ক্ষুদ্র ঋণ বনাম উপযুক্ত ঋণ
ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম দারিদ্র্য বিমোচনে কতটা সহায়ক এ নিয়ে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন উত্থাপিত হতে দেখা যায়। ক্ষুদ্র ঋণ কী, কেমনভাবে তা প্রদান করা হয় এবং কেমন তার ফলাফল তা পরে আলোচনা করা হবে। এখানেই উল্লেখ করে রাখি, ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থায় সরকারি সিদ্ধান্তে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে।
এ পর্যায়ে একটি প্রশ্ন করা যাক: এই অঞ্চলে ক্ষুদ্র ঋণের (সামান্য কিছু অর্থের ঋণ) প্রচলন কখন শুরু হয়? বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে তা নয়। অনেক আগেই ছিল। সেই ব্রিটিশ আমলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক ধরনের ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালু করেছিলেন; কিন্তু তিনি এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। কারণ প্রদত্ত ঋণ আদায়ে তিনি কঠোর হতে পারেননি। ওই সময় কাবুলিওয়ালারাও এক প্রকার ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করতেন। তারা ঋণের কিস্তি শক্ত হাতে আদায় করতেন। নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা তা করতেন। বাস্তবে ঋণগ্রহীতা কতটুকু লাভবান হলেন, তা বিবেচ্য ছিল না।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে এবং ১৯৯০-এর দশক ও ২০০০-এর দশকে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। তারপর অনেক ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে ভিন্ন এক ঋণব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলেও, ক্ষুদ্র ঋণ এমআরএ নির্ধারিত আগের চেয়ে কম সার্ভিস চার্জে এবং অন্যান্য কিছু পরিবর্তন সাপেক্ষে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান আছে। আমি প্রথমে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম ব্যাখ্যা করব এবং পরে পরিবর্তিত ব্যবস্থা, উপযুক্ত ঋণ নিয়ে কিছু আলোচনা করব।
ক্ষুদ্র ঋণ এক বছরের জন্য দেয়া হয় এবং ঋণ প্রদান করার পরের সপ্তাহ থেকে সাধারণত ৪৬ কিস্তিতে মোট সার্ভিস চার্জ ও আসল আদায় করা হয়। বিস্তর মুনাফা করার সুযোগ থাকায় অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন অনেক এনজিও ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালু করে, বিশেষ করে ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত। ২০১০ সালে এমআরএর (মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটির) মূল্যায়নে দেখা যায়, সে সময় প্রকৃত সার্ভিস চার্জের হার ছিল সাধারণত ৩৫-৫০ শতাংশ। বস্তুত ক্ষুদ্র ঋণ একটি উঁচু হারে মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়। আবার প্রথম থেকে ঋণের কিস্তি আদায়ের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়।
আসলে ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করা হতো ফ্ল্যাট রেট ভিত্তিতে এবং যেদিন একটি ঋণ প্রদান করা হতো সেদিন প্রদত্ত পুরো ঋণের ওপর সারা বছরের জন্য সার্ভিস চার্জ হিসাব করা হতো, যদিও এক সপ্তাহ পর থেকে প্রদেয় সাপ্তাহিক প্রত্যেক কিস্তিতে সার্ভিস চার্জ ও আসল অন্তর্ভুক্ত থাকত। অর্থাৎ গ্রহীতার কাছে গড়ে সারা বছর ধরে গৃহীত আসল ঋণের অর্ধেক পরিমাণ থাকত। কাজেই প্রকৃত সার্ভিস চার্জের হার সরাসরি দ্বিগুণ হয়ে গেল। এছাড়া প্রথমেই বাধ্যতামূলক সঞ্চয় হিসেবে প্রদত্ত মোট ঋণের ৫ শতাংশ কেটে রাখা হতো এবং প্রত্যেক সপ্তাহে একটি পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় রাখতে হতো ঋণ প্রদানকারী এনজিওর কাছে। তদুপরি শুরুতেই দরখাস্ত প্রক্রিয়াজাত করার খরচ হিসেবে সাধারণত ৫০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা গ্রহণ করা হতো। অন্যান্য কিছু খরচও করতে হতো ঋণগ্রহীতাকে। সংগৃহীত সঞ্চয়ের ওপর ঋণগ্রহীতাকে অল্প (সাধারণত ৩-৫ শতাংশ) সুদ দেয়া হতো। আর গ্রহীতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত সঞ্চয় ব্যাংকে রেখে অথবা ক্ষুদ্র ঋণ হিসেবে খাটিয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অধিক মুনাফা করা হতো। এসব বিবেচনায় নিয়ে এমআরএ প্রকৃত সার্ভিস চার্জের উপর্যুক্ত হার হিসাব করে।
সেই প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থার একটি বিকল্প পিকেএসএফ ২০১০ সালে প্রবর্তন করে। তবে যেমন আগে বলেছি খানিকটা পরিবর্তিত ধাচে ক্ষুদ্র ঋণ এখনো ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। সফলভাবে ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য অর্থের সঙ্গে আরও কিছু সেবা প্রয়োজন; কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণের সঙ্গে সাধারণত আর কোনো সেবার ব্যবস্থা ছিল না, থাকে না। তাছাড়া সফলতার জন্য টাকার পরিমাণ এমন হওয়া প্রয়োজন যেন পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা যায়। তদুপরি কিস্তি আদায় হলেই ধরে নেয়া হতো (এখনো হয়), ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম সফল। প্রশ্ন করা হতো না (এবং এখনো হয় না) কিভাবে কিস্তি পরিশোধ করা হচ্ছে; কোনো সম্পদ বিক্রি করে, নাকি না খেয়ে, না পরে। দেখা যায়, প্রথাগত ক্ষেত্রে, ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের রমরমাই সবসময় লক্ষ্য, ঋণপ্রহীতাদের উন্নতি নয়।
শুধু কিছু টাকা দ্বারা দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্য থেকে সাধারণত মুক্তি পেতে পারে না। দারিদ্র্য আসলে বহুমাত্রিক। ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা তার সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারছেন কিনা সে বিষয় বিবেচনায় কখনো ছিল না এবং বর্তমানেও নাই বলেই প্রতীয়মান হয়।
ক্ষুদ্র ঋণের আরও একটি বিধিবদ্ধ অনুষঙ্গ হলো যে, আগ্রহী ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের প্রত্যেক ৫ জনের একটি করে গ্রুপ গঠন করা। ক্ষুদ্র ঋণের জন্য জামানত নেই, তবে গ্রুপ সদস্যরা একে অপরের এক ধরনের জামানত হিসেবে কাজ করেন; কিন্তু এই পদ্ধতি ঋণের পরিমাণ ক্ষুদ্র থাকলেই কার্যকর হয়, অর্থাৎ বিষয়টি যদি কয়েক হাজারের হয় তাহলে গ্রুপ সদস্যরা একে অপরের জিম্মাদারি নিতে রাজি থাকতে পারেন; কিন্তু ঋণের পরিমাণ মোটামুটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বড় (এক লাখ, দেড় লাখ) হলে এই গ্রুপ সংহতি কাজ করে না, কেউ কারও দায়িত্ব সাধারণত নেন না। দেখা যায়, ক্ষুদ্র ঋণের এই গ্রুপ সংহতির দিক ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতাদেরকে ক্ষুদ্রই রাখার পক্ষে কাজ করে । সাবলম্বী হয়ে টেকসই উন্নয়ের পথে এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে (যেখানে বেশি বেশি অর্থের প্রয়োজন) ক্ষুদ্র ঋণ মোটেই সহায়ক নয়।
এমআরএর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১১ সাল থেকে সার্ভিস চার্জ নির্ধারণের জন্য ফ্ল্যাট রেটের পরিবর্তে ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয় এবং এনজিওদের অর্থ-ব্যবস্থাপনার খরচ বিবেচনায় নিয়ে প্রথমে সার্ভিস চার্জ ২৭ শতাংশে নির্ধারণ করা হয় এবং বেশ কয়েক বছর পর তা ২৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়, যা এখনো বিদ্যমান। ঋণ প্রদানের সময় বাধ্যতামূলক ৫ শতাংশ সঞ্চয় সংগ্রহ প্রথা বাতিল করা হয়। দরখাস্ত প্রক্রিয়াজাত ফি ১৫ টাকা নির্ধারণে করা হয়। বর্তমানে ক্ষুদ্র ঋণ এসব এবং সময় সময় এমআরএর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করা হয়। ঋণগ্রহীতা পর্যায়ে পিকেএসএফ ২৪ শতাংশ ছাড়া বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনুদান, ১ শতাংশ, ৪ শতাংশ, ৮ শতাংশ এবং ১৮ শতাংশ সার্ভিস চার্জের ব্যবস্থা করে থাকে।
ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ দেয়া হয়। যে কাজ করা হবে তা সুচরুভাবে সম্পন্ন করার জন্য কতটা অর্থ প্রয়োজন তা বিবেচনায় নেয়া হয় না। ধরা যাক, কোনো দরিদ্র ব্যক্তি একটি ছোট চা-বিস্কুটের দোকান করার জন্য ৪০ হাজার টাকা ঋণ চাইলেন। তাকে ২০ বা ২৫ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হলো। তাহলে তাকে অবশিষ্ট টাকার জন্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। এভাবে একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে গিয়ে এক পর্যায়ে অনেককে ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে পড়তে হয় । সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা তাদের পক্ষে প্রায়শই সম্ভব হয় না। আবার অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ না নিলেও প্রাপ্ত ঋণের অর্থ অপ্রতুল বলে প্রস্তাবিতভাবে তা কাজে লাগানো সম্ভব হয় না। ফলে তা হয়তো ভোগে খরচ করা হয়ে যায় এবং মুনাফা করার সুযোগ তৈরি না হওয়ায় ঋণ পরিশোধ করার ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করে ঋণগ্রহীতা পরিবারগুলোর আয় কিছু বাড়লেও তাদের মধ্যে শতকরা ১০ শতাংশের বেশি পরিবার দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে পারেনি। ২০১০ সালে প্রকাশিত ওয়াশিংটন-ভিত্তিক বিশ্ব মাইক্রো ক্রেডিট সামিট ক্যাম্পেইনের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা দরিদ্র পরিবারদের মাত্র ৯ দশমিক ৪ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছিল। আমার নিজের ২০০৭ সালে প্রকাশিত এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক একটি বই রয়েছে, ফলাফল প্রায় একই রকম। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর গবেষণায় একই রকম ফলাফল পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে ৭টি দেশের (ভারত, মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন, বজনিয়া-হার্জেগভিন, মেক্সিকো, মরক্কো ও ইথিওপিয়া) ওপর যুক্তরাজ্যের এমআইটির আব্দুল লতিক জামিল পোভার্টি অ্যাকশন ল্যাব ও নিউহ্যাভেনস্থ ইনোভ্যাশনস ফর পোভার্টি এ্যাকশন-এর যৌথ গবেষণায় এ রকম ফলাফল উঠে আসে (২০১৫ সালে প্রকাশিত)। আবার যারা ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে তারাও বিভিন্ন কারণে (যে ব্যক্তি আয় করেন তার অসুস্থতা বা মৃত্যু, প্রাকৃতিক দুর্যোগ) আবারও দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যেতে পারেন। অর্থাৎ ক্ষুদ্র ঋণ দারিদ্র্য নিরসনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নয়, আর টেকসই দারিদ্র নিরসনের তো নয়ই।
আমি পল্লি কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান থাকাকালে (২০০৯-২০২৩) আমার দিক-নির্দেশনায় ক্ষুদ্র ঋণের এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্য উপযুক্ত ঋণ কার্যক্রম চালু করা হয়। উপযুক্ত ঋণ কার্যক্রমের মূল ধারণা হচ্ছে দরিদ্র ও স্বল্পআয়ের পরিবারদেরকে ক্ষুদ্র ঋণের পরিবর্তে যথাযথভাবে প্রস্তাবিত কার্য্য সম্পাদন করার জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন তাকে সেই পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে দেয়া এবং পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অ-আর্থিক সেবা প্রদান করা।। যার এক লাখ টাকা প্রয়োজন তাকে এক লাখ টাকাই দেয়া হবে। আবার যার ৫ লাখ টাকা প্রয়োজন তাকে ৫ লাখ টাকাই দিতে হবে। যাতে কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য ঋণ গ্রহীতাকে একাধিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট যেতে না হয়। যারা অতিদরিদ্র তারা যে পরিমাণ অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন তাদেরকে সেই পরিমাণ ঋণ দেয়া এবং সেটাই তাদের জন্য উপযুক্ত ঋণ ‘ক্ষুদ্র’ অবিধা লাগানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এ ক্ষেত্রে বেশি ঋণ দিলে তা কার্যকরভাবে ব্যবহৃত নাও হতে পারে। উপযুক্ত ঋণ কার্যক্রমের আওতায় পিকেএসএফ প্রথমে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করে। পরবর্তী পর্যায়ে একটি ঋণের অর্থের পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে আরও বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনে এবং বাস্তবতার আলোকে সেভাবে ঋণ দেয়া যেতে পারে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমি প্রত্যক্ষ করেছি, একটি দরিদ্র পরিবার স্বল্প পরিমাণ তবে উপযুক্ত ঋণ এবং পাশাপাশি যথাযথ অআর্থিক সহযোগিতা গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থার উন্নতি করেন এবং পরবর্তী সময়ে আরও বেশি পরিমাণ ঋণ এবং প্রয়োজনীয় অ-আর্থিক সেবা গ্রহণ করে আরও উন্নতি করেন। এই সফলভাবে এগিয়ে এগিয়ে চলার পথে, গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো ঋণের পরিমাণ যথাযথ (অর্থাৎ উপযুক্ত ঋণ) এবং সঙ্গে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ অ-আর্থিক বিভিন্ন সেবা যথা: প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি সংগ্রহে সহায়তা, পণ্যের মান উন্নয়নে ও সংরক্ষণে সহায়তা এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা।
এখানে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে প্রথম সপ্তাহ শেষ হওয়া থেকে প্রতি সপ্তাহে কিস্তি আদায়ের ব্যবস্থা রয়েছে। এতে ঋণগ্রহীতার পক্ষে কিস্তি দেয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তিনি যে কাজের জন্য ঋণ নিয়েছেন সেই কাজ থেকে আয় আসতে কিছু সময়ের প্রয়োজন হয়। তাই কেউ কেউ ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করার পর তা থেকে সাপ্তাহিক কয়েক কিস্তি পরিশোধের মতো অর্থ আলাদা করে রেখে দেন। সেই টাকা দিয়ে সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করেন। এতে বিনিয়োগ করার মতো অর্থের পরিমাণ আরও কমে যায়।অথবা ঋণগ্রহীতাকে অন্য উৎস থেকে অর্থ ব্যবহার করে কিস্তি দিতে হয়। উপযুক্ত ঋণ কার্যক্রমের আওতায় ঋণগ্রহীতার সঙ্গে আলোচনা করে সুবিধাজনকভাবে কিস্তি আদায়ের সময় বিন্যাস করার ব্যবস্থা রাখা হয়। কৃষি খাতে ফসল ওঠানোর পর এককালীন ঋণ পরিশোধ করা যায়।
ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমে একজন ঋণগ্রহীতার গৃহীত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলেন কি না, তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয় না। সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করলেই সব ঠিকঠাক বলে ধরে নেয়া হয়। উপযুক্ত ঋণ কার্যক্রমে ঋণের অর্থ ও অ-আর্থিক সহয়তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজরদারি করা হয়।
আমি পিকেএসএফর চেয়ারম্যান থাকা পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি উপযুক্ত ঋণ এবং প্রয়োজনীয় অ-আর্থিক সেবা প্রদান করে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা ছাড়াও ২৭ লাখের মতো কুটির ও মাইক্রো উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে ভূমিকী রেখেছে, দেশের সর্বত্র বিভিন্ন খাতে। পিকেএসএফ অন্যান্য উদ্ভাবনী বিষয়সহ একটি বিশেষ কার্যক্রমে উপযুক্ত অর্থায়ন এবং বিভিন্ন অ-আর্থিক সেবা প্রদান করতে শুরু করে ২০১০ থেকেই আমার দিকনির্দেশনায় ও অনুপ্রেরণায- আর তা হচ্ছে উদ্যোগ, মূলত কুটির ও মাইক্রো পর্যায়ের। এসব উদ্যোক্তা সফলতার সঙ্গে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে আবার বেশ বড় পরিসরে তাদের কার্যক্রম নিয়ে গিয়েছেন।
এই সংষ্কার বিন্যাসে, একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো ইউনিয়ন ভিত্তিক মানবকেন্দ্রিক বহুমাত্রিক সমন্বিত উন্নয়ন ধারায় গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রম, যা সমৃদ্ধি নামে পরিচিত। উপযুক্ত ঋণ কার্যক্রমের আওতায় ঋণ এবং অ-আর্থিক সেবা গ্রহণ করে বিপুল সংখ্যক মানুষ যারা এক সময় অতি দরিদ্র্য বা দরিদ্র্য ছিলেন তারা টেকসইভাবে দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে আসতে সমর্থ হয়েছেন, অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন, টেকসই উন্নতির পথে হাঁটছেন। গ্রামীণ অর্থনীতির তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তরে অবদান রাখছেন।
গ্রামের মানুষের এক উল্লেখ্যযোগ্য অংশ এখন কুটির বা মাইক্রো উদ্যোক্তা হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এসব উদ্যোক্তা সৃষ্টির ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যারা বিভিন্ন কুটির ও মাইক্রো উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তাদের অনেকেই বৃহৎ শিল্পের জন্য উপকরণ জোগান দিতে পারছেন, কিছু কিছু পণ্য তারা রপ্তানিও করছেন। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে টেকসই করার লক্ষ্যে কৃষির যান্ত্রিকরণে সরকারি কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে এবং ব্যাপক ভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। উদ্যোগ তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজন যাদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের চিহ্নিত করে তাদের সুপ্ত সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলা এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক এবং অ-আর্থিক সহায়তা প্রদান করা।
সবশেষে বলতে চাই, ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় অ-আর্থিক সেবাসহ উপযুক্ত ঋণপ্রদান ব্যবস্থা সর্বত্র চালু করা উচিত।পিছিয়ে থাকা অর্থাৎ দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের উন্নতির পথে এগিয়ে চলার এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত করার স্বার্থেই।
ক্ষুদ্র ঋণ যে দারিদ্র্য বিমোচনে কোনো কার্যকর পদ্ধতি নয় তা আমি প্রথম বিশ্লেষণ করে দেখাই ১৯৮৩ সালে এক লেখায়, পরবর্তী সময়ে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক সম্মেলনে এম এন হুদা মেমোরিয়েল বক্তৃতায় আমার এমন মূল্যায়ন জোরালোভাবে প্রকাশ করি। বলেছিলাম : ক্ষুদ্র সুন্দর, কিন্তু ক্ষুদ্র যদি যুগ যুগ ধরে ক্ষুদ্রেই আবদ্ধ থাকে তাহলে তা কুৎসিৎ ('Small is beautiful, but it's ugly if it perpetuates' )। তারপর ২০০৭ সালে দেশব্যাপী গবেষণা ভিত্তিক প্রকাশিত আমার বইয়ের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পিকেএসএফের চেয়ারম্যান থাকাকালীন মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্র ঋণ সংক্রান্ত বিরূপ বাস্তবতা ব্যাপকভাবে দেখেছি এবং উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধনে দিক-নির্দেশনা দিয়েছি, সিন্ধান্ত দিয়েছি। পিকেএসএফ ও সহযোগী সংস্থাসমূহ সেসকল ধারন করে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করেছে, সংযোজন করেছেন। ফলে পিকেএসএফ একটি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের জন্য অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বহুমাত্রিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে এবং পিকেএসএফের অনেক সহযোগী সংস্থা অতীতের ক্ষুদ্র ঋণ সংশ্লিষ্ট বদনাম কাটিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে