চারুকলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীরা যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করে, তা শুধু বাংলাদেশের ঐতিহ্য নয়। ইউনেস্কো আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমি মনে করি, পহেলা বৈশাখের তাৎপর্য আরও ব্যাপকভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন। যাতে তারা বুঝতে পারে পহেলা বৈশাখ শুধু একটি মাত্র দিন নয়। এর আলাদা গুরুত্ব এবং তাৎপর্য আছে। দেশব্যাপী পহেলা বৈশাখ আরও কার্যকরভাবে উদযাপন করা প্রয়োজন। যাতে পুরো জাতি এই দিনের তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির চাপে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনেক সময়ই কোণঠাসা হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। বিদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে দেশকে মুক্ত রাখার জন্যও পহেলা বৈশাখ আরও ব্যাপকভাবে পালন করা দরকার।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভুলতে বসেছি। কাউকে যদি বলা হয়, আজকে বাংলা কত তারিখ, তাহলে অনেকেই সঠিকভাবে তা বলতে পারবেন না; কিন্তু গ্রেগরিয়ান তারিখ জানতে চাইলে ঠিকই বলতে পারবেন। বিদেশি সন বা সংস্কৃতি আমরা গ্রহণ করব না, তা নয়; কিন্তু তাই বলে আমরা যাতে নিজস্ব গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভুলে না যাই। নিজস্ব কৃষ্টি-কালচারকে ভুলে গিয়ে কোনো জাতিই পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারে না। আমরা একটি স্বাধীন দেশে বসবাস করছি এবং আমাদের একটি নিজস্ব সন আছে, এই বিষয়টিও আমরা নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে সঠিক এবং কার্যকরভাবে তুলে ধরতে পারছি না। যদিও অফিস আদালতে বাংলা সন এবং তারিখকে গুরুত্বের সঙ্গেই তুলে ধরা হয়। তারপরও আমরা বাংলা সন এবং পহেলা বৈশাখের ঐহিত্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারছি না। এবারের পহেলা বৈশাখ পালনকালে আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে শপথ নেব, আগামী এক বছর আমরা কীভাবে আমাদের জীবনকে পরিচালিত করব। জীবনের প্রতিটি স্তরে পহেলা বৈশাখের উদার চেতনার প্রতিফলন ঘটাব। বাংলাদেশের সংস্কৃতি-ঐহিত্য যে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত, এই চেতনার প্রতিফলন ঘটাতে হবে জীবনের প্রতিটি স্তরে।

পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে আমি শুভেচ্ছা জানাই। একই সঙ্গে আসুন আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ হই, আগামীতে আমাদের প্রত্যেকের জীবন চলার পথে পহেলা বৈশাখের চেতনাকে ধারণ করে এগিয়ে যাব। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময়ই বাংলাদেশের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন এবং ধারণ করে এগিয়ে যাবার কথা বলেছেন। নিজের জীবনকে সুসংস্কৃতির মাধ্যমে সমৃদ্ধ করার কথা বলেছেন।

আমরা আজকে বাংলা ভাষায় কথা বলি। বাংলা ভাষা এখন শুধু বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা মাত্র নয়। বাংলা এখন আন্তর্জাতিক ভাষায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে আন্দোলন-সংগ্রামের কারণেই। বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। আমাদের আজকে শপথ নিতে হবে, বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আমরা বুকে ধারণ করব। বিশ্বব্যাপী এর প্রচার প্রসারে যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাব। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতিকে অবহেলা করে কোনো জাতি উন্নতি অর্জন করতে পারে না। বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। জাতির পিতার বক্তব্যের মর্মার্থ উপলব্ধি করে আমাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে ভবিষ্যতের পানে এগিয়ে যেতে হবে।

আমাদের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি কিছুটা উদাসীনতা প্রত্যক্ষ করা যায়। এর কারণ হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক আচার আচরণে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দিচ্ছি। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশের নিজস্ব ভাষা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। আমরা বিশ্বের বহু বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করি; কিন্তু নিজের মাতৃভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর তেমন একটা জোর দেই না। নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিও যে শিখতে হয়, এটা আমরা অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করি না। আমরা মনে করি, নিজের ভাষা তো আমি জানিই এটা আবার শেখার কি আছে; কিন্তু বাংলা ভাষা ভালোভাবে পড়তে এবং লিখতে হলে নিয়মিত চর্চা করতে হয়। ইংরেজি ভাষা শেখানোর সময় আমরা বানান এবং উচ্চারণ যতটা গুরুত্ব দিয়ে শেখাই, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই অবহেলা করি। ফলে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বাংলা ভাষা সঠিকভাবে উচ্চারণ করা এবং বানান লেখার ব্যাপারে দুর্বলতা প্রত্যক্ষ করা যায়।

শিক্ষাজীবন থেকেই বাংলা ভাষা ভালোভাবে শেখা এবং বাংলা ক্যালেন্ডার ব্যবহারের প্রতি যদি আমরা জোর দেই, তাহলে নিজস্ব ভাষা এবং বাংলা বর্ষের প্রতি মমত্ববোধ অনেকটাই বৃদ্ধি পেতো। আমরা যখন সকালবেলা ক্লাস শুরু করি, তখন বোর্ডে খ্রিষ্টীয় সন এবং তারিখ লেখা হয়; কিন্তু অধিকাংশ সময়ই বোর্ডে বাংলা সন এবং তারিখ লেখা হয় না। আমরা যদি বোর্ডে প্রথমেই বাংলা সন এবং তারিখ লিখি, তাহলে শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজস্ব সন এবং তারিখের প্রতি আগ্রহ জন্মাতো। শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিজস্ব ভাষা, বর্ষ এবং তারিখ সম্পর্কে অবহিত করা যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবে তার ওপর সেই প্রভাব থেকে যাবে। সে নিজস্ব ভাষা, সন এবং তারিখকে সম্মান জানাতে শিখবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, নিজের ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে অবহেলা করে কোনো জাতিই পৃথিবীতে মর্যাদার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে না।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অনুলিখন: এম এ খালেক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ