Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান সমুদ্রদূষণে হুমকিতে মানবজীবন ও জীববৈচিত্র্য

Munaseeb Hossain

মুনাসিব হোসেন

মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

বর্জনা এবং প্লাস্টিকসহ কঠিন শিল্পবর্জ্যে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, যা উদ্বেগজনক। এই সমুদ্রদূষণকে মানবজাতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। মাত্রাতিরিক্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং তা সমুদ্রে ফেলে দেয়ায় ক্রমবর্ধমানভাবে পরিবেশদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে দেশগুলোর নাগরিকদের, সেই সঙ্গে বিশ্ববাসীকেও। সমুদ্রদূষণ এখন বিশ্বজুড়ে ভূমি এবং জলভাগের বৃহত্তম পরিবেশগত সমস্যা।

ভালো বর্জ্য সংগ্রহ এবং পরিচালনা ব্যবস্থার অভাবে বর্জ্য জমে সামুদ্রিক জীবন, বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশে গুরুতর, অপরিবর্তনীয় নেতিবাচক প্রভাব তৈরির পাশাপাশি ডেকে আনছে মারাত্মক পরিণতিও। এর মধ্যে প্লাস্টিকে সৃষ্ট সমুদ্রদূষণই এখন পুরো মানবজাতির সাধারণ উদ্বেগ এবং অদক্ষ অর্থনীতির স্পষ্ট প্রতীক। প্লাস্টিক বর্জ্যের আধিক্য শুধু সৈকতকেই দূষিত করছে না, সুনীল অর্থনীতিতে পুরো গ্রহকে বদলে দেয়ার বদলে বিশাল ক্ষতি করছে আমাদের সম্পদ ও পরিবেশেরও। এ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে বাস্তবায়নাধীন ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) কমপক্ষে চারটিই সামুদ্রিক আবর্জনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং এর লক্ষ্য ১৪ দশমিক ১ হচ্ছে সামুদ্রিক ধ্বংসাবশেষসহ স্থলভিত্তিক কার্যক্রমে উৎসারিত সমুদ্রদূষণ প্রতিরোধ ও হ্রাস।

শ্রীলঙ্কা, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী দেশগুলোর বাসিন্দা ১৫০ কোটিরও বেশি, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ। তাদের মধ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষই বাস করেন উপকূলে, যাদের বেশিরভাগই আংশিক বা পুরোপুরি মৎস্যচাষে নির্ভরশীল। জ্বালানি ও খনিজসহ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই বঙ্গোপসাগর দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মূল্যবান সম্পদও। উচ্চ জীববৈচিত্র্যের এই অঞ্চলটি সুবিশাল সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র (এলএমই), প্রবাল প্রাচীর (বিশ্বের প্রবাল প্রাচীরের আট শতাংশ) ম্যানগ্রোভ ট্র্যাক্ট ও সামুদ্রিক ঘাসের বিছানাসহ বিপুলসংখ্যক বিপন্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রজাতির বিস্তৃত আবাসস্থলও।

অন্য বড় জলাশয়গুলোর মতোই বঙ্গোপসাগরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্লাস্টিক বর্জ্য। এগুলো প্রচুর পরিমাণে মিলছে সমুদ্রের তটরেখা ও তলদেশে, ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছে জলের স্তম্ভেও। এমনকি বড় আকারের মাছ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদেহেও প্লাস্টিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। ছোট মাছ মনে করে অজান্তেই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলায় এদের পাচনতন্ত্র থেকে প্লাস্টিকের নির্গমণ হচ্ছে না। ফলে প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ শরীরে থেকে গিয়ে ‘ভরা পেট’ অনুভূতিতে অনাহারেই মারা যাচ্ছে।

সারা বিশ্বের হাজার হাজার উৎস থেকে প্রতিদিন সমুদ্রে প্লাস্টিক লিক হচ্ছে। ছবি: গেটি ইমেজেস

বঙ্গোপসাগর এখন দক্ষিণ এশিয়ার মারাত্মক আবর্জনা, প্লাস্টিক ও অন্য কঠিন বর্জ্যগুলোর হটস্পট এবং চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরের চেয়েও বেশি দূষিত। এ জন্য বেশি দায়ী আঞ্চলিক দেশগুলোর জনসংখ্যার চাপ, দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং খারাপ ডিজাইনের প্লাস্টিক পণ্যগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার বর্জ্যগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত মহাসাগরে শেষ হয়, যেগুলোর বেশিরভাগই সমুদ্রে গিয়ে মেশে দুটি প্রধান নদীপথ সিন্ধু এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা দিয়ে।

দূষিত সি-ফুড গ্রহণে মানবস্বাস্থ্যে মারাত্মক পরিণতি উপলদ্ধি করে সমুদ্রদূষণকে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে ১৯৫০ সাল থেকে। বৈশ্বিক জরিপ বলছে, মহাসাগরীয় আবাসস্থলগুলো দূষণকারী উপাদানগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে ভারী ধাতু এবং এর অবশেষ। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে বড় আকারের নগরায়ন, শিল্পায়ন ও কল-কারখানার বিস্তার এবং কৃষিবিপ্লবের পরেই সামুদ্রিক পরিবেশে এই দূষণকারীদের প্রভাব বেড়েই চলেছে। খনন, পেট্রোকেমিক্যাল প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিদ্যুতায়নসহ নৃতাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপে তৈরি ভারী ধাতু এবং ধাতব পদার্থসহ শিল্প ও পৌরবর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে নিঃসৃত বা মোহনা হয়ে বৃহত্তর জলজ ব্যবস্থায় পরিবাহিত হচ্ছে।

বিশেষত, ভারী ধাতুগুলোর শিল্পবর্জ্য উপকূলীয় সিক্ত শিলাস্তর হয়ে শেষ পর্যন্ত সাগরজলে মিশে যাচ্ছে, যা বিশ্বজুড়ে মারাত্মক উদ্বেগ তৈরি করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে আনুমানিক ৩৩৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৮০ শতাংশই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে শেষ হয়। এই বর্জ্যের ১২ শতাংশই প্লাস্টিক এবং ব্যাপক দূষিত বড় নদীগুলো সমুদ্রপথে পরিচালিত করে। সমস্যাটি বুঝতে পেরে নিজ নিজ সমুদ্রসীমা ও সৈকত পরিষ্কারের চেষ্টাও চালাচ্ছে দেশগুলো। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশ একত্রিত হয়ে গঠন করেছে ‘প্লাস্টিকমুক্ত নদী ও সমুদ্রবিষয়ক দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংস্থা বা এসএসিইপি’।

তিনটি উপাদান পদ্ধতিতে সংস্থাটির মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় প্লাস্টিক দূষণ সংস্কারের আঞ্চলিক প্রকল্পে সহযোগিতা করছে বিশ্বব্যাংকও। এর প্রথম উপাদানটিই হলো প্লাস্টিকবর্জ্য হ্রাসে প্রতিযোগিতামূলক ব্লক অনুদান বিনিয়োগ এবং সমুদ্রের দিকে পরিচালিত প্লাস্টিক নির্মূলে সার্কুলার প্লাস্টিক ইকোনমি বা বৃত্তাকার প্লাস্টিক অর্থনীতির সমাধানগুলোকে সমর্থন। এই অর্থনীতি হচ্ছে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারের ধারণা, বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য পিপিই।
সামুদ্রিক দূষণের মধ্যে প্রধানত প্লাস্টিক, ড্যানেজ, প্যাকিং উপাদান, পরিষ্কারের উপাদান, ন্যাকড়া, কাগজের পণ্য, খাদ্য বর্জ্য, রঙের অবশিষ্টাংশ, দ্রাবক এবং রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। ছবি: কনস্টেলেশন মেরিন সার্ভিসেস

বঙ্গোপসাগরের দেশগুলোকে ব্যক্তি ও সমষ্টিগতভাবে নিজেদেরই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এ বাস্তবতা থেকে মাত্রাতিরিক্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার এবং এর সমুদ্রে ফেলে দেয়ার বিপদগুলো রয়েছে দেশগুলোর শীর্ষ এজেন্ডায়ও। যেমন, বাংলাদেশে ২০১৩ সাল থেকে ‘প্রজেক্ট অ্যাওয়ারনেস’ এবং ‘ফাইটিং মেরিন ডেবরেট’ কর্মসূচির আওতায় সেন্টমার্টিন দ্বীপের সামুদ্রিক ধ্বংসাবশেষ জরিপ ও অপসারণে নিয়োজিত ডুবুরি ও স্বেচ্ছাসেবকরা। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা এ ধরনের ১ হাজার ৪৮টি বস্তু অপসারণ করেন, যার ৯০ দশমিক ৩১ শতাংশই প্লাস্টিকের। তবে মহাসাগর পরিষ্কারও সমুদ্রদূষণ নির্মূলের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি নয়।

সমাধানটি হলো সমস্যাটিকে তার উৎসেই মোকাবিলা করা। শিল্প, বেসরকারি সংস্থা এবং অন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় সমুদ্রে প্লাস্টিকের ডাম্পিং হ্রাসের মূল স্টেকহোল্ডার জেলে এবং উপকূলীয় সম্প্রদায়ের মাঝে সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে এটি অর্জিত হতে পারে। বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) এক্ষেত্রে উপযুক্ত আঞ্চলিক সংস্থা, যেটির নেতৃত্বে প্লাস্টিকের আবর্জনা দূষণকে অগ্রাধিকার দিতে পারে বিশ্ব সম্প্রদায়। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী দেশগুলোকেও জাতীয় পর্যায়ে বৃত্তাকার অর্থনৈতিক পদ্ধতি চালু এবং জলাশয় থেকে প্লাস্টিকের আবর্জনা সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহার এবং বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেজিংয়ের ব্যবহারকে উত্সাহিত করতে হবে। এ পদ্ধতিতে সমুদ্রবর্জ্য প্রতিরোধ এবং উপকরণ ও পণ্যগুলোর পুনর্ব্যবহারই হচ্ছে সমুদ্রদূষণ সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান। সর্বোপরি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক কার্যক্রমগুলোর সমন্বিত পর্যবেক্ষণ, উদ্ভাবন এবং উন্নতির ক্রমাগত পর্যালোচনাসহ সময়োপযোগী পদ্ধতিতে সমাধান করা দরকার।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ