কমছে বন্যার পানি, বাড়ছে রোগের প্রকোপ
ভারত থেকে নেমে আসা উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। ভেসে উঠছে চিরচেনা জনপদ, ঘরবাড়ি। আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে বাড়ি ফিরছেন বন্যাকবলিতরা। তবে বাড়ি ফিরে হতাশ হচ্ছেন তারা। কারণ কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। প্রবল বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব। এ অবস্থায় ক্ষতি পুষিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবছেন কুমিল্লা, ফেনী ও নোয়াখালী অঞ্চলের বন্যাকবলিত কয়েক লাখ মানুষ।
এদিকে সুপেয় পানির অভাব, অপর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ, স্যানিটেশন ব্যবস্থা না থাকায় ডায়েরিয়া, চর্মরোগসহ পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে।
বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন জায়গায় পানি কমতে শুরু করেছে। বৃষ্টি নেই, দেখা মিলছে রোদেরও। এ অবস্থায় আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরছেন অনেকেই। তবে সাজানো সংসার বানের জলে ভেসে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন তারা।
এমনই একজন নোয়াখালীর ২নং দাদপুর ইউনিয়নের করিম মুন্সি। ৯ দিন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার পর বাড়ি ফিরে দেখেন তার সবকিছু ভেসে গেছে বন্যার পানিতে। দ্রুত পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় স্ত্রী-সন্তানসহ ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে ‘এক কাপড়ে’ আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন তিনি।
করিম মুন্সি বলেন, বাসার সব ফার্নিচার নষ্ট হয়ে গেছে। জরুরি কিছু কাগজ সঙ্গে নেয়াতে রক্ষা পেয়েছে। তবে আলমারির কাপড়-চোপড়, বিছানা-বালিশ, বই-খাতা সব ভেসে গেছে। ঘরে হাঁড়ি-পাতিল, চুলা কিছুই নেই। টয়লেটটিও ভেসে গেছে।
তিনি বলেন, টিউবওয়েলের ওপর পানি উঠেছিল। আপাতত এই পানিও খাওয়া নিরাপদ নয়। আবার শুরু থেকে সব শুরু করতে হবে।
নোয়াখালী জেলার বেশিরভাগ নিচু এলাকার কয়েক লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি। কোথাও কোথাও ঘরবাড়িতে কোমরসমান পানি। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। বিভিন্ন উপজেলায় সড়কের পাশের ঘরবাড়িগুলো এখনো পানির নিচে। প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ শহরের অনেক এলাকায়ও ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা। ছড়িয়ে পড়েছে ময়লা-আবর্জনা। এতে করে দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত নানা রোগ।
নোয়াখালীর মাইজদী শহরের কৃষ্ণরামপুর এলাকার আবেদ আলী বলেন, বন্যার প্রথম ধাক্কাতেই আমার ঘরে পানি ওঠে। কোনোমতে পাশের এক দোতলা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। পানি কমলেও ওই বাড়িতে থাকার মতো অবস্থা নেই। ঘরের ছাদ আর দেয়াল ছাড়া কিছুই নেই।
এদিকে ফেনী ও নোয়াখালীতে গত তিন দিন কোনো বৃষ্টিপাত না হলেও এখনো সেখানকার জনপদ, বিশেষ করে নোয়াখালী সদরের কিছু এলাকা এবং ফেনীর বেশ কিছু জায়গা পানিতে ডুবে আছে। নোয়াখালী শহরের আশপাশের কিছু এলাকায় পানি সম্পূর্ণ নেমে গেলেও বসবাসের উপযোগী হয়নি।
জেলা সড়কের অধিকাংশ স্থানের কংক্রিট প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে। অটোরিকশা চলার মতো অবস্থাও নেই। গ্রামের ভিতরের অলিগলি ও কাঁচা সড়কের অবস্থা আরও খারাপ।
ফেনী, নোয়াখালী সদর ও বেগমগঞ্জ এলাকার বন্যাপীড়িত অনেক গ্রাম এখনো কার্যত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। স্বেচ্ছাসেবীদের কোনো যানও সেখানে ঢুকতে পারছে না।
বেগমগঞ্জের ছোয়ানী এলাকার ঈমাম উদ্দিন বলেন, রাস্তাঘাট একদম ব্যবহার উপযোগী নেই। তারমধ্যে সন্ধ্যা হলে রাস্তায় চলতে ভয় হয়। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতাও রয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বানভাসিদের জন্য এক টন চাল এলেও তা স্থানীয় চেয়ারম্যান ‘মেরে’ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ঈমাম উদ্দিন। তিনি বলেন, চেয়ারম্যানের চাল চুরি নিয়ে এলাকায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
বন্যায় ছোট-বড় সড়কগুলো বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে জানিয়ে সেগুলো মেরামতে সরকারি, বেসরকারি প্রতিটি পর্যায় থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সদর উপজেলার চরমটুয়া ইউনিয়নের বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনো পানিবন্দি থাকায় বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে নানা ধরনের সংকট। বিশেষ করে টিউবওয়েলগুলো ডুবে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। রান্না করা খাবারের সংকটও আছে। এ ছাড়াও চর্মরোগ, ডায়েরিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে।
চরমটুয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা কামাল উদ্দিন বলেন, পুরো ইউনিয়নের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। প্রত্যন্ত এলাকায় খাদ্য সহায়তা যাচ্ছে না।
জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার আটটি উপজেলা বন্যাকবলিত। এসব এলাকায় পানি কমছে। বৃষ্টি না হওয়ায় ও তিন দিন ধরে রোদ থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। জেলাজুড়ে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় দুর্গম এলাকাগুলোতে যথাযথভাবে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। জেলায় বাড়ছে ডায়েরিয়া ও সাপেকাটা রোগীর সংখ্যা।
কাদির হানিফ ইউনিয়নের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং সেপটিক ট্যাংকের ময়লা-আবর্জনা পানিতে ছড়িয়ে পড়ায় ডায়েরিয়া, চর্মরোগসহ নানা পানিবাহিত রোগে ভুগছে অনেকেই। যারাই বন্যার পানিতে চলাচল করছেন, তাদের প্রায় সবারই চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।
সেনবাগ উপজেলার মোরশেদ রহমান বলেন, পানি কিছুটা কমছে। তবে বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছে। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বন্যার্তরা।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যাকবলিত এলাকায় এখন চর্মরোগ, ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি প্রশাসনকে পানিবাহিত রোগ মোকাবিলায় কাজ করতে হবে।
নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, ডায়েরিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চর্মরোগীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ডায়েরিয়ার প্রকোপ যাতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্য আমরা বন্যাকবলিত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইন সরবরাহ করছি। চর্মরোগের চিকিৎসার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। আক্রান্তদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে সেবা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, গত ১২ ঘণ্টায় সদর উপজেলায় এক সেন্টিমিটার পানি কমেছে। বেগমগঞ্জ উপজেলায় তিন সেন্টিমিটার পানি কমেছে। অন্যান্য উপজেলায়ও পানি কমছে।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, নোয়াখালী জেলায় পানিবন্দি প্রায় ২২ লাখ মানুষ। সরকারিভাবে খোলা হয়েছে ১ হাজার ৩৮৯টি আশ্রয়কেন্দ্র। ২ লাখ ৫৯ হাজার জন মানুষ এসব আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। সরকারি ত্রাণ সহায়তা হিসেবে এ পর্যন্ত ১৭১৮ মেট্রিক টন চাল, ৪৫ লাখ টাকা, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ৫ লাখ টাকার গো খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে