আবার সাফ মুকুট জয়
পুরুষ ফুটবল হতাশ করলেও নারীদের বিজয় ক্রমাগত
এ যেন বিয়েবাড়ি- মহা ধুমধাম, উৎসব-আনন্দ। শেষটা বিষাদের- কন্যা সম্প্রদানের সময়কার বুকফাটা আর্তনাদের! সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের পর্দা নামার পর চিত্রটা নেপাল এবং বাংলাদেশ দুই শিবিরের সঙ্গেই মিলে গেছে!
ঘরের মাঠে নেপাল নেমেছিল অধরা সাফ মুকুট জয়ের স্বপ্ন নিয়ে। ১৫ হাজার ধারণক্ষমতার দশরথ রঙ্গশালায় দর্শক উপস্থিতি নির্ধারিত আসনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ম্যাচ শুরুর আগেই। গ্যালারিতে জায়গা না পেয়ে স্টেডিয়ামের বাইরেও ছিলেন ফুটবলামোদিরা। স্বপ্নের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল শেষে আর্তনাদ করলেন স্বাগতিক দর্শক! অন্যদিকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে শিরোপা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে সফল পিটার বাটলার। দলের শিরোপা উৎসব চলাকালেই বাংলাদেশ দলের ব্রিটিশ কোচ জানিয়ে দিলেন- এটাই ছিল নারী দলের প্রধান কোচ হিসেবে আমার শেষ ম্যাচ! উৎসবের রঙের মাঝেই বাজল বিষাদের সুর! বাটলার চ্যাম্পিয়ন দলের সঙ্গে আদৌ থাকেন কি না- সেটা সময়ই বলবে। আপাতত বিষাদের সুরই বাজুক!
২০২২ সালের সাফ মুকুট মাথায় তোলার পর অনেক নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল। দুই আসরের মাঝে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলও খুব বেশি খেলা হয়নি। বিপরীতে ভারত ও নেপাল এগিয়েছে মসৃণ পথে। দুই দেশের বিচরণ ছিল প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে। যে কারণে এবারের আসরে লাল-সবুজদের নিয়ে ভয়-শঙ্কা ছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে হারতে হারতে কোনোক্রমে ড্র করার পর সেটা প্রকট হয়েছিল। সে ম্যাচই হয়তো লাল-সবুজদের তাতিয়ে দেয়। পরের ম্যাচে ভারতকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে ভয়-শঙ্কা ঝেড়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। সেমিফাইনালে ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়তে পারেনি গ্রুপ পর্বে দারুণ নৈপুণ্য দেখানো ভুটান ৭-১ গোলের জয়ে ফাইনালে উঠে আসে বাংলাদেশ। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে স্বাগতিক নেপাল লড়াই করেছে বটে, ম্যাচটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণেই রেখেছিল বাংলাদেশ। সদ্যসমাপ্ত আসরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিণত ফুটবল উপহার দিয়েছে লাল-সবুজ শিবির। সুফল হিসেবে ২০২২ সালের মাথা তোলা মুকুটে কর্তৃত্ব হারায়নি বাংলাদেশ।
কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ভারতের কাছে ২০১৬ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল (৩-১ ব্যবধানে) হারের পর তৎকালীন বাংলাদেশ কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন বলেছিলেন, ‘এটা আমাদের উঠে আসার বার্তা। আগামীতে বাংলাদেশের জন্য ভালোকিছু অপেক্ষা করছে।’ ভালোকিছুর প্রমাণ মিলেছে গোলাম রাব্বানী ছোটনের হাত ধরে- ২০২২ সালের আসরের শিরোপা জিতে। সাফল্য-পরবর্তী সময়ে এ কোচ দায়িত্ব ছেড়ে গেছেন। বুধবার সন্ধ্যার ফাইনাল প্রমাণ করল- বাংলাদেশ পথ হারায়নি। ২৬ অক্টোবর নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে কাজী মো. সালাহউদ্দিন যুগের অবসান ঘটেছে। মসনদে বসেছেন নতুন সভাপতি- তাবিথ এম আউয়াল। গোলাম রাব্বানী ছোটনের কাছ থেকে ব্যাটন নিয়ে পিটার বাটলার যেমন বাংলাদেশকে নির্বিঘ্নে ফিনিশিং লাইনে নিয়ে গেছেন; কাজী মো. সালাহউদ্দিনের পর তাবিথ এম আউয়ালের কাছ থেকেও তেমনটা প্রত্যাশা করা হচ্ছে। পুরুষ ফুটবল ক্রমাগত হতাশ করলেও নারীদের সাফল্যের ধারাটা যাতে বজায় থাকে।
শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে মনিকা চাকমার করা গোলের অগ্রগামিতা ধরে রাখা গেছে মাত্র তিন মিনিট। আমিষা কারকির গোলে নেপাল স্কোরলাইন ১-১ করে ফেলে। পরবর্তীতে ম্যাচের ভাগ্য লিখে দিলেন ঋতুপর্ন চাকমা। আসরের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এলেন সে ঋতুপর্ন চাকমাই। সেরা গোলরক্ষক বাংলাদেশেরই রুপনা চাকমা- স্বীকৃতিটা ২০২২ সালে প্রথম শিরোপা জয়ের আসরেও পেয়েছিলেন। টানা দ্বিতীয় সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ মুকুট জয়ের পর বাংলাদেশ দলের ‘হাইলাইটস’ তৈরি করা হলে সেখানে পাহাড়িদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ফুটে উঠবে। সাফল্য-পরবর্তী উৎসবের আমেজ কিন্তু পাহাড় কিংবা সমতল; ধর্ম কিংবা বর্ণে আটকে থাকেনি। ১ লাখ ৪৭ হাজার ৬১০ বর্গ কিলোমিটারের এ ভূখণ্ডের সর্বত্রই উৎসবের রঙ ছড়িয়ে গেছে। পাহাড়, সমতল, ধর্ম, বর্ণ ছাপিয়ে গোটা দেশ যে একটা ইউনিট- সেটাই প্রমাণ করলেন ঋতু-তহুরা-সাবিনা-কৃষ্ণারা।
২০২৪ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে রেকর্ড-কার্ডে ঋতুপর্ন চাকমার নামের পাশে কেবল দুই গোল এবং তিন অ্যাসিস্ট লেখা থাকবে। এ পরিসংখ্যান কিন্তু আসরে কুশলী এ ফুটবলারের ভূমিকা বোঝাতে মোটেও যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানের পর ভারতের বিপক্ষে গোলপোস্ট কাঁপানো, চার ম্যাচেই আক্রমণের উৎস হয়ে থাকা, বাঁ পায়ের নিখুঁত ক্রস কিংবা ড্রিবলিংয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণ পরিকল্পনা এলোমেলো করে দেয়ার বিষয়গুলো তো আর রেকর্ড-কার্ডে উল্লেখ থাকবে না। ২০২২ সালের সাফ শিরোপা নিয়ে বিমানবন্দর থেকে ছাদ খোলা বাসে করে মতিঝিলে আসার পথে বিলবোর্ডের সঙ্গে ধাক্কায় মাথায় চোট পেয়েছিলেন; রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে ছুটতে হয়েছিল ঋতুকে। সতীর্থদের সঙ্গে শিরোপা উদযাপন করা হয়নি রাঙামাটির কাউখালী থেকে উঠে আসা হাস্যোজ্জ্বল এ ফুটবলারের। সে আক্ষেপ ঘোচাতেই যেন এবারের গোটা আসরকে বেছে নিয়েছিলেন ২০ বছর বয়সি ঋতু!
পাকিস্তানের পর ভারতের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে অনবদ্য নৈপুণ্যর পর স্কোরশিটে নাম লেখাতে পারেননি ঋতুপর্ন চাকমা। দুই ম্যাচে তার দুটি প্রচেষ্টা গোলপোস্টে লেগে ফিরে আসে। যে কারণে সেমিফাইনালের আগে আক্ষেপ করেই বলেছিলেন, ‘আমার কপালে গোল জোটে না’। সে কথা শুনে ভাগ্য বিধাতা হয়তো মুখটিপে হেসেছিলেন! ঋতুর আক্ষেপ দূর হয়ে যায় ভুটানের বিপক্ষে, সেমিফাইনালের সপ্তম মিনিটে। ফাইনালে ওঠার পথে ৭-১ ব্যবধানের জয়ে গোল উৎসবের সূচনা করেছিলেন এ ফুটবলারই। নেপালের বিপক্ষে ফাইনালে লিখে দিলেন শিরোপা ভাগ্য, ১-১ সমতায় এগিয়ে চলা ম্যাচে জয়সূচক গোলটা করলেন ঋতুপর্ন চাকমাই। কি অনিন্দ্যসুন্দর এক গোল। বাম প্রান্ত থেকে গোলমুখে ক্রস ফেলতে চেয়েছিলেন ঋতু। ভাগ্য বিধাতা বলটা হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন নেপালের গোলপোস্টে। জালে জড়ানোর আগে গোলরক্ষক আঞ্জিলা সাবু ঝাঁপালেন, বলে হাত লাগালেন বটে; শেষরক্ষা হয়নি।
গেল আসরে ৮ গোল করা সাবিনা খাতুন এবারের দলে ভিন্ন ভূমিকা নিয়েছিলেন। আক্রমণভাগ থেকে কিছুটা নিচে নেমে এখন খেলাটা গড়ায় মনোযোগ ৩১ বছর বয়সি ফুটবলারের। সাবিনা মাঝমাঠে নেমে আসায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন তুহুরা খাতুন। আসরে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ৫ গোল করেছিলেন ময়মনসিংহের কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা স্ট্রাইকার। ২০২২ সালের সাফ জয়ী দল থেকে আঁখি খাতুন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার পর রক্ষণ নিয়ে খানিক দুশ্চিন্তার অবকাশ ছিল বটে। দ্রুতই আস্থার জায়গায় তৈরি করেছিলেন মাসুরা পারভিন। এবারের আসরে পরিণত সেন্টার-ব্যাক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেন আফিদা খন্দকার। মাসুরা-আফিদা জুটি এবারের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দীর্ঘকায় আফিদা খন্দকার ফাইনালে নেপালের স্ট্রাইকার সাবিত্রা ভান্ডারিকে একদমই সুযোগ দেননি। দুর্ধর্ষ সাবিত্রা সুযোগ পেলে ফাইনালের চিত্রটা ভিন্নও হতে পারত! সাবিত্রাকে সামলানোর পাশাপাশি সুযোগ বুঝে ওপরে উঠে আসা, প্রয়োজনের সময় দ্রুত নেমে যাওয়া- সব দিক থেকেই দারুণ পরিণত ফুটবল খেলেছেন আফিদা।
বাংলাদেশ যখন সাফ মুকুট ধরে রাখার মিশনে ব্যস্ত। তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সদ্য দুনিয়ার আলো দেখা সন্তানকে নিয়ে আবেঘন পোস্ট দিয়েছেন গেল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ৪ গোল করা সিরাত জাহান স্বপ্না। ফুটবল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে এখন সংসারে মনোযোগী হয়েছেন সাবেক স্ট্রাইকার। ইনজুরির ধকল কাটিয়ে এবারের সাফ জয়ী দলে ছিলেন বটে, কৃষ্ণা রানী সরকার খুব বেশি সময় খেলার সুযোগ পাননি। আঁখি খাতুনের ফুটবল ছেড়ে যাওয়ার কথা তো আগেই বলা হয়েছে। কোচ বদলের গল্পটাও সকলের জানা। এতসব পরিবর্তনের মাঝেও বাংলাদেশ কিন্তু সাফল্যর পথটা হরিয়ে ফেলেনি।
যা প্রমাণ করে দেশের নারী ফুটবল সঠিক পথেই এগোচ্ছে। সঠিক পথে থাকার কারণে যদি ফুটবল নিয়ন্তারা অতীতের মতো তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, পথ হারাতেও কিন্তু সময় লাগবে না। একসময় ঘরোয়া ফুটবল থেকে বাফুফে যে পরিমাণ গেট মানি পেত, তার অঙ্ক শুনলে এখনো চোখ কপালে তোলার উপক্রম হয়। আশি-নব্বই দশকে টিকিট বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা কামাই করলেও একটা পরিপূর্ণ ফুটবল একাডেমি গড়া হয়নি, যেখানে তরুণ প্রতিভার পরিচর্যা হবে। কুফল হিসেবে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে পুরুষ ফুটবলে বাংলাদেশের হতাশার গল্পটা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। নারী ফুটবলের ক্ষেত্রে নিশ্চই একই গল্প পড়তে চাইবেন না ফুটবলামোদিরা।
মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সংবাদিক ও ক্রীড়া বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে