প্রথমবারের মতো বাজেটে কমছে টাকার পরিমাণ
আগামী ২ জুন দেশের ৫৪তম বাজেট পেশ করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের আকার কমছে ৭ হাজার কোটি টাকা। এর আগে ৫৩টি বাজেট পেশ হলেও কোনোবার বাজেটের আকার কমেনি। সেই হিসেবে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কমছে বাজেটের আকার। এছাড়া বৃহস্পতিবার বাজেট পেশের রেওয়াজ থাকলেও এবার সোমবার বাজেট পেশের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে আসছে বাজেটে আকার কমছে ৭ হাজার কোটি টাকা।
বাজাটের আকার কমার বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে সরকারের আয় কম, শুল্ক-কর আদায়ও খুব বেশি বাড়েনি। আবার বিদেশি সহায়তার ঋণ পরিশোধেও বিপুল অর্থ খরচ হচ্ছে। এসব কারণে বাজাটের আকার কমছে।
তবে আকার কমলেও বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কাল্পনিক সংখ্যার সঙ্গে আরেকটা কাল্পনিক সংখাকে তুলনা করা হতে যাচ্ছে। দেশে যত বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে তার কোনোটিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সবই ছিল কল্পনার জগতে। এবার সেই কল্পনার জগৎকেই সামনে রেখে আরেকটা কল্পনার বাজেট তৈরি হতে যাচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের কারিগরি কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরের জন্যও সরকার মূল্যস্ফীতি নির্ধারণ করতে পারে ৬.৫ শতাংশ।
আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫.৫ শতাংশ। যা চলতি অর্থবছর আছে সাড়ে ৬ শতাংশ। মূলত আগামী বাজেটে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৩ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেট ঘাটতি ধরা হতে পারে ৩.৬২ শতাংশ।
এই হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে সরকারের আয়ের লক্ষ্য হতে পারে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি টাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থা, সঞ্চয়পত্র ও বিদেশি উৎসসহ অন্যান্য ব্যবস্থা থেকে সংগ্রহ করতে হবে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে এনবিআরের।
জানা গেছে, এনবিআর চাচ্ছে ৫ লাখ টাকার লক্ষ্য নিতে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের জন্য চাপ অব্যাহত রেখেছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে আগের কোনো সরকারই টার্গেট বাস্তবায়ন করতে পারিনি। চলতি অর্থবছর শেষে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৪.৫-এর বেশি হবে না।
আবার আগামী অর্থবছরের বাজেটও যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৫ ধরা হয় তাহলে প্রবৃদ্ধি ১০০ বেসিস পয়েন্ট বাড়বে। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে ২০০ বেসিস পয়েন্ট কমাতে হবে। যা কোনোভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য না।
তিনি বলেন, এদিকে ঘাটতি গতবছরের তুলনায় জিডিপি অনুপাতে কমলেও টাকার অঙ্কে চিত্রটা অন্যরকম হবে। ফলে বিদেশি উৎস থেকে যা পাওয়া যাবে তা-ও খুব একটা সুখকর না।
ফলে ঘাটতি পূরণে ব্যাংকব্যবস্থার ওপরই বেশি নির্ভর করতে হবে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ অন্য সরকারের বাজেটের মতোই নেতিবাচক ধারায় থাকবে। ফলে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ খুব একটা থাকবে না।
এই অর্থনীতিবিদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ কম হলে ডলারের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, কমবে না। তাই কল্পনার জগৎ থেকে বের হয়ে বাস্তবায়নযোগ্য বাস্তবভিত্তিক বাজেট প্রস্তাব করতে হবে। যাতে নতুন বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেখে জনগণকে স্বস্তি দেয়া যায়।
এদিকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারে। যা চলতি অর্থবছরে রয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে অবহেলিত গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে জোর দেয়া হবে আগামী বাজেটে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় সুবিধাভোগীদের ভাতা কিছুটা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকদের দাবিদাওয়া পূরণের চেষ্টা থাকবে আগামী বাজেটে।
জুলাই আন্দোলনের চেতনা এবং শ্বেতপত্র কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশের প্রতিফলন আগামী বাজেটে থাকবে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বাজেটের আকার না বাড়লেও সরকারের বেতন-ভাতা, সুদাসলসহ দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ কিছুটা বাড়বে। বিপরীতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে খরচ কমানো হবে। আবার নানা খাতে ভর্তুকি কমানোও সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ থাকবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে