প্রথম পর্ব
লুটেরা অর্থনীতির কারণে আমাদের নৈতিক অধঃপতন
রাজনীতির চারণকবিখ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান। সাবেক সংসদ সদস্য, কিশোরগঞ্জ-৩। কিশোরগঞ্জ জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনি। দেশ, মাতা, রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় যে কোনো সংকট-দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে তিনি আবির্ভূত হন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে। সর্বোচ্চ সোচ্চার থাকেন ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আপসহীন এ ব্যক্তিত্ব কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের করনসি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। সম্প্রতি ভিউজ বাংলাদেশের মুখোমুখি হন বরেণ্য এ রাজনীতিবিদ। কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী বাংলাদেশ, রাজনীতি, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানসহ সমসাময়িক বিষয়ে। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভিউজ বাংলাদেশের অ্যাডিটরিয়াল অ্যাসিসটেন্ট শাহাদাত হোসেন তৌহিদ।
ভিউজ বাংলাদেশ: মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হলো, কী পেলাম, কী হারালাম?
ফজলুর রহমান: তিপ্পান্ন বছরে কিছুই হয়নি, এটা বলা ঠিক হবে না। এটা বড় কৃপণতা হবে আমাদের। ভালো-মন্দ অনেক কিছু হয়েছে। আমরা যা ছিলাম না, তা হয়েছে। ছোটবেলায় দেখেছি, তখন আমি পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। আমার বাবা গ্রামের মাতবর, আওয়ামী লীগ করতেন। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ আসলে তিনি পালিয়ে থাকতেন। মাকে জিজ্ঞাসা করতাম, বাবা গেল কই? বলতেন, তোমার নানারবাড়ি গেছেন। পরে বুঝতে পেরেছি আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ এর ভয়ে পালিয়ে থাকতেন, কারণ তিনি আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন।
১৯৫৮ সাল থেকে আমি দেখেছি, মানুষের একটা শার্ট পরতে খুব কষ্ট হতো। নতুন জামাই শশুরবাড়িতে গেলে একজোড়া জুতা গ্রামের অন্য কারও আছে কি না, সেটা খুঁজে নিয়ে সেই জুতাটা হাতে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির কাছে গিয়ে জুতাটা পায়ে লাগাত- এটা ছিল আমাদের অনেকেরই গ্রামীণ অবস্থা। এরপর ছিল শাসন এবং শোষণ। আইয়ুব খান আসার পর থেকে আমি যেটা দেখেছি, কঠিন শাসনের বেড়াজালে বাঙালি জাতি যেভাবে আবদ্ধ হলো এবং এখানে একটা জাতিগত নিপীড়ন শুরু হলো। তারই অংশ হিসেবে দেখা গেল কেউ কোনো কথা বললো না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অনেক নেতার নামে এবডো (ইলেকটিভ বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার) হয়ে গেল। এবডো একটা আইন ছিল, এবডো যার ওপরে হতো সে পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতি করতে পারত না। এই প্রথম আইয়ুবের শাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ উচ্চারণ করল ছাত্ররা। সেই ছাত্র আন্দোলনের নেতা যারা ছিলেন তখন ১৯৬২ সালে আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি, স্কুলের মনিটর আমি। শাহ মোয়াজ্জেম, শেখ ফজলুল হক মনি, রাশেদ খান মেনন, আইয়ুব রেজা চৌধুরী, বদরুদ্দেজা বড় লস্কর, এনায়েতুর রহমান এদের নাম খুব শুনতাম। এরপর ১৯৬৪ সালে ছাত্র আন্দোলন আসলো। সিরাজুল আলম খান, ওবায়দুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, সাইফুদ্দিন মানিক এদের নাম শুনতাম, তখন আমি কলেজে পড়ি। বাবুল-ওয়াজিউল্লাহরা শহীদ হলো।
ভিউজ বাংলাদেশ: মুগ্ধ হয়ে শুনছি আপনার কথা, তারপর?
ফজলুর রহমান: এরপরে ’৬৪-এর ৬ দফা আন্দোলন। মনু মিয়ারা শহীদ হলো। তেজগাঁওয়ে ষাটজন একসঙ্গে শহীদ হলো। আইয়ুব খান ১৯৬৬ সালের ৭ জুন গুলি করে মারল ৬ দফার জন্য। ওই দিন একশ লোক একসঙ্গে শহীদ হলো। এই যে আন্দোলনের গতিপথ, এই গতিপথে আস্তে আস্তে স্লোগান দেয়া শুরু করল আর আইয়ুব খানরা মনে করলো এ দেশে আর থাকতে পারবে না। তারা এ দেশটাকে শাসন এবং শোষণে শোষণে জর্জরিত করল। আমরা ধীরে ধীরে বাঙালিরা আরও গরিব হয়ে গেলাম। তখনই আমরা বুঝতে শিখলাম যে, আমরা মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই বলে যে ’৪৭ করছিলাম’-লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান/ চিড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান/ তুমবে মুসলমান, হামবে মুসলাম। ‘এটা তো হলো না! এখন তো দেখা যাচ্ছে, তারা পাঞ্জাবি- আমরা বাঙালি। তখন ১৯৬৬ সালে স্লোগান উঠলো- ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি।’ এই স্লোগানটা চলে ২ বছর। যখনই বঙ্গবন্ধুর ওপরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলো, ১১ দফা আন্দোলন যখন শুরু হলো তখন স্লোগান উঠল- ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ স্লোগানটা বাংলা ভাষায় কিন্তু এটা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্লোগান মনে করি আমি। কারণ নদীর নামে এ ধরনের স্লোগান কোনো জাতি কোনোদিন দেয় নাই।
তারপর ১৯৬৯, ৭০, ৭১ রক্ত সূর্য উঠছে, বীর বাঙালি জেগেছে। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। তখন আমাদের কী ছিল- একটা শার্ট, একটা প্যান্ট। হলে থাকতে খাইতে পারতাম না গরিব ছিলাম। কোনো বাঙালি কোটিপতি ছিল না। দুজন বাঙালি শুধু কোটিপতি ছিল বলে বলা হতো। এক চট্টগ্রামের এ কে খান, আরেকজন ময়মনসিংহের জহরুল ইসলাম। আর কি! ৫ কোটি টাকার মালিক নাকি তারা ছিল। সবাই বলতো ৫ কোটি টাকার মালিক জহরুল ইসলাম।
ভিউজ বাংলাদেশ: স্বাধীনতার পর কি হলো?
ফজলুর রহমান: যুদ্ধ করলাম দেশ স্বাধীন হলো। লুট হয়েছে, ব্যাংক লুট হয়েছে, বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে। ২২ পরিবার চলে গেছে। আজকে যদি পাকিস্তান থাকত তাহলে গুলিস্তানের রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখতাম- কে যায়রে? আদমজীর নাতি যায়। কি তার নাম? তার নাম রাহাত খান। তার গাড়ি, আরেহ বাবা! আদমজীর নাতির গাড়ি দেখতাম, ইস্পাহানির গাড়ি দেখতাম। বাওয়ালিদের গাড়ি দেখতাম। এখন তো এটা আমাদের দেখতে হয় না। এখন তো বাঙালি ছেলের গাড়ি দেখি, হোক সে গণবিরোধী, গাড়িটা তো বাঙালির ছেলের। ব্যাংকটা তো বাঙালিদের। হাজার কোটি টাকা তো বাঙালিদের হয়েছে। লুটপাট হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। ১৯৭২ সালে সাড়ে সাতশ কোটি টাকার বাজেট ছিল। তাজউদ্দিন আহমেদ অর্থমন্ত্রী হিসেবে যে বাজেট পেশ করেন, তখন বাজেট ছিল সাড়ে চারশ কোটি টাকা। এখন, গত বছর বাজেট হয়েছে সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকা- প্রার্থক্যটা বুঝেন। কাজেই স্বাধীনতা হয়ে কিছুই হয় নাই এটা বলা ঠিক হবে না।
বাঙালির ছেলে কর্নেলের কেউ ওপরে ছিল না। উসমানির মতো ব্রিলিয়ান্ট অফিসার অব দ্য ওয়াল্ড; দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্বর্ণপদক পাওয়া ব্রিটিশের সৈনিক মেজর ওসমানিকে ব্রিটিশ জেনারেল মন্টগোমারি বলেছিল - ‘দিস বয় ওয়ান সি ইউল বি দ্য জেনারেল অব ইন্ডিয়া।
‘ইন্ডিয়া ভেঙে পাকিস্তান হলো; কিন্তু বাঙালির ছেলে কর্নেলের ওপরে হতে পারল না। কিন্তু আজকে বাঙালির ছেলে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শত শত জেনারেল নামই মনে রাখতে পারি না। অথচ কোনো বাঙালির ছেলে কিন্তু মেজর জেনারেল ছিল না। অতএব; যুদ্ধ আমাদের বাঙালির ছেলেদের মেজর জেনারেল বানিয়েছে। বাঙালির একমাত্র সন্তান পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের লিংক ছিল তিনি জেনারেল হয়েছিলে, তার নাম শফিউল আজম। সে ছিল তখন বাঙালি একজন সেক্রেটারি। কোনো বাঙালির ছেলে ডেপুটি সেক্রেটারির ওপরে ছিল না। এখন শত শত সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, ফরেন সেক্রেটারি এই সেক্রেটারি ওই সেক্রেটারি, পায় নাই কে? এখন পাকিস্তান-ইন্ডিয়ার সঙ্গে সমানে সমানে বসে আমার সেক্রেটারি এবং তার সেক্রেটারি।
তখন ১৯টা জেলা ছিল যখন আমরা যুদ্ধ করি। ১৯ জেলার মধ্যে ৯টা জেলার ডিসি ছিল অবাঙালি। এসডিও যে কত অবাঙালি ছিল এটার কোনো ঠিকানা ছিল না। জিজ্ঞেস করতাম, বাড়ি কোথায়? সীমান্ত প্রদেশে। বাড়ি কোথায়? লান্ডিকোটাল। বাড়ি কোথায়? রাওয়ালপিন্ডি। এখন যে শতকরা শতভাগ বাঙালির ছেলে এসডিও, ডিসি, ইউএনও, ডেপুটি সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, এডিশনাল সেক্রটারি, মুখ্য সেক্রেটারি- মুক্তিযুদ্ধ তো বাঙালিকে এটা দিয়েছে। কাজেই কিছুই পাই নাই, এটা বলা ঠিক হবে না। একটা বাঙালির ছেলে বাইরে যেতে হলে পাসপোর্ট করতে হতো লাহোর পিন্ডি অথবা ইসলামাবাদে গিয়ে। এখন বাঙালির প্রায় ১ কোটি মানুষ সারা পৃথিবীতে থাকে। অনুদান হিসেবে কত হাজার হাজার কোটি ডলার পাঠায় প্রতি মাসে। আমাদের দেশে এদের কোনো ঠিকানা নাই। পৃথিবীর যেখানে যাবেন, বাঙালি নাই পাবেন না। কাজেই স্বাধীনতা আমাদের কিছুই দেয় নাই এটা বলাটা বড় নেতিবাচক কথা। হ্যাঁ, যতটুকু দেয়ার দরকার ছিল ওতটুকু আমরা পাই নাই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অধঃপতন হয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলো আরও উন্নত হওয়ার দরকার ছিল। আমাদের রিচার্স আরও বেশি হওয়ার দরকার ছিল। আমাদের বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড এর চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার দরকার ছিল, সেটা আমরা পাই নাই। আরও অনেক উপরে ওঠার দরকার ছিল, সেটা হয়নি।
ভিউজ বাংলাদেশ: সততা-দেশপ্রেমের অধঃপতন হলো কেন?
ফজলুর রহমান: পাকিস্তান আমলে না খেয়ে থেকেও আমাদের যে সততা ছিল, সেই সততাটা আমাদের নষ্ট হয়েছে, কেন জানেন? ফর লুম্পেন ইকোনমি। লুটেরা অর্থনীতির কারণে আমাদের স্বভাবটা নষ্ট হয়েছে। আমরা সবাই অর্থ-বিত্তের পেছনে ছুটি। কেউ পাই কেউ পাই না, কেউ আশায় থাকি কেউ ব্যর্থ হই। ব্যর্থ যে হই সে মুখ লুকাইয়া বাঁচি। সফল হই যারা, দেশকে ভালো না বেসে বেগম বাড়ি বানাই। মালয়েশিয়াতে সেকেন্ড হোম করি। টাকাটাকে লুটপাট করে সিঙ্গাপুরে বাড়ি কিনি। দেশপ্রেমটা আমাদের যেন কমে গেছে। দেশপ্রেম কমার পেছনে আছে লোভ আর লোভের পেছনে আছে অর্থনীতি, যাকে বলা হয় লুম্পেন ইকোনমি। সেই লুম্পেন ইকোনমিটা এসে এক সময় সেটেল হবে। এখন না হোক ২০-৩০ বছর পরে লুম্পেন ইকোনমি সেটেল হবে তখন বাঙালির সন্তানরা ইন্ডাসট্রিয়ালিস্ট হবে। তখন বাঙালির ছেলেরা রিয়েল ক্যাপিটালিস্ট হবে। তখন বাংলায় সত্য এবং সঠিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেবে ১ নম্বর হিসেবে। সততার মধ্য দিয়ে- এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী।
ভিউজ বাংলাদেশ: রাজনৈতিক সততাও তো হারিয়ে গেছে প্রায়!
ফজলুর রহমান: হ্যাঁ, সেটাই বলছি। সারা পৃথিবীতে রাজনৈতিক যে অসততা, খারাপ মানুষের নেতৃত্বে যে রাজনীতি। আমেরিকা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ট্রাম্প থেকে পুতিন, পুতিন থেকে লি খছিয়াং। আরও অনেকে আছে আমাদের আশপাশে, সবার নাম নাইবা বললাম। অর্থাৎ, দ্য গ্রেট অব দ্য লিডারশিপ নিচে নেমে গেছে। আগের সেই ন্যালসেন ম্যান্ডেলা নাই, ইয়াসিন আরাফাতও নাই। আগের সেই নেতৃত্ব গান্ধীও নাই, মিশরের নাসের নাই, ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোও নাই, জওহরলাল নেহেরু নাই-বুঝতে হবে কিন্তু। লিডারশিপের যে মান, মানটা কমে গেছে। যে কারণে আমাদের দেশে যে জিনিসটা হচ্ছে শুধু ক্ষমতার প্রাপ্তি। কারণ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে পরে অর্থনীতি আমার ভাগ্যে আসে। সেই কারণে আমার দেশে আজকে খারাপ কাজগুলো হচ্ছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এ বিশাল গণবিস্ফোরণের কারণ কী?
ফজলুর রহমান: আওয়ামী লীগ একসময় মানুষকে বলছিল পেটে ভাত দিবে, পরনে কাপড় দিবে, সোনার বাংলা স্বাধীন করবে, সেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গত ১৫ বছর যে বাজে কাজ হয়েছে, বাজে কাজগুলো চোখের পানিতে মুছবে না। কারণ মানুষের ভেতরে ছিল আগুন। মানুষ যে শেখ হাসিনাকে এভাবে ফেলে দিছে, কে নেতা কে নেতৃত্ব, কি কর্মসূচি কিছুই দেখে নাই। এর কারণ হলো মানুষ মনে করছে শেখ হাসিনা তিনটা নির্বাচনে আমাকে বঞ্চিত করছে। ৩৪ বছরের যুবক আমি আমার জীবনে একটা ভোট দিতে পারিনি। ২০১৪ সালের ইলেকশান ১৫৩টা এমপি বিনা ভোটে পাস করিয়েছে। ২০১৮ সালের ইলেকশন নিশিরাতে হয়েছে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। সকালে ফুলের মালা দিয়ে হেঁটেছে পুলিশ স্যালুট দিয়েছে। ২০২৪ সালের ইলেকশন আমি আর ডামির ইলেকশন হয়েছে, সেই জিনিসগুলো মানুষ মানতে পারেনি। চোখের সামনে যে আওয়ামী লীগ নেতার খাওয়ার ১০ টাকা ছিল না তার ১ হাজার কোটি টাকা। যে সালমান রহমানের পিতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল, যে কর্নেল ফারুক খান, যে এস আলমরা এই দেশের সবচেয়ে সর্বনাশ করেছে, তাদের বন্ধু বানিয়ে শেখ হাসিনা লুট করার সুযোগ দিয়েছে। লক্ষ কোটি টাকা লুট করে দেশ থেকে বিদেশে নিয়েছে। রাজনীতির নামে আওয়ামী লীগের হাইব্রিডরা দেশটাকে লুট করছে।
মানুষ চোখের সামনে দেখেছে- তার পেটে ভাত নাই, পরনে কাপড় নাই। বিএ-এমএ পাস করে ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হয়ে হাজার হাজার ছেলে-পেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে কর্মসংস্থান পায়নি- এই যে মানুষের পেটে আগুন। পেটের আগুন চোখে গেছে। মাথায় আগুন ধরছে তখন মনে করছে আজরাইলও যদি আসে হাসিনাকে আমরা তাড়িয়ে দিব। প্রয়োজনে হাসিনা গেলে আজরাইল আসুক। বঙ্গবন্ধুর কন্যা এটা মানুষ দেখেনি। তারই পরিণতি হলো ৫ আগস্ট ২০২৪। রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। সেই পরিণতিতে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা চলে গেল। ৫, ৬, ৭ তিন দিন সারা বাংলায় কোনো সরকার ছিল না। মানুষ অপেক্ষা করছে কে দিবে আমাদের নেতৃত্ব। তখন সামনে আসলো একটি নাম। সেই নামটি আমরা মনে করি বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠসন্তান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অধ্যাপক ইউনূসের নামটা আমরা সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করলাম একটা লোকও বিরোধিতা করিনি। আমরা মনে করলাম ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের মাধ্যমে আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে। সাত মাস চলে গেল এখন আস্তে আস্তে মানুষ বলে- ‘এক বউ ছাড়লাম আমি চাল চাবানোর ডরে/ এখন দেখি আরেক বউ ধানে চাইলে গিলে।’ তার নাম হলো ইউনূসের সরকার।
ভিউজ বাংলাদেশ: মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা কত? ৩০ লাখ না ৩ লাখ?
ফজলুর রহমান: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ৩ কোটি মানুষ মারা গেছে, কে গুনেছে? কিন্তু বলা হয় ৩ কোটি। ৩ কোটি একজন বলে না কিন্তু বা দুই কোটি ৯৯ লক্ষ ৯৯ হাজার ৯৯৯ বলে না। ঠিক ৩ কোটি মারা গেছে বলে। এটা কে গুনেছে? ছোটবেলায় পুঁথি পরেননি -‘লাখে লাখে মরে সৈন্য কাতারে কাতার শুমার করিয়া দেখি পঞ্চাশ হাজার।’ এই সংখ্যাটা হলো প্রতীকী সংখ্যা। এটাকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত না তো। মানুষের অভিমতের মধ্য দিয়ে যে জিনিসটা বেরিয়ে এসে পড়ে- ‘৩০ লাখ লোকের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৩ কোটি লোক মৃত্যুবরণ করছে। এটা প্রতীকী সংখ্যা, চ্যালেঞ্জের সংখ্যা না। এটা ৩০ লাখ নাকি উনত্রিশ লাখ পাঁচশ পঁচানব্বই বা ৩ লাখ এটা যারা বিতর্ক করে তাদের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা কম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবয়বটা এত উপরে ৩০ লাখ একবার যে প্রতীকী চিহ্ন প্রতীকী হয়ে আসছে, এটা কমবেশি করলে বাংলাদেশ ছোট হয়ে যায়। কাজেই মরছে কি না গুনে দেখুক। গুনবনে ভবিষ্যতে জ্ঞানী-গুণী মানুষ যারা। আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি জানি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেছে। এটা প্রতীকী সংখ্যা এটাকে আমি ছোট করতে পারব না। এই যে আমরা বলি, হাজার হাজার গুলি আমার মাথার ওপর দিয়ে গেছে। আসলে কি আমি গুনেছি কত হাজার গুলি গেছে। বলি কেন? এটা একটা প্রতীকী শব্দ। আমি যখন বাঙ্কারে থেকে যুদ্ধ করেছি পাক বাহিনীর হাজার হাজার গুলি আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে আমি মরিনি- এটার অর্থটা কি? আমি মিথ্যা বলছি? না। এটা প্রতীকী কথা বলতেছি। বুঝতে হবে। মুক্তিযুদ্ধটা যেমন মহান সংখ্যাটা তত বড়।
ভিউজ বাংলাদেশ: আ’লীগের দাবি, তারাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল, আসলে তাই? আপনার ব্যাখ্যা কি?
ফজলুর রহমান: ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ভোটটা আপনি কাউন্ট করুন যেটা ম্যামবার অব ন্যাশনাল অ্যসেম্বলি (এমএনএ) ভোট। আমি তখন এমএ পড়ি। তখন আমি কিশোরগঞ্জ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের আহ্বায়ক। আমি শাহজাহান সিরাজের রুমমেট। এখান থেকে আমি ইলেকশন করতে গিয়েছি। ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ভোট। ১৭ ডিসেম্বর হলো প্রভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলি ভোট পূর্ব পাকিস্তানের ভোট। সেখানে কাস্টিং ভোটের একাত্তর শতাংশ ভোট পেল আওয়ামী লীগ একা। ৬ শতাংশ ভোট জামায়াত পেল। মুসলিম লীগ, পিডিপি আরও অন্যান্য দল মিলে সর্বমোট ১৫ শতাংশ ভোট পেল। বামপন্থিরা চার শতাংশ ভোট পেল। তাহলে কি হলো? আওয়ামী লীগ একা পেল ৭১ শতাংশ। এখন আওয়ামী লীগ যদি যুদ্ধের ডাক দেয়, তাহলে তার পক্ষে কত মানুষ আছে? ৭১ শতাংশ আছে। জিনিসটা বুঝতে পারছেন?
বাকি ২৯ এর মধ্যে বামরা ছিল টোটাল ৪ শতাংশ। কারণ মাওলানা ভাসানী সাহেব তো ইলেকশেন যায়নি, সেটা ভিন্ন কথা; কিন্তু তারও একটা সমর্থন ছিল। ধরুন ৭ শতাংশ ভোট ছিল বামদের। ভাসানী ন্যাপ, মুজাফফর ন্যাপ অন্যান্য কিছু ছোটখাটো দল ছিল স্বতন্ত্র- এদের ছিল ৭ শতাংশ ভোট। তাহলে ৭ আর ৭১ মিলে মোট ৭৮ শতাংশ। অর্থাৎ ৮০ শতাংশ লোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। আর মুসলিম লীগ, পিডিপি, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ এই পাঁচটা দল যুদ্ধে যায়নি। তবে সবাই যুদ্ধের বিরোধী ছিল না। মুসলিম লীগের অনেক মানুষ ঘরে বসে রয়েছে। মনে মনে যুদ্ধ সমর্থন করেছে। এটা খুব ভালো করে ধরবেন কিন্তু। আমার কথা মিথ্যা হবে কি না জানি না, যে কোনো লোক আপত্তি করতে পারে। আমার সামনাসামনি এসে তর্ক করতে পারে আমি তাকে স্যালুট দিব।
আবার মুসলিম লীগের সব লোক যুদ্ধের বিরোধী, এটা ঠিক না। অনেক মানুষ ঘরে বসে বসে পাকিস্তানিকে অভিশাপ দিয়েছে কিন্তু যুদ্ধে যায়নি। আবার মুসলিম লীগের অনেক ছেলেরা যুদ্ধে গিয়েছে, যারা ৭০ এ নৌকা মার্কায় ভোট দেয়নি কিন্তু যুদ্ধের সময় সেই ছেলেটি আবার যুদ্ধে গেছে। কাজেই সামান্য কিছু লোক আল বদর রাজাকার আল শামস আর দালাল ছাড়া সব মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সক্রিয় এবং নিস্ক্রিয়ভাবে পক্ষে ছিল। সেখানেই আওয়ামী লীগ যদি দাবি করে তারা একাই যুদ্ধ করেছে, সঠিক হবে না।
বলতে হবে- হ্যাঁ, যুদ্ধের মেইন পার্ট আওয়ামী লীগ আমরা প্লে করেছি। কিন্তু সারা বাংলাদেশের মানুষ আমাদের সঙ্গে ছিল। মওলানা ভাসানী, মুজাফফর আহমেদ, কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর, কমিউনিস্ট পার্টির মনি সিংহ থেকে শুরু করে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে যারা রাজনীতি করেছে, তাদের অনেকেই যুদ্ধ করেছে। কাজেই বলতে হবে, আমরা সামগ্রিকভাবে সবাইকে নিয়েই আমরা যুদ্ধটা করেছি। এককভাবে শুধু একা আওয়ামী লীগ যুদ্ধ করেছে, এটা বলা ঠিক হবে না। তবে যুদ্ধের প্রাপ্যটা তো টোটাল ব্যাপারটা তাদের। কারণ আওয়ামী লীগের হলো মহিলাসহ ১৬৭ জন এমএনএ। আর তিনশ এমপির মধ্যে ২৯২ জন আওয়ামী লীগের। অন্য যে স্বতন্ত্র সব যুদ্ধে জয়েন করছে জামায়াতের দুজন এমপি বাদে। দুজন বাদে সব যোগদান করছে হয়তবা আওয়ামী লীগের কোনো কোনো এমএনএ যুদ্ধে চুপচাপ ছিল অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে জান বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, যারা ধরা পড়ে গিয়েছিল। এর বাইরে সবাই মিলেই আমরা যুদ্ধটা করেছি। কথাগুলো খুব বুঝার চেষ্টা করবেন।
(চলবে)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে